গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমের মাধ্যমে সকলেই জেনে গেছেন। তথাপি সংক্ষেপে ফলাফলটি তুলে ধরিঃ
ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (NDA) মহাগঠবন্ধন (MGB)
বি জে পি (৮৯ আসন) (২০.৬% ও দাঁড়ানো আসনে ৪৮.৫%) আর জে ডি (২৫) (২২.৯৮% ও ৩৮.৯৮%)
জে ডি (ইউ) (৮৫) (১৯.৭% ও ৪৫.৫% ভোট) আই এন সি (৬) (৮.৯৮% ও ৩৪.৫%)
এলজেপি (আরভি) (১৯) (৪.৯৮ % ও ৪৩.৪%) সিপিআইএমএল (লিবারেশন) (২) (২.৮৫% ও ৩৫.৬%)
এইচ এ এম (৫) সি পি আই এম (১) (০.৭৪%)
আর এস এইচ টি এল কে এম (৪) আই আই পি (১)
সি পি আই (০) (০.৬১%)
ভি আই পি (০)
——————————————————————————————————-
মোট ২০২ (গতবার ১২৫) ৩৫ (গতবার ১১০)
অন্যান্য
এ আই এম আই এম (৫) (১.৯%)
বি এস পি (১)
জে এস পি (০) (৩.৪%)
বিহার বিধানসভার মোট আসনঃ ২৪৩ গরিষ্ঠতা অর্জনের সংখ্যাঃ ১২২
দেখলেই বোঝা যাবে যে ৮৩% আসন জয় করে বিজেপি এবং জেডি(ইউ) এর নেতৃত্বাধীন এন ডি এ বিশাল এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এন ডি এ জোটের এই বিশাল জয় বিশেষ করে জে ডি (ইউ), বি জে পি এবং এল জে পি (আর ভি) – দল তিনটির এত সংখ্যক আসন বৃদ্ধি এবং দুর্দান্ত স্ট্রাইক রেট সমস্ত ভোট বিশেষজ্ঞদেরও অবাক করেছে। কেবলমাত্র মুসলিম প্রধান উত্তর-পূর্ব সীমাঞ্চলে এ আই এম আই এম পাঁচটি আসন জেতা ছাড়া চম্পারন, শরণ, তীরহুত, মিথিলা, দারভাঙ্গা, কোশী, ভোজপুর, পাটনা, মগধ, ভাগলপুর, অঙ্গ সব কটি অঞ্চলেই এন ডি এ জোট ভাল ফল করেছে এবং এগিয়ে থেকেছে। ভোট সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ভাবে হয়েছে এবং রেকর্ড ৬৭% মানুষ ও মহিলাদের ৭১% ভোট দিয়েছেন। এর সঙ্গেসঙ্গে সমগ্র উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য ভারত দখলের পর টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির বিজয় রথ হিন্দি বলয় ও পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান ও তৃতীয় জনবহুল রাজ্য বিহার পুনর্দখলের মধ্যে দিয়ে তিনটি রাজ্য বাদ দিয়ে পূর্ব ও উত্তর পূর্বের বাদবাকি নয়টি রাজ্যের ক্ষমতা দখল করে ফেলল।
কেন এমন ঘটল?
(১) মহিলা ভোটঃ বিহারের ১৩ কোটি জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক (৪৯%) মহিলা। প্রণয় রায়ের মত বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ রা জানিয়েছিলেন মহিলা ভোট এবার নির্ণায়ক শক্তি হতে চলেছে বিশেষ করে অন্যান্য শর্তহীন অর্থ (Unconditional Cash Transfer) ও অন্যান্য সুবিধা প্রদান বিশেষ করে নির্বাচনের কিছুদিন আগে মহিলাদের ১০ হাজার টাকা করে এককালীন অর্থ সাহায্য (মোট ১.২১ কোটি মহিলা ‘মুখ্যমন্ত্রী রোজগার যোজনা প্রকল্পে’ এই অর্থ পান)। বিশ্ব ব্যাঙ্কের এই ব্যবস্থাপত্র (Prescription) যেমন ব্রাজিল সহ উন্নয়নশীল ও তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলির দুঃস্থ পরিবারগুলির অর্থনৈতিক সুরাহা করেছে, পাশাপাশি বামপন্থী সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনগুলিকেও অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে। ভারতের মাটিতে এটির প্রথম সফল এবং ব্যাপক প্রয়োগ করেন যথাক্রমে অন্ধ্র ও তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এন টি রামা রাও এবং জয়ারাম জয়াললিথা। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প’ এবং মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান ‘মুখ্যমন্ত্রী লাডলি বহেনা যোজনা’ গুলির সার্থক রুপায়ন করে মহিলাদের মধ্যে স্থায়ী সংহত ভোট ব্যাঙ্ক গড়ে তোলেন। শ্রী রায় বলেছিলেন মহিলারা যত ভোট দেবেন তত এন ডি এ জোটের জেতার সম্ভবনা বেশি হবে। এবারের বিহারের বিধানসভা ভোটে ঘটেছেও তাই।
২০০৬ এ নীতিশ কুমার পঞ্চায়েত রাজ ব্যবস্থায় ৫০% মহিলা আসন সংরক্ষণ চালু করেন। বিশ্ব ব্যাঙ্কের আর্থিক সাহায্য নিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলেন এবং গরীব পরিবারের ১৪ লক্ষ মহিলাকে ‘জীবিকা দিদি’র কাজে নিয়োগ করেন। ২০০৭ থেকে ‘মুখ্যমন্ত্রী বালিকা বাইসাইকেল যোজনা’ প্রকল্পে স্কুল ছাত্রীদের বাইসাইকেল প্রদান করেন এবং ‘মুখ্যমন্ত্রী কন্যা উত্থান যোজনা’ প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ, পোশাক, বই -খাতা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে বালিকাদের বিদ্যালয়ে ভর্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। তিনি সরকারি চাকরিতে মহিলাদের ৩৫% সংরক্ষণ লাগু করেন। বিহারের মত দরিদ্রতম প্রদেশে সমস্ত বাধা এবং বিশাল রাজস্ব উপেক্ষা করে মদ নিষিদ্ধ করা ছিল একটি মহৎ এবং বিপ্লবী সিদ্ধান্ত। রাম মনোহর লোহিয়া শিস্য সমাজবাদী (Socialist) স্বল্পবাক নীতিশ কুমার বিহারের মত পশ্চাদপদ পুরুষতান্ত্রিক সামন্তবাদী রাজ্যে একের পর এক এই ধরনের নারী সহায়ক প্রকল্প রুপায়ন করে নিঃশব্দে এক সামাজিক পরিবর্তন সংঘটন করেন এবং সঙ্গেসঙ্গে এক বিশাল মহিলা ভোট ব্যাঙ্ক নির্মাণ করেন।
(২) স্পেশাল ইন্টেন্সিভ রিভিশন (এস আই আর): কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের পরিকল্পনায় নির্বাচন কমিশন যে ‘এস আই আর’ চালু করেছে তার প্রথম প্রয়োগ ক্ষেত্র ছিল বিহার। বহু জটিলতা নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতিতে এটি লাগু হয়। এর অন্যান্য দিকের সঙ্গে বিহারের ভোটার লিস্টের থেকে ৬০ লক্ষের মত (মোট ভোটের প্রায় ১০%) নাম বাদ যায়। এর একটি বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিক এবং গরীব ভূমিহীন ক্ষেত মজুর। এরা অনেকেই ছিলেন বিরোধী দলের ভোটার। হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনী যুদ্ধে এটি অনেক পার্থক্য করে দেয়।
(৩) জন সুরজ পার্টি এবং অল ইন্ডিয়া মাজলিস – ই – মুসলিমীন এর ভোট কাটাকাটিঃ পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল দলটি যেমন বাহ্যিকভাবে বিজেপির বিরোধিতা করলেও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপির হয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কাজ করে সেরকম হায়দ্রাবাদের এ আই এম আই এম সমস্ত ভোটে বিরোধীদের মুসলমান ভোট কেটে বিজেপির সুবিধা করে দেয়। বিহারে প্রায় ২০% মুসলমান ভোট। এবারও তারা আর জে ডি, কংগ্রেস ও সি পি আই এম এল (লিবারেশন) এর মুসলমান ভোট কেটে এন ডি এ প্রার্থীদের জিততে সাহায্য করেছে এবং মুসলমান প্রধান সীমাঞ্চলে (পূর্ণিয়া ডিভিশনের আরারিয়া, কাটিহার, পূর্ণিয়া ও কিশানগঞ্জ জেলা) নিজেদের প্রার্থীদের জিতিয়েছে। অন্যদিকে আড়াই বছর ধরে বিহারের গ্রামগঞ্জ তোলপাড় করে বহু অর্থব্যয়ে প্রচার করে জন সুরাজ দল প্রতিষ্ঠান বিরোধী পরিসরটি বিরোধীদের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সমস্ত আসনে প্রার্থী দিয়ে নিজেরা কোথাও জিততে না পারলেও ভোট কেটে এন ডি এ প্রার্থীদের জিততে সাহায্য করেছে। দুই দলের মিলিত ভোটের হার ৫.৫%, যেখানে আর জে ডি এবং বি জে পি / জে ডি (ইউ) এর মধ্যে ভোটের হারের পার্থক্য ৩% এর কম। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে আর এস এস – বিজেপির চিত্রনাট্য মেনে প্রশান্ত কিশোর ও আসাউদ্দিন ওয়েসি তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন।
(৪) নীতিশ কুমার বনাম তেজস্বী যাদবঃ বয়সজনিত অসুস্থতার কারণে নীতিশ কুমার এখন অতটা সক্রিয় নন কিন্তু বিহার রাজনীতিতে তাঁর বিশাল প্রভাব, প্রচুর কাজ, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি এবং জনপ্রিয়তাকে বিরোধীরা খাটো করে দেখে ভুল করেছেন। অন্যদিকে এককভাবে বিহারের সবচাইতে বৃহৎ ও শক্তিশালী দল হলেও অভিজ্ঞ বিজেপি নেতৃত্ব নীতিশ কুমারের সঙ্গে গাঁটছড়া ভেঙ্গে দেননি। ২০০০ থেকে নয় বারে প্রায় ২৪ বছরের বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় রেল, কৃষি ও ভূতল পরিবহন মন্ত্রী, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, প্রাক্তন সরকারি কর্মী, মিতভাষী, কর্মপটু নীতিশ কুমার কার্যত দীর্ঘসময় ধরে বিহারে বজায় থাকা গুন্ডা, ডাকাত, মাফিয়া, অপহরণকারী – রাজ এবং জাতপাত ও রাজনৈতিক হিংসার অবসান ঘটিয়ে সুশাসন প্রবর্তন করেন এবং মাওবাদী সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করেন। জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘সর্বাত্মক বিপ্লবে’র ছাত্র আন্দোলন এবং ‘জরুরি অবস্থা’ বিরোধী গণআন্দোলন থেকে উঠে আসা পশ্চাদপদ কুরমি সম্প্রদায়ের এই উচ্চশিক্ষিত সমাজবাদী নেতা বিহারে প্রভাবশালী যাদব সম্প্রদায় ছাড়াও অন্যান্য পশ্চাদপদ, প্রবলভাবে পশ্চাদপদ (EBC), দলিত, মহাদলিত সম্প্রদায়গুলিকে শিক্ষাগত, আর্থিক এবং কর্মসংস্থানের দিক থেকে উঠে আসতে সহায়ক হন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে বারবার দলবদল এবং জনতা পরিবারে ভাঙ্গন ঘটিয়ে নতুন নতুন দল গঠনের (সমতা পার্টি, জে ডি (ইউ) ) সমালোচনা থাকলেও দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র, অশালীনতা ও স্বেচ্ছাচার, যা কিনা ভারতীয় ও বিহারী রাজনীতিকদের ট্রেডমার্ক, তাঁর ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। তাঁর বিভিন্ন কার্যকালে কেন্দ্রের থেকে প্রচুর আর্থিক বরাদ্দ সংগ্রহ করে তিনি বিহারের পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করেন, ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নেন, জাত গত সেন্সাস করেন, বেশ কিছু যুবক যুবতীর সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করেন, খেলাধূলায় উৎসাহ দেন। বিপরীতে তেজস্বী পিতা লালু প্রসাদের সময়কার পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি থেকে সর্বব্যাপী দুর্নীতি এবং দুষ্কৃতীরাজ মানুষ ভুলে যায়নি। এর উপর তেজস্বীর হামবড়াই ভাব এবং প্রভাবশালী যাদব সম্প্রদায়ের দাপটের পুনরাভিনয়ের আশঙ্কা তাঁর বিরুদ্ধে গেছে। এন ডি এ – র সুশাসন বনাম জঙ্গলরাজ প্রচারে মানুষ সুশাসনের পক্ষে রায় দিয়েছে।
(৫) নরেন্দ্র মোদী বনাম রাহুল গান্ধীঃ নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকলেও তিনি যে দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং পোড় খাওয়া রাজনীতিক, সংগঠক ও প্রশাসক এতে কোন দ্বিমত নেই। টানা ১৪ বছরের গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী এবং ১২ বছরের ভারতের প্রধানমন্ত্রী তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়ও। তাঁর আরেকটি কৃতিত্ব তিনি একদা শাসক এখন বিরোধী জাতীয় কংগ্রেস দলকে একদম দুর্বল করে দিয়ে বিজেপিকে নিষ্কণ্টক করে তুলেছেন এবং বিরোধী ও কংগ্রেস নেতা অনভিজ্ঞ রাহুল গান্ধীকে নিয়ে ছেলেখেলা করে চলেছেন। প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সুপরিকল্পিত ও নিয়মিতভাবে বিহারে প্রচার চালিয়ে গেছেন, বিহারের জন্য প্রচুর বাজেট বরাদ্দ করেছেন এবং পাহেলগাঁও হত্যা ও ‘অপারেশন সিঁদুর’ কে কাজে লাগিয়েছেন। বিপরীতে প্রৌঢ়ত্বপ্রাপ্ত রাহুল গান্ধী ব্যাক্তিগতভাবে ভাল মানুষ হতে পারেন কিন্তু ভারতীয় পরিস্থিতি, বাস্তব রাজনীতি কিছুই এখন অবধি বুঝে উঠতে পারলেন না। সংগঠনও কিছু বোঝেন বলে মনে হয়না। নির্দিষ্ট কিছু এলিট বন্ধু ও পরামর্শদাতার কথায় কাজ করেন এবং ভুল রণকৌশল নিয়ে দলকে ক্রমাগত বিড়াম্বনায় ফেলে চলেছেন। কংগ্রেসের না নিচ্ছেন দায় ও দায়িত্ব, না ছাড়ছেন অন্য কোন যোগ্য ব্যক্তিত্বের উপর। ফলে তাঁর আমলে কংগ্রেস ক্রমশ পেছিয়ে পড়ছে এবং সক্রিয় কর্মীরা হয় বসে যাচ্ছেন নয় অন্যদলে চলে যাচ্ছেন। তিনি বিহারের নির্বাচনী প্রচারে এসেছেন, অধিকার যাত্রায় অংশ নিয়েছেন, কিন্তু নিচু তলার কর্মী ও সংগঠকদের সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি অনুযায়ী রণকৌশল স্থির করেননি, বিপরীতে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিরুদ্দেশ হয়ে বিদেশে চলে গেছেন তাঁর নিয়মিত ও ঘন ঘন বিদেশ যাত্রার অংশ হিসাবে। নির্বাচনী ধাক্কায় যখন কংগ্রেস ও বিরোধী জোট দিশেহারা, দিল্লি ও শ্রীনগরে ভয়ানক বিস্ফোরণ তখন তিনি অনুপস্থিত ও নিসচুপ।
(৬) এন ডি এ বনাম মহাগঠবন্ধনঃ এন ডি এ জোটের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও নেতৃত্ব সামলে নিয়েছেন এবং বিহারে জয়কে পাখির চোখ করে বিশেষ করে বিজেপি দীর্ঘসময় ধরে সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়েছে। বিপরীতে বিরোধী জোট মহাগাঠবন্ধন ছিল প্রথম থেকেই ছন্নছাড়া এবং কার্যত জোট প্রধান তেজস্বীর নিজে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কার্যকলাপ। এই হরেকরেকম্বা জোট একটি পর্যায়ে প্রচারে পাল্লা দিলেও ঠিক নির্বাচনের আগের সময়টা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং আসন ভাগাভাগি নিয়ে চলতে থাকে কদর্য যুদ্ধ। নির্বাচনে কয়েকটি আসনে শরিকরা একের বিরুদ্ধে অন্যজন লড়াই করেন। সি পি আই এম নেতা ও বিধায়ক অজিত সরকারকে হত্যাকারী মাফিয়া ডন পাপ্পু যাদব এবং সি পি আই এম এল (লিবারেশন) এর বহু কর্মী ও নেতা চন্দ্রশেখর প্রসাদ কে হত্যাকারী কুখ্যাত মাফিয়া ডন সাহাবুদ্দিনের ছেলে ওসামাকে এন ডি এ – র প্রার্থী করা মানুষ ভাল চোখে নেয়নি। বিপরীতে মোকামার আরেক বাহুবলীকে খুনে অভিযুক্ত বাহুবলী প্রার্থী অনন্ত সিংহকে ভোটের মুখে দ্রুত গ্রেফতার নীতিশ প্রশাসনের দক্ষতা হিসাবে দেখানো হয়েছে।
(৭) হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামভীতিঃ আর এস এস ও তার শাখা সংগঠনগুলির এবং কেন্দ্রের ও উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারগুলির রাম মন্দির গঠন সহ ধারাবাহিক হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপ বিহারের হিন্দু ভোটারদের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। এর সঙ্গে প্রভাব ফেলেছে সীমাঞ্চলে বাংলাদেশী মুসলমানদের অনুপ্রবেশ, পাহেলগাঁওতে বেছে বেছে হিন্দু হত্যা ও ‘অপারেশন সিঁদুর’ এর প্রচার এবং দিল্লি সহ দেশ বিদেশে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের ভয়ঙ্কর কার্যকলাপ নিয়ে প্রচার।
(৮) সঙ্ঘ পরিবার এবং সমাজবাদীদের যৌথ সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং: কুরমি, কেওরি, মাল্লা, পাসোয়ান, মুশাহার প্রমুখ পশ্চাদপদ, প্রবল পশ্চাদপদ, দলিত, মহাদলিত ভোট ব্যাঙ্কগুলির জন্য ছিল নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। চিরাগ পাসোয়ানের এল জে পি (আর ভি), জিতেন রাম মাঝির এইচ এ এম, উপেন্দ্র কুশোওহার আর এস এইচ টি এল কে এম, এন ডি এ – র ঝুলি ভরিয়েও দিয়েছে।
(৯) নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের মাধ্যমে সংগঠিত ব্যাপক প্রচারঃ বিজেপি অর্থ, বাহুবল এবং প্রশাসনিক ক্ষমতায় সমস্ত গণ মাধ্যমকে দখল করে নিয়েছে এবং তাদের মাধ্যমে নিরন্তর প্রচার চালিয়ে নিজেদের বক্তব্য মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দিচ্ছে এবং জনমত নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসছে। বিহার নির্বাচনেও তার অন্যথা হয়নি। প্রচারের সময় থেকে, ভোটদানের সময়, এক্সিট পোল, গণনার শুরু থেকেই গদি মিডিয়া বিজেপি এবং এন ডি এ কে এগিয়ে রেখে জনমানসে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করেছে।
(১০) বিপুল অর্থ ব্যয়ঃ অত্যন্ত ধনবান দল বিজেপি বিহার নির্বাচনে কিরকম অর্থ খরচ করেছে শুধুমাত্র ভাড়া করা ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার এর সংখ্যা এবং সেইখাতে খরচ দেখলেই বোঝা যাবে।
(১১) ‘এক্স’ ফ্যাক্টর অথবা প্রাতিষ্ঠানিক কারচুপিঃ অনেকদিন ধরে বিরোধীরা শাসক বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনকে কাজে লাগিয়ে ভোটে কারচুপি করে বিজেপিকে জিতিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করে আসছেন। বিগত লোকসভা ভোট এবং মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনে এই নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। যেরকম প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এস আই আর পরবর্তী বিহারের বৈধ ভোট ৭.৪২ কোটি। ভোট দিয়েছেন ৬৬.৯১% ভোটার। আবার এই নির্বাচন কমিশনই জানাচ্ছে বিহারে পোস্টাল ব্যালট ও ইডিসি বাদেই ভোট পড়েছে ৭ কোটি ৪৫ লক্ষ ২৬ হাজার ৮৫৮। তাহলে অমিত শাহ , জ্ঞানেশ কুমার দের আমন্ত্রণে ব্রাজিলের মডেলের মত প্রায় দু কোটি ভোটার কি অলক্ষ্যে ডিজিটাল ভোট দিয়ে গেলেন? ফলাফল ঘোষণার সন্ধ্যায় বর্তমানে আদানি নিয়ন্ত্রিত এন ডি টিভির এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হলে ‘ভারত জোড়ো’ কর্মসূচির প্রধান যোগেন্দ্র যাদব জানান বিহার নির্বাচনে জেতার ক্ষেত্রে এন ডি এ এগিয়ে ছিল, কিন্তু এই যে ফলাফল এর মধ্যে অন্য কিছু বিষয় আছে।
নরেন্দ্র মোদীর আগ্রাসী ভাষণঃ বিহার নির্বাচনের ফলাফলের রাতে বিজেপি সমর্থক দের আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিউ দিল্লির বিজেপি সদর দপ্তরে নরেন্দ্র মোদী কারচুপি, অর্থ ছড়ানো সহ সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে এক আগ্রাসী বক্তব্য রাখেন যেখানে তিনি মুসলিম লীগ ও মাওবাদীদের প্রশ্রয়দাতা হিসাবে কংগ্রেসকে আক্রমণ করেন, বিহার সহ অন্যত্র কংগ্রেসের ব্যর্থতা নিয়ে পরিহাস করেন এবং রাহুল গান্ধী কে চরম বিদ্রুপে ভরিয়ে দেন। তিনি সমর্থকদের বলেন যে এভাবেই বিজেপি এগিয়ে চলবে, কংগ্রেস ভেঙ্গে যাবে।
নরেন্দ্র মোদী ভারতকে ইজরায়েলের মত এক মিলিটারি দেশে পরিণত করতে চাইছেন যেখানে নিয়মিত বোমা বিস্ফোরণ, আতঙ্কবাদী কার্যকলাপ তার সঙ্গে পুলিশ মিলিটারির দমন পীড়ন চলতে থাকবে। কিন্তু ভারত ইজরায়েলের মত ছোট, অল্প জনসংখ্যার, ধনী ও উন্নত দেশ নয়। তাই এখানে পাকিস্তানকে ভয় দেখাতে গিয়ে একেকটি ১৪ হাজার কোটি টাকা মূল্যের যুদ্ধ বিমানকে হারাতে হবে, লাদাখ সীমান্তে নিয়ে যেতে গিয়ে দুটি ট্যাঙ্ক বরফের মধ্যে ডুবে যাবে, একের পর এক যুদ্ধজাহাজ ও অরডন্যান্স ফ্যাকটরি আগুন ও বিস্ফোরণে ধংস হবে, থানার মধ্যে বিস্ফোরণে থানাটি গুড়ো গুড়ো হয়ে বহু পুলিশ কর্মীর মৃত্যু হবে।
তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে মিথ্যাচারকে যেমন চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, তেমনই নোট বন্দী, গালওয়ানে চিনের জমি দখল, মণিপুরে গৃহযুদ্ধ, পাহেলগাঁও হত্যা, অপারেশন সিঁদুর, আমদাবাদ বিমান দুর্ঘটনা, দিল্লি ও শ্রীনগর বিস্ফোরণ নিয়ে কোন প্রশ্ন করা যাবেনা। দমনমূলক রাষ্ট্র ও বেনাগরিক সস্তা শ্রমিক; আম্বানি – আদানি নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্য এবং তার বিপন্ন ক্রেতা; হিন্দু জাতীয়তাবাদ বনাম মুসলমান অনুপ্রবেশকারী, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও দক্ষিণপন্থা বনাম বামপন্থা – এই বাইনারির মধ্যে বিনা প্রশ্নে ধর্মীয় ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রকে সমর্থন বেছে নিতে হবে নইলে রাষ্ট্রদ্রোহী আতঙ্কবাদী অথবা শহুরে নকশাল প্রতিপন্ন হতে হবে। যে কয়েকটি বেকার যুবক যুবতী সংসদে প্রতিবাদ করেছিল তাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানিনা। আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অশীতিপর মানবতাবাদী ফাদার স্ট্যান কে হত্যা করা হল।
বামপন্থার সংকটঃ নিপীড়িত ও শোষিত দরিদ্র মানুষের স্বার্থে সংগ্রামকে জলাঞ্জলি দিয়ে সিপিআই ও সিপিআইএম আগেই তাদের গণভিত্তি হারিয়েছিল। ধারাবাহিক প্রচেষ্টা ও প্রচুর আত্মত্যাগের বিনিময়ে উচ্চবর্ণের সামন্তপ্রভুদের ও রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর ঘেরাও দমন প্রতিরোধ করে দলিত ভূমিহীন ক্ষেতমজুর এবং গরীব কৃষকদের জমি, মজুরি ও আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সি পি আই এম এল (লিবারেশন) মধ্য বিহারকে কেন্দ্র করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে এবং বিহারের অন্যত্র ও বিহারের বাইরে বিস্তৃতি লাভ করে। গণসংগ্রামের পাশাপাশি নির্বাচনী সংগ্রামেও সাফল্য লাভ করে। কিন্তু এই নির্বাচনে তার বিপর্যয় এবং ভোজপুর, আরা, সিওয়ান প্রভৃতি মূল কাজের জায়গায় একটিও আসন না পাওয়ার কারণ তাঁদের গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচনে হারজিত আছে, কিন্তু দেখতে হবে দল গণ ও শ্রেণী আন্দোলন বিমুখ সংসদীয় নির্বাচনসর্বস্ব হয়ে যাচ্ছে কিনা? বিজেপি বিরোধী দলগুলির মোরচার প্রয়োজন আছে এবং তাতে অংশও নিতে হবে। কিন্তু কংগ্রেস ও আর জে ডির মত প্রতিক্রিয়াশীল, জনবিরোধী, সামন্ত – পারিবারিক এবং তৃণমূলের মত আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত, জনবিরোধী, লুম্পেন, পারিবারিক, স্বেচ্ছাচারী দলের সঙ্গে কোন মোরচায় গেলে সতর্ক থাকতে হবে। ১৯৯৮ তে বিনোদ মিশ্রর মৃত্যুর পর গত ২৭ বছরে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ছাড়া দলের কোন নেতা গড়ে উঠল না কেন, বিহারের নির্বাচনে বিহারের কোন মুখের বদলে সর্বত্র তাকেই কেন দেখা গেল, যিনি আদৌ নির্বাচনে অংশ নেননি, সেটিও ভাবার।
উপলব্ধি করতে হবে মোদী – শাহ এর এই বিজেপির সঙ্গে তাদের পথে তাদের মত করে নির্বাচন বা অন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক লড়াই এ পেরে ওঠা খুব কঠিন কারণ তারা সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে আদালত, আইনসভা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছু কুক্ষিগত করে নিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক লড়াই এর চাইতে প্রতিষ্ঠান গুলি বাঁচানোর লড়াই এখন প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোরচাকে এখন বেশি করে লড়তে হবে নির্বাচনী কারচুপি বন্ধ করাতে এবং নির্বাচন কমিশন কে শুদ্ধ করতে। আইনী, সংসদীয় ও গণ আন্দোলন। মোদী – শাহ দণ্ডকারণ্যে মাওবাদীদের বিধ্বস্ত করেছে, এবার চাইবে বিহার থেকে লিবারেশনকে ধ্বংস করতে। এরজন্য ষড়যন্ত্র, প্রলোভন, উৎকোচ, আক্রমণ এবং দমনের অভাব হবেনা। দল ও আন্দোলনকে বিহারের বুকে সংহত করার পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে দিতে হবে।
পশ্চিমের ঝঞ্ঝাকে পূবের মিঠালি হাওয়া পরাজিত করবেঃ নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি বিরোধীদের উচিত মানুষকে নিয়ে – নতুন সরকারের গঠনমূলক কাজের সহযোগিতা করা, কোন জনবিরোধী কাজ হলে বিরোধিতা করা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা হচ্ছে কিনা নজর রাখা এবং উন্নয়নের ও সমাজ পরিবর্তনের কাজে অংশ নেওয়া। প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপর পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চাপ সৃষ্টি করা হিংসা ও সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য। মানুষকে নিয়ে, সততা ও পরিশ্রমের সঙ্গে, সঠিক কর্মসূচি নিয়ে যদি ধারাবাহিক চেষ্টা চালানো যায় তাহলে সাফল্য আসবেই। বিহারের শোষিত নিপীড়িত দলিত দরিদ্র কৃষিজীবী মানুষের সংগ্রামকে উন্নীত করতে এবং সর্বভারতীয় স্তরে তুলে ধরতে যার অবদান অনস্বীকার্য তাঁর কথায় শেষ করিঃ
“ … The outcome of this battle between the two winds has not yet been decided, and the final sequences of what may prove to be a most fascinating epic – drama in the history of India have not unfolded themselves either. Still, when the unceremonious death of the poorest among the peasants in the unknown, unheard of, dingy, mud – tracked, tiny country town Arwal begins to shape the political crisis of powers that be in Bihar, one can safely proclaim that the heroes have finally arrived on the stage. … “ – Vinod Mishra, ‘Report From The Flaming Fields of Bihar’, 1986.
১৫.১১.২০২৫









