অবশেষে করোনা এল। রবিবার জনতা কার্ফু এবং ঘন্টা, থালা বাজিয়ে উৎসাহ জোগানো হল সমস্ত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের। রবিবারই ঘোষণা হল মেডিকাল কলেজ কলকাতাকে বানানো হবে করোনা হাসপাতাল। সোমবার থেকে লকডাউন জারি হল। স্তব্ধ হল স্বাভাবিক জীবনযাপন, রাস্তাঘাট সবকিছুই। পশ্চিমবঙ্গে এখনো অবধি আক্রান্তের সংখ্যা ১০। জরুরি ভিত্তিতে মোকাবিলায় নামল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। করোনা হাসপাতাল ঘোষণা থেকে শুরু করে, পুলিশ দিয়ে লকডাউন পালন, বাজারে ঘুরে ঘুরে সারপ্রাইজ ভিজিট, দাগ কেটে লক্ষণরেখা শেখানো– বেজায় নিন্দুকেরাও মুখ্যমন্ত্রীর জয়জয়কারে সামিল। কিন্তু বাস্তবে মেডিকাল কলেজকে করোনা হাসপাতাল বানানোর সিদ্ধান্ত ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত? যুদ্ধের প্রস্তুতির কি হাল, সেই নিয়ে কিছু কথা।
অবস্থা দেখে নেওয়ার আগে কিছু কথা প্রয়োজনীয়। রাস্তায় লকডাউন যেমন গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি একটি কাজ, এর থেকেও ঢের বেশী জরুরী যুদ্ধে করতে যাঁরা নামছেন তাঁদের প্রতিরক্ষা । অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স,স্বাস্থ্যকর্মীদের যথেষ্ট পরিমাণ সুরক্ষা। বেশি দরকারি বলছি তার দুটি কারণ। প্রথমত– একজন ডাক্তার, নার্স কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হওয়া মানে যুদ্ধ থেকে একজনের সরে যাওয়া, তার মানে প্রায় ৪০-৫০ জন রোগীর ভাল হওয়ার সম্ভাবনা পিছিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়্ত– যে ডাক্তার, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হচ্ছেন তিনি আরো পঞ্চাশজন রোগী, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী , সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসছেন – উপসর্গ অর্থাৎ সিম্পটম প্রকাশ পাবার আগেই। সেখানে বিপদ কমার বদলে বাড়বে গুণোত্তর প্রগতিতে। উদাহরণ – ইতালি কিংবা একটু প্রথম দিকের উহান।
এবার এখানে ঢাল তরোয়াল কি কি লাগে? নিদেনপক্ষে দুটি জিনিস বটেই – পি পি ই(Personal Protective Equipments) এবং এন ৯৫ মাস্ক। এ বাদ দিয়ে স্টেরিলিয়াম, গ্লাভস ইত্যাদি তো বটেই। এবার দেখে নিই আমাদের ব্যবস্থাপনা কতদূর.
এখনো অবধি করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার সরকারি ব্যবস্থাপনা বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে। এখানে কর্মরত ইন্টার্নদের মুখ থেকেই শোনা যাচ্ছে এমার্জেন্সিতে পি পি ই দেওয়া হচ্ছে না। কারণ সাপ্লাই কম। একই অবস্থা এন ৯৫ মাস্কের ক্ষেত্রেও। করোনা সংক্রমিত রোগী এলে তার প্রাথমিক রিপোর্টিং হবে এমার্জেন্সিতেই। এবং একদম ফ্রন্টলাইনেই কোন প্রোটেকশন নেই। অর্থাৎ নামছি ঢাল তরোয়াল ছাড়াই। অবশ্য একদম নেই না। রেনকোট এবং সার্জিকাল মাস্ক। তাও আবার ছেঁড়া। পিপিই এবং এন ৯৫ র কাছে চুনোপুঁটিই যা। বস্তুতই নিধিরাম সর্দার সেজে ডিউটি করা। পি পি ই এবং মাস্ক পাওয়া যাবে একমাত্র আইসোলেশন ওয়ার্ডে ডিউটি থাকলে। অর্থাৎ হাসপাতালে ঢোকা থেকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে যাওয়ার মাঝে সংক্রমণ আটকানোর কোন ব্যবস্থাই নেই। সুপারের কাছে এই বিষয়ে বললে উত্তর পাওয়া গেছে– “কুকুরদের তো মাস্ক লাগছে না। তোমাদের লাগবে কেন?” , “পুলিশ দিয়ে ডিউটি করাবো”। ঘন্টা বাজিয়ে ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্যকর্মীদের দেশজোড়া উৎসাহদানের পর এই ব্যবহার খানিক গুরুপাকই বটে …।
সেই ঘন্টার সাথে সাথে আবার শুনলাম মেডিকাল কলেজ কলকাতা হয়ে গেল করোনা হাসপাতাল। হাততালিতে প্রশংসায় পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে জয়জয়কার মুখ্যমন্ত্রীর। অবশ্যই জরুরি সিদ্ধান্ত। কিন্তু এর আফটার-এফেক্টগুলো একটু দেখি।
১। রবিবার এবং সোমবারের মধ্যে খালি করে দেওয়া হল মেডিকেল কলেজ কলকাতা। রবিবার জনতা কার্ফু এবং সোমবার থেকে লকডাউন। এতগুলি পেশেন্ট কিভাবে বাড়ি ফিরবেন সে নিয়ে কোন আলোচনা হল না। অন্যদিকে বাস, ট্রাম, রেল, গাড়ি সব বন্ধ।
২। ১৮১ বছরের পুরোনো একটি হাসপাতাল। নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি মেডিসিন আউটডোর ৯ টা থেকে হাত চালিয়ে পেশেন্ট দেখলেও ৩ টে বাজত শেষ করতে। অবশ্যই প্রত্যেক পেশেন্টের পিছনে ৬-৭ মিনিটের বেশী দিতে পারতাম না। গড়ে ডাক্তারপিছু হল ৬০। ইউনিটের সব ডাক্তার মিলিয়ে রোগীর সংখ্যাটি ৫০০- র কাছাকাছি। সমস্ত ডিপার্টমেণ্ট মিলিয়ে দিনে অন্তত পাঁচ-ছ হাজার তো হবেই। তাঁদের মাসিক ওষুধ, রেগুলার চেকআপ এসব নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত হল না।
৩। কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির রেজিমেনে থাকা রোগী, থ্যালাসেমিয়ায় ব্লাড নিতে আসা বাচ্চা– হঠাৎ পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেল। ব্লাড না চালানো গেলে বা রেজিমেন অনুযায়ী কেমোথেরাপি না চালালে তার খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। এমনিতেও করোনার আতঙ্কে রক্ত মিলছে না। নাম কা ওয়াস্তে পুরোটাই অন্য সরকারি হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হবে বলে মিটিয়ে দেওয়া হল।
৪। ধরে নেওয়া যাক ভর্তি রোগীর ৫০ শতাংশ কোল্ড কেস। যদিও বাস্তব অন্য কথা বলে। তাও ধরে নিলাম। অর্থাৎ যাঁদের ক্ষেত্রে বাড়িতে বা পরবর্তীতে চিকিৎসায় সমস্যা নেই। বাকি যাঁদের ট্রিটমেন্ট বেশ জরুরি ছিল? কথা ছিল ট্রান্সফার করা হবে। বাস্তবে হয়েছে পাঁচ শতাংশের ও কম। দরকার ছিল অনেক। আর ট্রান্সফার করলেও কোথায়??? বাকি সরকারি হাসপাতালগুলি তো আগে থেকেই ভর্তি …
এগুলি গেল ইমিডিয়েট আফটার এফেক্ট। লংটার্মের মধ্যে এখনো জানিনা, যাঁরা নিত্য ডায়ালিসিস নিতেন, যাঁদের ব্লাড লাগত, যাঁদের কেমোথেরাপি চলছিল তাঁরা হাসপাতাল অবধি এসেই বা পৌঁছবেন কি করে?
তাও ধরলাম বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকার কষ্টে করোনা হাসপাতাল হল মেডিকাল কলেজ কলকাতা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকের একটি ফ্লোরে শুরু হবে আইসোলেশন ওয়ার্ডের কাজ। ঘোষণা মতো আগামী শনিবারই করোনা হাসপাতাল হিসেবে দায়িত্ব নেবার কথা।
আইসোলেশন ওয়ার্ড কিন্তু সাধারণ ওয়ার্ডের মতো নয়। জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হয় এই ওয়ার্ডে। আইসোলেশন ওয়ার্ডে যেমন সেন্ট্রাল এসি কোনমতেই থাকা চলবে না। কারণ সংক্রমণের চান্স বেশী। পৃথক এসি হলেও তাতে যেন লাগানো থাকে ‘হেপা ফিল্টার’। আর দরকার নেগেটিভ প্রেশার। এদিকে সুপারস্পেশ্যালটি ব্লকটি সেন্ট্রালি এসি। অর্থাৎ আইসোলেশন ওয়ার্ড হওয়া প্রায় অসম্ভব। পৃথক এসি, হেপা ফিল্টার – এসবের ব্যবস্থা করতে প্রায় দেড় মাস। একটি ফ্লোরের জন্য। বাকি ফ্লোরগুলিতে আইসোলেশন কেন সাধারণ ওয়ার্ডের মতোও ব্যবস্থাপনা নেই। অথচ শনিবার থেকেই এই ব্লকেই শুরু হচ্ছে করোনার চিকিৎসা। এটি রোগী, কর্মরত প্রত্যেকটি মানুষে পক্ষে ঠিক কতটা স্বাস্থ্যকর তা নিশ্চয়ই আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। এমনকি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার মতোও উপযোগী পরিবেশও নেই।
এরপর যাতায়াতের ব্যবস্থা। স্বাস্থ্যকর্মীদের হাসপাতালে পৌঁছনোর জন্য সমস্ত কলকাতা জুড়ে চলছে পাঁচটি বাসরুট। কাউকে সেই বাস ধরার জন্য হাঁটতে হচ্ছে আধঘন্টা কিংবা তারও বেশী। অন্যথা উপায় কি? বাস ট্রাম ট্যাক্সি ট্রেন তো বন্ধ। আর ওলা উবের? পিকআপ হাসপাতাল কিংবা ডেস্টিনেশন হাসপাতাল শুনলে ওখানেই ক্যানসেল। ডিউটির পর আমার সহকর্মী রাতের বেলা বাড়ি ফিরে শোনে বাড়িওয়ালা ঘর ছাড়তে বলেছে। কারণ হাসপাতালে কাজ করে …
থাকার ব্যবস্থা? রবিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাসপাতালে ১২০ জন ইন্টার্নের থাকার ব্যবস্থা করার কথা। এ বাদ দিয়েও আছেন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেনী, সিনিয়ার ডাক্তাররা, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী সবাই। হিসেবমতো যাঁরা ডিউটিতে থাকবেন প্রত্যেককেই ১৪ দিন কোয়্যারান্টাইনে রাখার কথা। সেখানে ৩০ জন ইন্টার্ন বাদ দিয়ে আর কারুর থাকার ব্যবস্থা নেই। একজন ইন্টার্নের থেকেই জানা গেল ব্যবস্থা করা হয়েছে কলকাতার বিভিন্ন হোটেলে! ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্সে যাঁরা থাকবেন তাঁদের সংক্রমিত হবার চান্স মারাত্মক। তাঁদেরকে হাসপাতালের বাইরে, কোনরকম পরিকাঠামো ছাড়া, জনবহুল জায়গায় এভাবে রাখার সিদ্ধান্ত যেচে করোনাকে নিমন্ত্রণ করে আনার চেয়ে কম কি করে বলব ?? যাঁরা এখনো নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রত্যেকদিন ডিউটি করছেন, গোটা সমাজের হয়ে লড়তে নেমেছেন, রাত আটটার ভাষণে যাঁদের প্রশংসা, যাঁদের উৎসাহ জোগাতে ঘণ্টা থালা বাজাচ্ছে জনতা। আর তাঁদেরই বাড়ি ফিরে শুনতে হচ্ছে ঘর ছেড়ে দেবার কথা। কারণ তাঁরা হাসপাতালে ডিউটি করছেন…
জরুরি সিদ্ধান্ত, প্রয়োজনের নিরিখে অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু তার বাস্তবতা, আফটারএফেক্ট না ভেবে নেওয়া এই সিদ্ধান্তে তুঘলকিপনাই বেশী দেখাচ্ছে নাকি??
(মেডিকাল কলেজের জুনিয়ার ডাক্তারদের কয়েকজনের যৌথ রচনা এটি।)
বুঝতে পারছি আমরা আগ্নেয় গিরির ওপর বসে আছি। আর আপনারা করোনার বলির পাঠা।
পরিস্থিতি একটা হিমশৈল, আর আপনারা টাইটানিক এর যাত্রী :