আঙুলে তার পাখির কিচির ফুলের মিচির –৷ হ্যাঁ গো –যা বলছি তাই-ই৷ আমাদের স্কুলের এক ছাত্রের অভ্যেস হল – পড়তে বসে উল্টোদিকে বসা দিদিমনিদের নাকের ডগায় গিয়ে একভাবে নিজের কোনো একটি হাত ঘুরিয়ে যাওয়া৷ ছেলেটি অটিস্টিক৷ এমনিতে খুব শান্ত মেধাবী৷ গান গায়৷ ছবি আঁকে৷ সবই তার সবিশেষ চমৎকার৷ শুধু ওই এক হাত নাচানোর বদামি ৷ যেদিন পড়ায় মন বসল সেদিন পড়া থেকে ওঠানোই যাবে না ৷ আর যেদিন অন্যমনস্ক হল তো গেল সব – হাত ঘুরতে লাগল বনবন ৷ আমাদের চোখে মুখে লেগে যায় আর কী ! যদিও দীর্ঘদিন ধরে তার এই হাত ঘোরাবার অভ্যেসে অভ্যস্ত হয়ে গেছি ৷ সেও বোধহয় তাকে নিয়ে আমার রাগ বিরক্তিটা অভ্যেস করে নিয়েছে ৷ কতদিন পড়া ফেলে দু হাতের আঙুলগুলো আমার চশমার কাঁচে লাগিয়ে ইকরিমিকরি ছবি এঁকে যায় ৷ বইয়ের আড়ালে মুখ লুকিয়েছি রেগেমেগে ৷ চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেছি —‘কী করছিস ? কেন করছিস ? তোর এ কাজের মানে বল ৷ ”
হেসেছে ৷ এমনভাবে হেসেছে মনে হয়েছে , চশমায় নয় –ছবি আঁকছে সে আমার চোখে ৷আমি কেবল বুঝছি না বলেই খেপছি ৷ ——–একদিন হাতের নখগুলোতে কাগজের টোপর পরিয়ে স্কুলে এল ৷ দেখলাম — কোনো কোনো কাগজের টুকরোকে আবার পুরো নখের সাইজে কেটে নখের ওপর আঠা দিয়ে আটকেছে ৷ ফলে নখগুলোকেই কাগজের নখ মনে হচ্ছে ৷ শুরু হল কাগজের নখে সজ্জিত আঙুল নাচানো ৷ আঙুল শুয়ো থেকে প্রজাপতি হয়ে যাচ্ছে ৷আঙুল খেলাবার ভঙ্গিতেও পরিবর্তন এনেছে ৷ হাওয়া কেটে এগোচ্ছে টুপিওয়ালা নখ ৷ বেশী রাগি বলে আমিই তার টার্গেট ৷ মারতে উঠলাম ৷ ফুলো ফুলো গালে চড়টা পড়েই যাচ্ছিল প্রায় ৷ ক্লাসের বর্ষীয়ান শিক্ষিকা বললেন —
” এ খেলার মানে নেই বটে ৷ তবে এ হল ওদের মনের খেলা ৷ কেবল আঙুলের নয় ৷ তুমি ভালো করে দেখো আগে ওর আঙুল খেলা ৷ বিরক্তি কমে আনন্দ আসবে আপনি ৷ ”
বড়ো মন দিয়ে দেখলাম আমার পুরনো খোকাটাকে ৷ রেগুলার বকা খেতে থাকা বাচ্চাটাকে আদরচোখে দেখলাম গো ৷ তখনো আঙুল খেলিয়ে যাচ্ছে সে ৷ কত বিচিত্র ভঙ্গি ! একটার সাথে অন্যটার কোনো মিলই নেই ৷ একবার টুপিআঙ্গুল কানের পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল ৷ মনে হল- কাক ঠোঙার জিলাবি নিয়ে আকাশে দৌড় মারল ৷ আবার দেখলাম — দুহাতের দশ দশটা আঙ্গুল সমান্তরালে ওড়াতে ওড়াতে মাটিতে নামাল ৷ আরি বাপ ! এ যে দেখি দশ গাংফড়িং টোপর পরে মাঠে নেমে বউ খুঁজছে ৷
এত মূর্তি তোর আঙুলে?
বকছি না বলে আহল্লাদে ছবি আঁকছিস বিনি তুলিতে?
পবনে – গগনে ফোটাবি লক্ষ কোটি ছাঁচ?
★★ অভিভাবক এবং আমার মতো মুখ্যুর ডিম দিদিমণিদের অনুরোধ — শিশুর মানেহীন খেলাগুলোকে মহার্ঘ সম্পদের মত যত্ন করুন ৷ উৎসাহ দিন অকাজে ৷ সে হবে আপনাদের নিজের ওপর কৃপা ৷ দেখবেন — মেঘের গায়ে আঁকছে সে সবুজ ফুলের মাঠ ! কিংবা নদীতে সাত সুরের পাখি ৷ না পারার ক্ষোভে শুদ্ধ বাতাস যেন না হারায় এ সব শিশু –বিশেষ করে হাইপারএক্টিভরা ৷
এঁকে যা খুশি আর মনের হরষে –
মন দিয়ে শুনি তোদের তৃপ্ত প্রশ্বাস ৷
আপনাদের কাছে এ একজন মায়ের বিনতি !