ভেজাল ওষুধ, ক্ষতিকর ওষুধ, কম গুণমান সম্পন্ন (sub standard) ওষুধ.., এ সব তো Indian Pharmaceutical Industry র অনেক পুরোনো গল্প যে। Ranbaxy কে নিজের দোষ স্বীকার করে বিশাল অঙ্কের জরিমানা দিতে হয়েছে, Abbott ও Zydus কে তাদের ওষুধ ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটে গাম্বিয়ায় ৬৬ টি শিশুর মৃত্যু (সংখ্যাটা সম্ভবতঃ আরও অনেক বেশি, আর একটি হিসাবে ৭০৪ জন) ভারতীয় কোম্পানি Maiden Pharmaceutical থেকে প্রস্তুত cough syrup খেয়ে। একই অভিযোগ পাওয়া যায় উজবেকিস্তান থেকেও। গাম্বিয়ায় কোনো টেস্টিং ল্যাবরেটরি নেই, অন্য দেশ থেকে পরীক্ষা করে দেখা যায় Diethylene glycol ও Ethylene glycol এর মাত্রাছাড়া উপস্থিতি, যা কিডনির পক্ষে অবশ্যই ক্ষতিকর। প্রসঙ্গতঃ এই দুটি যৌগ industrial solvent ও anti freeze substance হিসাবে ব্যবহৃত হলেও sweetening agent হিসাবেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, যা একটা পরিমাণের বেশি হলে নিশ্চিতভাবেই বিপজ্জনক। শ্রীলঙ্কায় Indiana Ophthalmics এর তৈরি চোখের ড্রপ থেকে সংক্রমণের অভিযোগ উঠলে কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য হয়ে উদ্যোগী হতে হয়। একইভাবে ভিয়েতনাম সরকার অন্ততঃ ৩৯টি ভারতীয় ওষুধ কোম্পানীকে(যার মধ্যে Macleods, Cadila এর মতো কোম্পানীও আছে) ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করলে, ভারত সরকারকে damage control exercise এ সচেষ্ট হতে হয়। ঘানা, সেনেগাল, নাইজিরিয়া, মোজাম্বিক প্রভৃতি দেশগুলি থেকেও বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে বারে বারে।
২০১৪ সালে অ্যামেরিকা ও কানাডার কয়েকজন শিক্ষাবিদ একটি article এ তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দেখান যে ভারতীয় ওষুধ কোম্পানিগুলি আফ্রিকা ও অনুন্নত দেশগুলোকেই ‘টার্গেট’ করে, substandard medicine পাঠানোর জন্য, কারণ এই সব দেশগুলোর অনেক কটাতেই যথেষ্ট উন্নত drug testing laboratory নেই। যথারীতি, ভারতীয় সরকার এর তীব্র প্রতিবাদ করে ও আইনী পদক্ষেপের কথা বলে।
মুশকিল হলো, সরকার কখনো সেভাবে এই ঘটনাগুলোর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে নি, বা, করলেও তা প্রকাশ্যে আনে নি। অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তি ছিল, দেশে ঐ সব ব্র্যান্ডে তো সে রকম কোনো অসুবিধা দেখা যাচ্ছে না, তাহলে হয়তো transit বা দেশের বাইরে এই সব বেআইনি/ অনৈতিক কাজকর্ম হয়েছে। কিন্তু, পরবর্তী কালে সেই cough syrup কোম্পানিরই অন্য ব্র্যান্ডের ওষুধ খেয়ে বিপর্যয় ঘটে জম্মুতে ! ফলস্বরূপ আবার সেই damage control exercise..
আসলে, কোনো সরকারই চায় না, ভারতীয় Pharmaceutical Industries কে ঘাঁটাতে, নিশ্চয়ই কিছু না কিছু কারণ তো আছে।খুব পরিষ্কার অনৈতিক কাজগুলো দেখেও না দেখার ‘ভান’ করে চলেছে বহু বছর ধরে। এ ছাড়াও রয়েছে দুর্বল ‘রেগুলেটরি অথোরিটি’, কড়া নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা/অপারগতা, যথার্থ infrastructure তৈরি ও সঠিক কাঁচামাল ও প্রযুক্তি ব্যবহারে চূড়ান্ত অনীহা(যেহেতু সেগুলো তুলনামূলকভাবে ব্যয়সাপেক্ষ) ও সব সময়ে minimum খরচে maximum লাভের প্রচেষ্টা !!
এগুলো হলো মূলতঃ গুণমান বজায়(quality control) এর ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। এর উপরে রয়েছে spurious বা fake medicine..,মানে কোনো ওষুধই নেই, পুরোটাই ফাঁকি ! এগুলোও পাওয়া যেতো নির্দিষ্ট কিছু ‘মার্কেটে’, যদিও সেই সব ‘মার্কেট’এ স্বাভাবিক ওষুধেরও দোকান আছে অনেক। যারা এদের কাছ থেকে কেনে, তারা জেনে শুনেই কেনে যে জাল ওষুধ কিনছে। কেন কেনে তার অনেক কারণ আছে। আমার এক বন্ধু (এখন প্রয়াত) নাম করা এক চাবাগানের মেডিকেল অফিসার ছিল। ও বলেছিল যে প্রথমে বাগানের ডিসপেনসারি থেকে ভালো ওষুধই পাওয়া যেতো। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে ক্রমশঃ সন্দেহজনক ওষুধের যোগান আসতে আরম্ভ হলো, বলে-কয়ে বা চিঠি-চাপাঠি দিয়েও কোনো লাভ হয়নি! কারণটা নিশ্চয়ই খুব পরিষ্কার, আর এটাকে সরাসরি প্রতারণাই বলে মানুষের সঙ্গে!!
যখন, সরকারি চাকরিতে ছিলাম, বারবার আমরা কয়েকজন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি যে ‘টেণ্ডার প্রক্রিয়া’র সর্বনিম্ন দর দেওয়ার পদ্ধতি ওষুধের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক, কারণ একটা মূল্যের নীচে নির্দিষ্ট ওষুধ দেওয়া সম্ভব নয়। প্রসঙ্গতঃ, তখন স্বাস্থ্য দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা যেতো, তাদের অনেকেই এক সময়ে আমাদের মাষ্টারমশাই ছিলেন(অবশ্য কথা প্রচুর বলা গেলেও কাজ হতো যৎসামান্য)।
অন্য জিনিসের বিষয় জানিনা, কিন্তু ওষুধের ক্ষেত্রে quality control খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঠিক এই প্রশ্নটাই উঠে আসে যখন সরকারি প্রকল্প থেকে ৫০ থেকে ৮০-৯০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়। ৯০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার পর লভ্যাংশ বাদ দিয়ে ওষুধের জন্য কতটা পড়ে থাকে ঠিক জানি না ; সরকার কোনো subsidy বা ভর্তুকি দিচ্ছে বলে তো কোথাও উল্লেখ দেখিনি। এগুলোর সব কটারই মান নাকি ‘পরীক্ষিত’! এতো হাজার হাজার ওষুধের ব্যাচের গুণমান ‘পরীক্ষা’ করা কি সত্যিই সম্ভব?? কে জানে, Central laboratory তো সারা দেশে রয়েছে মাত্র ৫টি?? সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে বলে proper efficacy বা ‘যথেষ্ট কার্যকারিতা’ ছাড়াই চলতে পারে কি? আমি জানি না। তবে এটাও হতে পারে, খুব অল্প সংখ্যক ওষুধ অতো ছাড়ে পাওয়া যায়, বাকিটা ‘বিজ্ঞাপন মাত্র’!!
এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে এখন নতুন কি ঘটলো যা নিয়ে আমরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছি, ওষুধ কেলেঙ্কারির গল্প তো নতুন নয়, বরং অনেক পুরোনো !
সমস্যার নতুন করে যেগুলো এসেছে ইদানিংকালে, সেগুলো হলো……..
১) সস্তায় কম গুণমানের ওষুধ আগেও পাওয়া যেতো, লোকে জেনে বা না জেনে কিনতো।
কিন্তু, এখন অত্যন্ত চালু পপুলার ব্র্যান্ড নেমের ওষুধ একই মোড়কে একই দামে বিক্রি হচ্ছে, যা হয়তো পুরোটাই ‘ফেক’ বা ‘জালি’! বস্তুতঃ, এই ওষুধগুলো বহুল ব্যবহৃত বা আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক সাথী হিসেবেই পরিগণিত। শুধু পয়সা নষ্ট নয়, এটা সরাসরি জীবন সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। Fake ingredient এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো পরের কথা, ওষুধ তার প্রত্যাশিত কাজ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হলে তো ঘোরতর সমস্যারই সৃষ্টি হবে।
২) এই ‘ফেক’ ওষুধ অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যাচ্ছে সরকারি ফার্মেসি থেকে। মেদিনীপুর, এন আর এস এর আগেও বহুবার অভিযোগ উঠেছে, কখনো কখনো তা জনসমক্ষে এসেছে, আর বেশিরভাগ সময়েই হারিয়ে গেছে ‘প্রশাসনিক তৎপরতা’য়!
৩) মারাত্মক জিনিস হলো, ‘সরকারি প্রতিক্রিয়া’ বা ‘official reaction’..
কোনো ওষুধ নিয়ে অভিযোগ উঠলেই প্রথমতঃ চেষ্টা চলে ‘অস্বীকার’ বা ‘denial’, তার পরে খুব বেশি হলে ঐ ব্যাচটা বাতিল ঘোষণা করেই কর্তব্য শেষ। কখনো দেখবেন না, তদন্ত তার বেশি অগ্রসর হয়েছে, মানে আইন আইনের পথে আপনভোলার মতো চলতে চলতে কোথায় যেন দিকশূন্যপরে হারিয়ে যায়!!
আর, পুরোটাই যখন ‘ফেক’, তার আবার ব্যাচ নম্বর!!
একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে দেখলাম, বেশ ক্যাজুয়ালি বলছেন যে এসব নিয়ে তিনি আর কিছু জানেন না, মানে জানার ইচ্ছাও বিশেষ নেই। ঠিকই তো কে না জানে, ‘যত জানবে তত বিপদে পড়বে’! আগে শুনেছিলাম ‘বোবার শত্রু নেই”; আর এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ‘অজ্ঞানের শত্রু নেই”!!
৪) BCDA (Bengal Chemists and Druggists Association) এর মুখপাত্র শঙ্খ রায়চৌধুরী গত শুক্রবার( ৭ই মার্চ) এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ধরা পড়া (seized) ‘ফেক’ ওষুধের বেশির ভাগ পশ্চিম বাংলার বাইরে তৈরি হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে যে সমস্ত ওষুধ ‘নিম্ন মান’ এর বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার অধিকাংশই সরকারি হাসপাতাল থেকে বিতরিত (distributed), আর সেগুলোর একটা বড় অংশের প্রস্তুতকারী সংস্থা হলো Paschim Banga Pharmaceutical, a unit of Farista Vanijya Private Limited……(The Indian Express, 8th. March, written by Sweety Kumari)
কিছু বলার আছে?!
৫) আসলে, দুর্নীতির ও বেআইনি কাজের উদাহরণ সর্বত্র। তবে, সাধারণ ভাবে সেগুলো ঘটে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসন ও সরকার সেগুলো দেখেও না দেখার ভান করে, এমনকি মদতও দেয়, for some obvious reasons । কিন্তু , আমাদের রাজ্যের peculiarity বা অভিনবত্ব হলো, দুর্নীতিটা প্রায় পুরোপুরি উপর থেকে সংগঠিত, organised from the top.. । ব্যক্তি এখানে সংগঠিত শক্তিরই অংশ মাত্র!!
যারা বলেন, আগে এ রকম দুর্নীতি ছিল না, তাদের একটাই কথা বলবো, দুর্নীতি চিরকালই ছিল, তবে এতো সংগঠিত well organised corruption নিশ্চিত ভাবে অন্ততঃ পঃ বাংলার মানুষ আগে কখনো দেখে নি।
আর জি কর কাণ্ড, ‘অভয়ার হত্যা, তদন্তের নামে ব্যাপক ভাবে প্রমাণ লোপ, অসামান্য সেটিং, সবই তো এই স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চরম দুর্নীতিকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ প্রয়াস!!
এটাই হলো সবচেয়ে বড় বিপদ……..
তাহলে, সমাধানটা কোথায়? আসলে, সমাধান সম্ভব একমাত্র প্রকৃত ‘সদিচ্ছা’তে, যে ‘সদিচ্ছা’ থাকলে দেশে ও রাজ্যে কার্যকর drug testing laboratory এর সংখ্যা ও কার্যকারীতা অনেক বেশি বাড়তে পারতো !! আর, প্রতিটি পর্যায়ে আসতে পারতো আরও অনেক স্বচ্ছতা (transparency)..
কিন্তু, কি মনে হয়, সেটা আদৌ সম্ভব অন্ততঃ আমাদের রাজ্যে??
জাতীয় স্তরে অবশ্য আরো একটি করণীয় ছিল, সেটা হলো ওষুধ শিল্পে পুনরায় ‘সরকারি উদ্যোগ’কে ফিরিয়ে আনা, অন্ততঃ জীবনদায়ী ওষুধের ক্ষেত্রে ! তবে, তাও কি আর সম্ভব বা সেই সদিচ্ছা আশা করা যায় বর্তমান শাসক দলের কাছে?!
পরিশেষে, একটা কথা বলতে চাই। টেলিভিশনে রাজ্যের Drug testing laboratory এর ভিতর ও বহিরঙ্গের যা হাল দেখলাম তাতে তো প্রায় ‘পরিত্যক্ত ওয়ার্কশপ’ বলেই মনে হচ্ছিল। ওটা যদি সরকারি জমিতে হয়, তাহলে ওর জায়গায় ছোটখাট ‘মল’ বা ‘আবাসন’ বানিয়ে ফেলাই বোধ করি ভালো হবে, অন্ততঃ উন্নয়নের স্বার্থে………
সব দিক থেকে নিশ্চিন্ত……..