এমনিতে রোগী দেখার সময়ে আমি বিশেষ ফোন ধরি না। কিন্তু পীযূষদা যখনই ফোন করুক তখনই ধরি। রাত সাড়ে দশটায় পীযূষদা ফোন করল।
একজন রেনাল কলিকের রোগী ব্যথায় ছটফট করছিল। আমি সাহস যোগাচ্ছিলাম, ‘দাঁড়াও, ইনজেকশনটা দিয়ে দিলেই দশ মিনিটের মধ্যে ব্যথা কমে যাবে।’
সাবধানে ভোভেরানের অ্যাম্পুল ভাঙার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় ফোন বেজে উঠল। কাটতে গিয়ে দেখলাম ডাঃ পীযূষ কান্তি পাল।
ফোন ধরতেই পীযূষদা বলল, ‘কিরে ঐন্দ্রিল, কি করছিস?’
বললাম, ‘কি আর করব, এখনও খুপরিতে। রোগী দেখছি।’
‘এত রাতেও মহামারীর মধ্যে রোগী দেখছিস! এর জন্য লোকজন ডাক্তারদের রক্তচোষা বলে। যা যা, এবার বাড়ি যা। এত পয়সা নিয়ে কি করবি? সেই তো করোনায় মরে যাবি।’
বললাম, ‘পীযূষদা, এক মিনিট ধরো। একটা ইনজেকশন দিয়ে দি।’
ইনজেকশনটা ঠুকে আবার ফোন ধরলাম। ‘বলো, কান্দি আর খড়গ্রামের কি খবর?’
পীযূষদা বলল, ‘ভালো খবর। খড়গ্রামে তো অনেক বাড়িতেই লোকজন বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে। তাঁরা ঘুরছে, ফিরছে। বাচ্চা কাঁদলেই আমার কাছে দেখাতে আনছে।’
আমি বললাম, ‘কি হচ্ছে বলতো। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে দাবানলের মতো করোনা ছড়িয়ে পড়ার কথা। ছড়াচ্ছে না কেন। কোনো নিরীহ করোনা ভাইরাস কি ইতিমধ্যেই আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে নোবেল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ক্রস ইমিউনিটি তৈরি করেছে?’
‘এটাও তো হতে পারে, প্রথম অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই সুস্থ সবল মানুষেরা যারা দিনের বেশির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকে তারা আক্রান্ত হবে। এবার তাদের ইমিউনিটি জোরদার হওয়ায় বেশিরভাগেরই সাধারণ ভাইরাল জ্বর ছাড়া কিছু হবে না। আই সি এম আর এখনও যারা বিদেশ থেকে এসেছে এবং যারা সরাসরি বিদেশী ব্যক্তির সাথে কন্টাক্টে আসছে তাদেরই রক্ত পরীক্ষা করছে। যার ফলে এক বিরাট অংশ আন ডায়াগনোজড থেকে যাচ্ছে। এরপর যখন এই সব সুস্থ সবল মানুষেরা বাড়িতে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের মধ্যে রোগ ছড়াতে শুরু করবে তখনই এর ভয়াবহতা বোঝা যাবে।’
‘ঘটনা যাই হোক, আর দিন দশেকের মধ্যেই বোঝা যাবে করোনার দাঁত আর নখে কত ধার।’
‘হ্যাঁ, বড়জোর দু-সপ্তাহ। এই দু-সপ্তাহেই আমরা বুঝে যাব, এযাত্রা আমরা বেঁচে গেলাম কিনা। তুই না রোগী দেখছিলিস। এখনও গল্প চালিয়ে যাচ্ছিস। এরপর রোগী ক্যালাবে।’
রোগীর দিকে তাকালাম। নিরীহ চেহারা। আমার সাথে গায়ের জোরে পারবেন না। তিনি ঘাড় নেড়ে জানালেন, ‘ব্যথা একটু কমেছে। আপনি কথা বলে নিন।’
আমি পীযূষদাকে বললাম, ‘ইনজেকশন দিয়েছি। এখন দশ মিনিট পর্যবেক্ষণ।’
পীযূষদা বলল, ‘ভালো থাকিস, জ্যান্ত থাকিস। শুভ রাত্রি।’
ফোন রাখার পর রোগী ভদ্রলোক বললেন, ‘আচ্ছা ডাক্তারবাবু, কাল যে আকাশ থেকে প্লেনে করে করোনার অ্যান্টি ভাইরাস ছড়াবে, তাতে তো এই করোনা পুরোপুরি ল্যাজে গোবরে হবে?’
‘অ্যান্টি ভাইরাস? সেটা আবার কি?’
‘সেকি আপনি জানেন না। রবিবার জনতা কারফিউ এর দিনে প্রধানমন্ত্রী সকলকে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন। যাতে ওই অ্যান্টি ভাইরাস গায়ে লেগে জীবাণু মরে যায়।’
আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। যে যার মতো জনতা কারফিউকে ব্যাখ্যা করছে। অনেকেই দেখলাম একটা পোস্ট শেয়ার করেছেন, ১৪ ঘণ্টার জনতা কারফিউ করোনার ট্রান্সমিশন চেনকে ভেঙে ফেলবে। কারণ মানব দেহের বাইরে ভাইরাসের জীবন চক্র ১২ ঘণ্টার বেশি নয়। এসব অদ্ভুত মনগড়া তথ্য এনারা কোথা থেকে আমদানি করেন কে জানে?
নিজের বিচার বুদ্ধি বজায় রেখে কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক কি হওয়া যায় না? নিজেকে বড় সমর্থক প্রমাণের জন্য গো মূত্র খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে নিজের মুর্খামি ছাড়া আর কিছুই প্রমাণ হয় না।
তবে এখনও যে আশা বেঁচে আছে তার প্রধান কারণ ডাঃ চিরঞ্জিৎ বিশ্বাসের মতো যুবকেরা। বেচারা মালদা-মধ্যমগ্রাম প্রায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে চাকরি আর বাড়ি সামলাচ্ছে। তার মধ্যেই রাত জেগে লিখে ফেলেছে বাংলায় করোনা মহামারি প্রতিরোধের নানা পদ্ধতি নিয়ে চমৎকার একটি পুস্তিকা। গতকালই সেটা ছাপা হয়ে চলে এসেছে আমার কাছে। বেচারা চিরঞ্জিৎ নিজের সন্তানকে চোখে দেখেনি এখনও। ফোনে বলেছে, ‘দাদা, মঙ্গলবার একদিন ছুটি আছে। আমি নিজেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে বইটা বিতরণ করব। ডাক্তার যদি নিজের হাতে করে দেয়, লোকে নিশ্চয়ই পড়বে, কি বলুন?’
যাঁরা বিশ্বাস করেন গো মূত্র খেয়ে করোনা সারবে না তারা যোগাযোগ করুন আমার বা চিরঞ্জিতের সাথে। পুস্তিকাটি জেরক্স করে ছড়িয়ে দিন অন্যদের মধ্যেও।
সত্যি জানুন। কাউকে সমর্থন করা মানেই নিজের মস্তিষ্ক তার কাছে বন্ধক দেওয়া নয়। জনতা কারফিউ পালন করুন। কিন্তু ঘণ্টা, থালা বাজানোর দরকার নেই। যদি চিকিৎসকদের সম্মান জানাতে চান, ওনাদের সুরক্ষার দাবী তুলুন। সরকার থেকে প্রত্যেক চিকিৎসককে নিজেকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র দেওয়া হোক। চিকিৎসকেরও জীবনের দাম আছে।