বামপন্থীরা (বা কমিউনিস্টরা) রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বলে গালাগালি করেছিল – দক্ষিণপন্থীদের দ্বারা এই বহুল প্রচারিত কুৎসা নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। প্রথম কথা এটি একটি অর্থ সত্য (যা কিনা মিথ্যার চেয়েও ভয়ানক। হ্যাঁ, বলা হয়েছিল। কে বলেছিলেন, কোথায় বলেছিলেন দেখে নেওয়া যাক।
‘মার্কসবাদী’ নামক পত্রিকায় “বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্ম সমালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা (তখনও সিপিআইএম এর জন্ম হয় নি), বুদ্ধিজীবী প্রাবন্ধিক প্রয়াত ভবানী সেন (রবীন্দ্র গুপ্ত ছদ্ম নামে ) রবীন্দ্রনাথের যে মূল্যায়ন করেছিলেন তাতে বুর্জোয়া, ভাববাদী ইত্যাদি শব্দ আসে [সূত্র: ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত ‘মার্ক্সবাদী সাহিত্য: বিতর্ক’; প্রথম খন্ড, নতুন পরিবেশ প্রকাশনী]।
প্রথম কথা ভবানী সেন কবি কে বুর্জোয়া বলার ঢের আগে কবির সর্ম্পকে এই মূল্যায়ন চালু ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে নিজেকে শ্রেনী অবস্থানের দিক থেকে কি ভাবতেন, সেটাও একটু দেখে নেওয়া যাক। ১৭.০৩.১৯৩৯ এর চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে তিনি লিখছেন – “যখন ময়মনসিংহগীতিকা হাতে পড়ল, খুব আনন্দ পেয়েছিলুম। শ্রেনীওয়ালাদের মতে এসব কবিতা হয়তো বা প্রোলিটেরিয়েট, কিন্তু আমি তো জাত – বুর্জোয়া, আমার ভালো লাগতে একটুও বাধে নি।” [রবীন্দ্রনাথ, চিঠিপত্র]।
দ্বিতীয় কথা এই যে কবি সম্পর্কে ভবানী সেনের এই মূল্যায়ন এমন ভাবে মুক্তায়ন ছিল লেখক হিসেবে সেনের একান্ত একক সিদ্ধান্ত, উনি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ছিলেন না বা ওই মূল্যায়ন পার্টির সামগ্রিক সিদ্ধান্তও ছিল না। এর প্রমাণ আমরা পাই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির আরেক নেতা, পরবর্তীকালে সাংসদ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এর লেখা থেকে।
২২সে জুন ১৯৪১ সালে হিটলার দ্বারা সোভিয়েত ভূমি আক্রান্ত হওয়ার পর পরই তাঁর এবং স্নেহাংশু আচার্য, জ্যোতি বসু, গোপাল হালদার চিন্মহণ সেহানবীশ প্রমুখ কমিউনিস্টদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ফ্রেন্ডস অফ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সোভিয়েত সুহৃৎ সমিতি। ড: ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা (স্বামী বিবেকানন্দ এর ভাই) এর সভাপতি হন।
সদ্য স্থাপিত সমিতির পক্ষ থেকে সুরেন গোস্বামী গেলেন শান্তিনিকেতনে – রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য তখন ভেঙ্গে পড়েছে, কিন্তু তাঁর আশীর্বাদের বড় প্রয়োজন ছিল সমিতির। কবি রাজি হলেন সমিতির পৃষ্ঠপোষক হ’তে, তবে সাবধান করে দিয়ে বললেন যে, ইংরেজ নিজের স্বার্থে সোভিয়েতকে সাহায্য করবে বলছে বটে, কিন্তু “বিশ্বাস কোরো না ওদের; তোমরা কমিউনিস্টরা ওদের বিরুদ্ধে লড়াইতে গা-ঢিলা দিয়ো না।” কমিউনিস্ট পার্টির ও চিন্তা তখন ঐরূপই ছিল – তাই সুরেন বাবু দেখালেন রবীন্দ্রনাথকে পার্টির সদ্য গৃহীত প্রস্তাব, কবি পুলকিত হলেন। [সূত্র: হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় , তরী হতে তীর, মনীষা গ্রন্থালয়]।
তৃতীয় কথা এই যে, পরবর্তীকালে স্বয়ং ভবানী সেন তাঁর অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে আসেন সেটা তার লিখিত “একজন মনস্বী ও একটি শতাব্দী” শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করলেই জানা যায়। একটু ছোট্ট অংশ উদ্ধৃত করা যাক। “স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে – ভাববাদ যদি জীবন্ত সত্যের বিরোধী ই হবে তাহলে রবীন্দ্রনাথ কেমন করে ভাববাদের আশ্রয় থেকে জীবনের মহাসত্যকেই রূপ দিতে পারলেন, কেমন করে তাঁর পক্ষে সম্ভব হ’লো ভাববাদের ঊর্ধ্বে উঠে, যে সত্য বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের একান্ত নিজস্ব, তাকে উজ্জীবিত করা? এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর এই যে তিনি ছিলেন মহান শিল্পী, এবং মহান শিল্পীর সৃষ্টি প্রতিভার বৈশিষ্ট্যই এই যে সত্য তাঁর মধ্যে প্রতিফলিত হয়। তাই তাঁর মনের মধ্যে ছিল এমন একটি সত্যানুসন্ধানী আবেগ যা তাঁকে তাঁর দার্শনিক বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে, অতিক্রম করে নিয়ে গেছে তাঁকে সেই ভাববাদী দর্শনের সীমা থেকে।” [সূত্র: নীলরতন সেন সম্পাদিত রবীন্দ্র বীক্ষা, এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি]
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ভবানী সেন আগের অবস্থান থেকে এতটাই সরে এসেছিলেন যে প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক নারায়ন চৌধুরী সেন মশাইকে বিদ্রুপ করে লিখেছিলেন, “হাওয়ামোরগের মত বায়ুর গতি বুঝে কেবলই যদি দিক বদলাতে হয় তাহলে তার মূল্যায়ন নামক অনুশীলনীর কোন সার্থকতা থাকে না” [সূত্র: সংস্কৃতি’ ৭১]
এই লেখা আর দীর্ঘায়িত না করে এবার শেষ করা যেতে পারে কবি’র জীবনের শেষ দিনগুলিতে গিয়ে। রবীন্দ্রনাথের জীবন অবসানের ঘটতে তখন দেরি ছিল না। সোভিয়েত আক্রান্ত হওয়ার পর ছয় সাত সপ্তাহের বেশি তিনি বাঁচেন নি। মৃত্যু শয্যায় শুয়ে কেবল জানতে চাইতেন যুদ্ধের খবর আর যে দেশে তিনি “লক্ষ্মীর কল্যাণী মূর্তি” দেখেছিলেন সেই সোভিয়েত দেশ এর জেতার সামান্য কোনো খবর পেলেও শিশুর মতো খুশি হতেন, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিস এর মতো অন্তরঙ্গ সহচরকে বলে গিয়েছিলেন যে, “সোভিয়েত কখনো হার মানবে না।” এক বিষন্ন শ্রাবণ দিনে কবি চলে গেলেন, ব্যাথাতুর দেশবাসীর মহাগুরু পতনের আঘাত সইল, উপায়ন্তর ছিল না, মৃত্যু তো অবধারিত ঘটনা । তবে কবির ঋষিবাক্য ব্যর্থ হয় নি, যে দেশে তিনি ‘লক্ষীর কল্যানী মূর্তি’ দেখেছিলেন সেই সোভিয়েত দেশ পরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রমাণ করলো যে সমাজবাদ অপরাজেয়। [সূত্র: চিন্মহণ সেহানবীশ, রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজ, বিশ্বভারতী প্রকাশ]
ফ্যাক্ট চেকটি শেষ হল।











