সূর্যাস্তের আগে রবীন্দ্রনাথ
কবির জীবনস্মৃতিতে আমরা পাই “শরীর এত বিশ্রী রকমের ভালো ছিল যে, ইস্কুল পালাবার ঝোঁক যখন হয়রান করে দিত তখনও শরীরে কোনোরকম জুলুমের জোরেও ব্যামো ঘটাতে পারতুম না। জুতো জলে ভিজিয়ে বেড়ালুম সারাদিন, সর্দি হল না। কার্তিক মাসে খোলা ছাদে শুয়েছি, চুল জামা গেছে ভিজে, গলার মধ্যে একটু খুসখুসানি কাশিরও সাড়া পাওয়া যায় নি।
জ্বরে ভোগা কাকে বলে মনে পড়ে না। ম্যালেরিয়া বলে শব্দটা শোনাই ছিল না। গায়ে ফোড়াকাটা ছুরির আঁচড় পড়ে নি কোনোদিন। হাম বা জলবসন্ত কাকে বলে আজ পর্যন্ত জানি নে। শরীরটা ছিল একগুঁয়ে রকমের ভালো।”
এই রকম অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী মানুষটি! গোলমালটা বাধলো পঁয়ষট্টি পেরিয়ে। সেটা ১৯২৬ সালের অক্টোবরে!
কবি সেবার হাঙ্গেরিতে, বুদাপেস্টে,সঙ্গে প্রশান্ত ও রানি মহলানবীশ। কবি তখন খ্যাতির মধ্যগগনে।
চেকোস্লোভাকিয়া এবং তারপর হাঙ্গেরি।
বুদাপেস্টে কবিসম্মেলন এবং আনুষঙ্গিক ভ্রমণের ধকলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন প্রৌঢ় কবি। তাঁকে নিয়ে আসা হলো, বালাটনফুরেডের স্টেট হার্ট হাসপাতালে, ভর্তি হলেন ডাঃ স্মিডের তত্বাবধানে, রুম নাম্বার ২২০তে!
তিন সপ্তাহ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠলেন কবি।
সুস্থ হয়ে উঠলেন বটে, কিন্তু ,শেষের সেই শুরু!
এর আগের দশকে লন্ডনে, পাইলসের জন্যে অস্ত্রোপচার হয়েছিল, কিন্তু তা ছাড়া কবির শরীর ছিল তার ভাষ্য” বিশ্রী, একগুঁয়ে রকমের ভালো”!
হাঙ্গেরির সেই হৃদয়ঘটিত অসুস্থতাটাই কবির জীবনের প্রথম বড় অসুখ!
এর পর ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে আমাদের যেতে হবে ১৯৪০সালে, শান্তিনিকেতন থেকে সে বছরের ১৯শে সেপ্টেম্বর পূত্রবধূ প্রতিমা দেবীর কাছে গিয়েছিলেন দার্জিলিং পাহাড়ের কালিম্পং-এ। সেখানেই ২৬ তারিখ রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি। দার্জিলিঙের সাহেব সিভিল সার্জেন জানালেন অপারেশন করতে হবে।
একটু সুস্থ হওয়ার পরে পাহাড় থেকে নামিয়ে কবিকে কলকাতায় আনা হয়। তারপরে তিনি ফিরে যান শান্তিনিকেতনে।
সেই ১৯১৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা করছিলেন যে কিংবদন্তী ডাক্তার নীলরতন সরকার, তিনি কখনই কবির অপারেশন করানোর পক্ষে ছিলেন না। কবি নিজেও চাননি অস্ত্রোপচার করাতে।
ডা. সরকার যখন স্ত্রী বিয়োগের পরে গিরিডিতে চলে গেছেন, সেই সময়ে আরেক বিখ্যাত চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায় ও আরও ক’জন চিকিৎসক— ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দুভূষণ বসু— শান্তিনিকেতনে এলেন রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার জন্য।
বিধানচন্দ্র রায় মত দিলেন , প্রস্টেটটা বড় হয়ে গিয়ে ঝামেলা করছে। শরীরে ইউরিয়া বেডে যাচ্ছে। সুপ্রাপিউবিক সিস্টোস্টমি, অর্থাৎ ইউরিনারি সিস্টেমের বাইপাস করে দিলেই ইউরিনটা আর আটকাবে না। কবিও সুস্থ হয়ে উঠবেন।
২৪ জুলাই ১৯৪১।
অন্তরঙ্গ সেবকরা খুবই সাবধানে বিশেষ ভাবে তৈরি একটি স্ট্রেচারে করে কবিকে দোতলা থেকে নীচে নামিয়ে আনলেন। উদয়ন বাড়ির নীচের বারান্দায় একটি আরামকেদারায় প্রায় অর্ধশায়িত ভাবে বসানো হলো। কয়েকদিন আগে কবির চুল দাড়ি ছোট করে কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। চোখে নীল চশমা, সমস্ত শরীরে ক্লান্তির সুস্পষ্ট ছাপ।
উদয়ন-এর সামনে এসে দাঁড়াল আশ্রমের মোটরগাড়ি। কবিকে যাতে সরাসরি স্ট্রেচারে করে গাড়িতে তুলে দেওয়া যায়। তোলা হলো গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিয়ে।
আশ্রম থেকে বোলপুর আসার রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ, খানাখন্দে ভর্তি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ চিকিৎসার জন্য কলকাতা যাবেন, খবর পেয়ে বীরভূমের তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড কর্তৃপক্ষ রাতারাতি রাস্তা সংস্কারও করেছিলেন যতটা সম্ভব।
রাস্তার দুপাশে শান্তিনিকেতন, বোলপুর, শ্রীনিকেতন, ভুবনডাঙা, সুরুল, মহিদাপুর, গোয়ালপাড়া, পারুলডাঙা, আদিত্যপুর-সহ সমস্ত এলাকার অজস্র মানুষজন, ছাত্রছাত্রী, কর্মী, শিক্ষক, আশ্রমিক।
ন’ই শ্রাবণ। জুলাই মাসের পঁচিশ তারিখ।।
সেই শেষ যাত্রা, কবি আর কোনোদিন শান্তিনিকেতন ফেরেন নি।
তৎকালীন পূর্বরেলের কর্তা নিবারণচন্দ্র ঘোষ তার নিজের সেলুনখানা কবিকে দিয়ে দিয়েছেন। হাওড়া স্টেশনে জনস্রোত এড়াতে শেষমুহূর্তে প্ল্যাটফর্ম বদল করে অন্য প্ল্যাটফর্মে ঢোকে সেদিনের পাকুড় প্যাসেঞ্জার। ট্রেনজার্নি করতে করতেই কিন্তু কবি আবার বেহুঁশ হয়ে গেছিলেন।
কখন যে জোড়াসাঁকোর বাডিতে ঢুকলেন তা তিনি টেরও পেলেন না।
পরেরদিনই আবার সজ্ঞানে।
কোথায় আমার অপারেশান হবে? কবি জানতে চাইলেন।
হসপিটালে অপারেশান হবে না। বাডিরই একটা বারান্দাকে একদম স্টেরিলাইজ করা হয়েছে। সেখানেই হবে।
ডাক্তার নীলরতন সরকার প্রায় রোজই আসেন। প্রথিতযশা ডাক্তারদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যিনি অপারেশানের বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল অপারেশানের ফল খারাপও হতে পারে। অথচ আর কোন বিকল্প পথও তিনি দেখাতে পারেন নি।
ব্লাড আর ইউরিন টেস্ট প্রায় রোজই হচ্ছে। নিউট্রোফিল কাউন্টটা একটু বেশী। ইউরিনে সংক্রমণও বড্ড।
ডাক্তার ললিত ব্যানার্জি, নামকরা সার্জেন লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে অপারেশন করলেন।
দুতিন দিন সাবধানে থাকতে হবে। কারণ ইনফেকশান যা হবার তা সাধারণত তিন দিনের মধ্যেই হয়।
হল ঠিক উল্টো।
অসুস্থতা বাড়ল তিনদিন পর থেকে। ডাক্তারেরা প্রথমে বেশ খুসি খুসি ছিলেন। গুরুদেব বোধহয় এ যাত্রাও পার করে গেলেন। অসম্ভব জীবনীশক্তি। এর আগে একবার মংপুতে ভয়ংকর সেলুলাইটিসে (তখন বলা হতো ইরিসেপেলাস) রোগে টানা দিন দুয়েক অজ্ঞান ছিলেন। সবাইকে অবাক করে সেবার কিন্তু উঠে বসেছিলেন।
অপারেশনের তিনদিন পর থেকে জ্বর আবার ফিরে এল। কবি প্রায়ই বেহুঁশ হয়ে যেতে থাকলেন। যখনই জ্ঞান আসে তখন খালি বলেন – জ্বালা, গায়ে বড্ড জ্বালা। ইউরিনের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকল, কিন্তু পাস্ সেল অনেক বেড়ে গেল।
সকলেই যখন বুঝতে পারছে কী ঘটতে চলেছে, তখনই গিরিডি থেকে খবর দিয়ে আনানো হয় কবির সুহৃদ ও বিশিষ্ট চিকিৎসক নীলরতন সরকারকে। তিনি এসে নাড়ি দেখলেন, পরম মমতায় কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপরে উঠে দাঁড়ালেন। হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে ডা. সরকারের দু’চোখে ছিল জল।
বাইশে শ্রাবণ । বৃহস্পতিবার । আগস্ট মাসের সাত তারিখ।
কবির রেডিয়াল পালস প্রায় অন্তর্হিত।
বেলা ন’টায় দেওয়া হল অক্সিজেন।
শেষবারের মতো দেখে গেলেন বিধান রায় ও ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
অমিতা ঠাকুর প্রার্থনা করছেন – শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্। কবির জীবনের প্রিয় বীজমন্ত্র।
প্রার্থনা করছেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। প্রার্থনা করছেন নির্মলকুমারী মহলানবীশ। তমসো মা জ্যোতির্গময়।
কবির পদতলে রাখা হল চাঁপাফুল। রবীন্দ্রনাথের বড় প্রিয়।
চিনা অধ্যাপক তান ইয়ুন শান নিজস্ব ভাষায় প্রেয়ার করছেন।
ধীরে ধীরে কমে এল পায়ের উষ্ণতা, তারপরে একসময়ে থেমে গেল হৃদয়ের স্পন্দন।
খুলে দেওয়া হলো,অক্সিজেনের নল।
ঘড়িতে তখন বাজে ঠিক ১২টা ১০ মিনিট।
বেলা দ্বিপ্রহরে সূর্যাস্ত বোধ হয় সেই প্রথম!
তথ্যসূত্রঃ
১.জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২.রবীন্দ্রনাথ, অমিতাভ ভট্টশালী বিবিসি বাংলা
৩.হাঙ্গেরির হৃদয়হৃদ বালাটন ও রবীন্দ্রনাথ, কৌশিক লাহিড়ী
৪. শেষের কবিতা, সুমিত চট্টোপাধ্যায়
৫. ডাক্তারবাবু রবীন্দ্রনাথ, শ্যামল চক্রবর্তী
৬. মংপুতে রবীন্দ্রনাথ, মৈত্রেয়ী দেবী
৭. স্বর্গের কাছাকাছি, মৈত্রেয়ী দেবী
৮. গুরুদেব, রানী চন্দ