বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জানিয়েছে যে একজন মানুষকে তখনই সম্পূর্ণ সুস্থ বলা যাবে যখন তিনি শারীরিক ও মানসিক দুইদিক দিয়েই সুস্থ হবেন।কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শারীরিক অসুস্থতা সম্বন্ধে আমরা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল হলেও মানসিক অসুস্থতাগুলির ব্যাপারে আমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই।আবার আমরা নিজেদের বাইপাস সার্জারীর কথা বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করলেও মানসিক অসুস্থতা সম্বন্ধে পরিবার -পরিজনের বাইরে অন্যান্য লোকজনের সাথে আলোচনার ব্যাপারে কুণ্ঠাবোধ করি।আমরা সামান্য সর্দি হলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেও অনেক সময় দীর্ঘদিনের মানসিক সমস্যার জন্য মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেবার বিষয়ে অবহেলা করি।কিন্তু সত্যিটা হল -কোন ব্যক্তি শারীরিক ভাবে সুস্থ মানেই যে তাঁর কোনদিন কোন মানসিক সমস্যা দেখা দেবে না তা কিন্তু নয়।বরং আমাদের চারপাশে আপাত হাস্যময় ও গ্ল্যামারাস অনেক মুখের পিছনেই লুকিয়ে আছে ডিপ্রেশনের কালো অন্ধকার।
পরিসংখ্যান বলছে ভারতবর্ষে প্রতি একশ জনের মধ্যে ১৩.৭ জন মানুষ জীবনের কোন না কোন সময় মানসিক রোগের শিকার হন।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২০ সালে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার(মন খারাপের সমস্যা) বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অসুখ এবং ২০৩০ সালে বিশ্বের বৃহত্তম অসুখ হিসাবে দেখা দেবে।
আমরা হাসপাতালে যে সমস্ত ডিপ্রেশনের রোগী দেখি তারা আসলে হিমশৈলের চূড়ার মতো ।আসলে পৃথিবীতে প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে জীবনের কোনো এক সময়ে ডিপ্রেশনের সমস্যা তৈরি হয়।এই রোগ মহিলাদের মধ্যে তুলনায় বেশি হয়(পুরুষদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ)।আবার বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই রোগের প্রবণতাও বাড়ে।
ডিপ্রেশন মনে কিন্তু শুধু মন খারাপ নয়।এক্ষেত্রে মন খারাপের সাথে সাথে আরো কিছু সমস্যা দেখা দেয় যেমন -শরীরে শক্তি কমে যাওয়া,আগে যে সমস্ত কাজ করতে ভালো লাগতো সেগুলোতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মনোযোগের অভাব,ভুলে যাওয়া,অল্পতেই রেগে যাওয়া,নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, নিজেকে দোষী মনে হওয়া, আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা করা,ঘুম কমে বা বেড়ে যাওয়া,খিদে কমে বা বেড়ে যাওয়া ,ওজন কমে যাওয়া ইত্যাদি।এর সাথে সাথে অনেক সময় শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, মাথা ব্যথা, হজমের সমস্যা,কোষ্ঠ কাঠিন্য বা পেটের গন্ডগোল দেখা যেতে পারে।রোগের গভীরতা খুব বেড়ে গেলে উপরোক্ত সমস্যা গুলির সাথে সাথে সন্দেহ প্রবণতাও দেখা দিতে পারে।ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অনেক সময়ই তাঁদের মনের কথা কাউকে বলে উঠতে পারেন না।অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা এই জাতীয় অসুস্থতার কথা কারো সামনে বলতে বা এই ব্যাপারে ডাক্তার দেখাতে সংকোচ বোধ করেন।ক্রমশ রোগের তীব্রতা বাড়ে এবং তখন অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেন।
সংখ্যার বিচারে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর প্রায় আটলাখ মানুষ আত্মহত্যা করেন,প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ও প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করেন।পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা মহিলাদের তুলনায় বেশী ঘটে।সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে বয়স্কদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা শৈশব ও কৈশোরের তুলনায় বেশী হলেও শিশু ও কিশোরদের মধ্যেও আত্মহননের প্রবণতা নিতান্তই নগণ্য নয়।তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে WHO সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখকে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
ডিপ্রেশনের কারণ নিয়ে সবচেয়ে
বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বলতে গেলে বলতে হয় মস্তিষ্কের মধ্যে কিছু কেমিক্যালের(যাদেরকে নিউরোট্রান্সমিটার বলে) পরিমান কমে বা বেড়ে গেলে এই জাতীয় রোগ হয়।তাই সেই অর্থে অন্য শারীরিক রোগের থেকে ডিপ্রেশন আলাদা কিছু নয়।
বাড়িতে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে(যেমন মৃত্যু,একসিডেন্ট ইত্যাদি) মন খারাপ লাগা স্বাভাবিক।কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মধ্যে সেটি নিজে থেকেই কেটে যায়।এক্ষেত্রে বাড়ির লোকজন,আত্মীয়স্বজনের ঠিকমতো সহযোগিতা পেলেই হয়তো মন খারাপ ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু যখন মন খারাপ এতটাই বেশি হয় যে আপনি কোন কাজ করতে পারছেন না,সংসারের কাজকর্মে ঠিকমতো অংশগ্রহণ করতে পারছেন না,আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসছে বা চেষ্টা করে বসেছেন -তখন সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিন।
সমস্যা যখন অল্প থাকে তখন কাউন্সেলিং থেকে লাভ হয়,কিন্তু সমস্যা যখন বেশি তখন ওষুধের প্রয়োজন হয়।
তাই মন খারাপ লাগলে সেটা নিয়ে কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে আলোচনা করুন,খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো ভাবে করুন,ঘরে বসে না থেকে প্রতিদিন অন্তত আধ ঘন্টা করে বিভিন্ন ফিজিকাল এক্টিভিটি তে অংশগ্রহন করুন(যেমন ব্যায়াম, মর্নিং ওয়াক ইত্যাদি),ঠিক মতো ঘুমোন ও নেশা থেকে বিরত থাকুন।বড় কাজ করতে অসুবিধা হলে সেটিকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে এক একটি অংশে মনোযোগ দিন।ডিপ্রেশনে থাকা কালীন জীবনের কোন রকম বড় সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভাল।মানসিক রোগগুলিকে শারীরিক রোগ থেকে আলাদা ভাবে দেখবেন না।মন খারাপ নিয়ে অকারণে হীনমন্যতায় বা সংকোচে ভুগবেন না।
সমস্যা বেশি মনে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।এখন মানসিক রোগের চিকিৎসাব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত।বর্তমানে ডিপ্রেশনের চিকিৎসায় এস এস আর আই(SSRI) গোত্রের ওষুধ খুব ব্যবহৃত হয়,যেগুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুবই কম।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে মানসিক রোগের ওষুধ মানেই ঘুমের ওষুধ নয়।বর্তমানে যে সব ওষুধ ব্যবহৃত হয় সেগুলো খেলে সারাদিন ঘুম পাবার সম্ভাবনা নেই এবং কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সময় কোন অসুবিধা হবার সম্ভাবনা নেই।অন্যান্য শারীরিক রোগের ওষুধের সাথে সাথে মানসিক রোগের ওষুধ খাওয়ার তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই।