ধানের খেতে কোমর-সমান জল, দেখলেই বুকটা দুরদুর করে বীণা প্রামাণিকের। ওই জলে নেমে চাষের কাজ করতে হবে, অথচ জল হয়ে রয়েছে বিষ। রাসায়নিক সার আর কীটনাশক মিশে এমন দশা ওই জলের, যে মেয়েদের কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত র্যাশ বেরোবে, চুলকানি হবে, তা অবধারিত। কেবল অন্যের খেতে খেতমজুরি করার সময়েই নয়, নিজের খেতেও কাজ করতে গিয়ে একই দশা হয় বীণার। কিন্তু রাসায়নিক কীটনাশক এত বিপজ্জনক, জেনেও কেন নিজের চাষে তা ব্যবহার করছেন? “মাটির যা দশা, তাতে ওই সার, কীটনাশক না দিলে ফসল ফলবেই না,” বললেন বীণা। গোবর বা অন্যান্য জৈব সার ব্যবহার করলেও তাতে কুলোয় না, রাসায়নিক সার দিতেই হয়। কিন্তু এত দূষিত জল, মাটিতে যে ধান বা সবজি হচ্ছে, তা-ও কি দূষিত হচ্ছে না? “আমরা ওই ফসল খাই না। জানি তো, ওতে কী রয়েছে,” সাফ স্বীকারোক্তি এই মহিলা চাষির।
বীণা কথা বলছিলেন ‘শ্রমজীবী ভাষা’পত্রিকা আয়োজিত একটি আলোচনা সভায়, যার বিষয় ছিল ‘প্রকৃতি-পরিবেশ ও শ্রমজীবী মানুষ।’ ৫ নভেম্বর, ২০২৫, যাদবপুরের সংস্কৃতি চক্রে এই সভায় অংশ নিয়েছিলেন নানা জেলা থেকে আগত বেশ কিছু শ্রমজীবী মানুষ। বনগাঁর কালোপুর গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে এসেছিলেন বীণা প্রামাণিক আর সবিতা বৈরাগী। সবিতাও চাষ করতে গিয়ে দূষণের শিকার হচ্ছেন, বীণার মতোই। হাতে গ্লাভস, মুখ মাস্ক পরার কোনও অভ্যাস গড়ে ওঠেনি, সে সবের জোগানও নেই। পটল ওই অঞ্চলের এক প্রধান ফসল, কিন্তু পটল গাছ তৈরির সময়ে এমন কীটনাশক ছড়ানো হয়, যে ফুলে ফুল ছুঁইয়ে পরাগ মিলন করানোর কাজ করতে গিয়ে চাষি, খেতমজুর মেয়েদের মাথা ধরে যায়, চোখ জ্বালা করে, বলছিলেন সবিতা। এই ভয়ানক পরিস্থিতির থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও উপায় তাঁদের জানা নেই, কারণ চাষের উপকরণ বা পদ্ধতি বিষয়ে তাঁদের জ্ঞানের একমাত্র উৎস হলেন স্থানীয় সার-কীটনাশকের ডিলার। কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের সঙ্গে এই চাষিদের কোনও সংযোগ নেই, এমনকি কৃষি দফতরও তাঁদের পাশে নেই। বীণার নালিশ, কৃষি আধিকারিকের (এডিএ) দফতরে বড় বড় চাষিদের ঢুকতে দেয় কেবল, ছোট চাষি বা খেতমজুরদের কোনও পাত্তাই দেয় না। একই দশা সরকারি হাসপাতালে। সেখানে হাতে কেবল মলম ধরিয়ে দেওয়া হয়, তাতে বিশেষ কাজ হয় না। প্রাইভেট ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতা এই মেয়েদের নেই।
শ্রমের সঙ্কট, আর পরিবেশের সঙ্কট, এ দু’টো নিয়েই অনেক কথা হয়, কিন্তু সাধারণত এ দুটো একই সঙ্গে আলোচনা হয় না। সংবাদ কিংবা প্রশাসনিক আলোচনায় এ দুটি বিষয়কে আলাদা শিরোনামে উপস্থাপনা করা হয়। ভিন্ন বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয় মতামত দেওয়ার জন্য। অথচ, শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায় যে, প্রায় সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণ সরাসরি প্রভাব ফেলছে জীবন-জীবিকার উপর। এমন নয় যে এই ক্ষতি কিংবা স্বাস্থ্যহানি অনিবার্য। এর এক প্রধান কারণ নীতির ব্যর্থতা। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে শুরু হয়েছিল কেন্দ্রের ‘সয়েল হেলথ স্কিম’ — মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রকল্প। তার সাফল্য নিয়ে সরকারি ওয়েবসাইটে অনেক বড়াই করা হয়। যেমন, ২৫ কোটি ‘সয়েল হেলথ কার্ড’ বিতরণ হয়েছে। কিন্তু সংখ্যার পিছনে লুকিয়ে থাকে সমস্যা — এক একটি মাটির নমুনা আড়াই হেক্টর থেকে দশ হেক্টর জমির ‘স্যাম্পল’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এত বড় এলাকার মধ্যে নানা জমিতে বিভিন্ন রাসায়নিক-খনিজের মাত্রার যে ইতর-বিশেষ রয়েছে, তা প্রতিফলিত হয় না নমুনায়। রাজ্য অনুসারে বদলে যায় মাটি পরীক্ষার ল্যাবরেটরির সংখ্যা, দক্ষতা এবং ক্ষমতাও। পশ্চিমবঙ্গে গোটা সতেরো মাটি পরীক্ষার ল্যাবরেটরি রয়েছে। ক্ষুদ্র, অতি-ক্ষুদ্র চাষিরা যদি বা কখনও ‘সয়েল হেলথ কার্ড’ হাতে পান, পরামর্শ পাবেন কোথায়? অতএব আরও বেশি সার, আরও বিষাক্ত কীটনাশকের ব্যবহার চলছেই।
একই ভাবে সরকারি নীতির শিথিলতা বিপন্ন করছে মৎস্যচাষিদের। সে দিনের সভার অন্যতম বক্তা ছিলেন দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরামের অন্যতম নেত্রী তাপসী দলুই। কুলপির ট্যাংরার চরে সামুদ্রিক মৎস্যজীবীদের একটি সমবায় সমিতির তিনি সভাপতি। তাপসীর বক্তব্য, কুড়ি বছর আগে তাঁরা যা মাছ পেতেন, আজ পাচ্ছেন তার চার ভাগের এক ভাগ। তাঁর মতে এর প্রধান কারণ, সমুদ্রে ট্রলার চলতে দেওয়ার সরকারি নীতি। পশ্চিমবঙ্গের নিয়ম অনুসারে উপকূল থেকে অন্তত আঠারো কিলোমিটার দূরে মাছ ধরতে পারে ট্রলার, যদিও নিয়ম লঙ্ঘন করে প্রায়ই আরও কাছাকাছিও চলে আসে ট্রলারগুলো। ট্রলারের জাল একেবারে সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত নামানো থাকে, এবং সব ধরনের জলজ প্রাণীকে তুলে আনে। ফলে ছোট ছোট পোনা, প্রচুর জলের প্রাণী মারা পড়ে। যাঁরা উপকূলে বা মোহনায় নৌকোয় মাছ ধরেন, সেই ছোট মৎস্যজীবীরা অনেক বেশি পরিবেশ-সম্মত উপায়ে কাজ করেন নিজেদের স্বার্থেই — যাতে মাছের জোগান বজায় থাকে। কিন্তু বড় বড় ট্রলারে আরও বেশি মাছ তুলে আনা, এবং রফতানি-মুখী সরকারি নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট মৎস্যজীবীরাই বেশি।
পরিবেশ বাঁচানোর জন্য যে ধরনের প্রকল্প নেয় সরকার, অনেক সময়ে তার সঙ্গেও সংঘাত তৈরি হয় স্থানীয় শ্রমজীবীদের। যেমন, সুন্দরবনে নদীর চরগুলোতে নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ লাগানোর চেষ্টা। তাপসী বলেন, “যে সব এলাকাতে দীর্ঘ দিন ধরে মৎস্যজীবীরা তাঁদের নৌকো মেরামত করেন, শুকোতে দেন, সে সব জায়গাও ম্যানগ্রোভ লাগানোর জন্য ঘিরে দিয়েছিল বন দফতর। আমি গিয়ে সে সব বেড়া ভেঙে দিয়েছি। সরকারি কর্তারা আমাকে অনেক ভয় দেখিয়েছে। আমি বলে দিয়েছি, ‘যাকে ইচ্ছে ডেকে নিয়ে আসুন। আমাদের কাজের জায়গা আমরা ছাড়ব না।’ নৌকো শুকোনোর জমি কেড়ে নিলে আমরা বাঁচব কী করে?”
মৎস্যজীবীদের আর একটি সঙ্কট, মাছের পোনা রক্ষার উদ্দেশে বর্ষার সময়ে যে দু’তিন মাস সমুদ্রে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার, সে সময়ে রোজগারহীন হয়ে পড়া। যদিও রাজ্য সরকার এই কয়েক মাসের জন্য ‘সমুদ্রসাথী’ প্রকল্পের অধীনে অনুদান ঘোষণা করেছে ২০২৪ সালে, এবং বাজেটে তার বরাদ্দও দেখানো হয়েছে, কিন্তু আজ অবধি কোনও টাকা পাননি মৎস্যজীবীরা। পরিবেশ সুরক্ষা এবং জীবিকার সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সরকার তার ঘোষিত প্রকল্পের রূপায়ণ করছে না বলে।
অনেক কর্মক্ষেত্র অবশ্য বরাবরই রয়ে গিয়েছে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মিনাখার ধুতুরদহ থেকে সে দিন সভায় এসেছিলেন কারিবুল মোল্লা। আসানসোলের একটি পাথর খনিতে তিন বছর কাজের পর সিলিকোসিস নিয়ে তিনি ফিরেছেন গ্রামে। ক্রাশার-এ প্রবল ধুলো, জল ছেটানোর মেশিন দিয়ে ধুলো থিতিয়ে দেওয়ার বিধি রয়েছে খাতা কলমেই। সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী কমিটির সম্পাদক সাইদুল পাইক জানালেন, আয়লার পর তাঁদের এলাকার যে কৃষিজীবী মানুষেরা আসানসোলের নানা পাথর খাদানে কাজ করতে গিয়েছিলেন, ২০১১ সাল থেকেই তাঁরা জ্বর, বুকে চাপ চাপ ব্যথা, অল্প পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে পড়া, এই সব লক্ষণ নিয়ে ফিরতে থাকেন। কেবল ক্রাশার কর্মীরাই নন, নির্মাণ কর্মীরাও ভুগছেন এই সব লক্ষণে, জানালেন তাঁদের নিয়ে কর্মরত বারাসতের সমাজকর্মী অনিতা মিস্ত্রি। সম্ভবত তার কারণ, সিমেন্টেও থাকে প্রচুর পরিমাণে ‘সিলিকা।’
খনিগুলিতে কোনও শ্রমিকের নাম নথিভুক্ত করা হয় না, এক একজনকে এক একটা নম্বর দেওয়া হয়। ফলে সেখান থেকে কোনও সহায়তা পাওয়ার আশা নেই। সরকার বা শ্রমিক সংগঠন, কোনও তরফেই খনির মালিকদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা নেই। সাইদুল জানান, দীর্ঘ সংগ্রামের পর তাঁরা সরকারের থেকে এই স্বীকৃতি আদায় করেছেন যে সিলিকোসিস পেশাগত রোগ, এবং তার জন্য রোগীদের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। কিন্তু অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে, এই আশায় মোবাইলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই এক দিন চোখ বোজে তারা। টাকা আর ঢোকে না।
সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় মনে করালেন, শ্রমিকের দুর্দশা অথবা পরিবেশের বিপন্নতা, এর কোনওটাই পুঁজিকে বিচলিত করে না, কারণ পুঁজির ধর্ম কেবল নিজেকে বাড়িয়ে চলা। পুঁজিতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে পুঁজির কার্যনির্বাহী কমিটিতে। ফলে আজ পরিবেশ আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনও ভেদ নেই। সবগুলিই শেষ অবধি পুঁজিতন্ত্র-বিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলনের পথ কী হবে, তা শিখতে হবে শ্রমিকের কাছ থেকে, তার পাশে দাঁড়িযে।
শ্রমজীবী ভাষা পত্রিকায় ১লা ডিসেম্বর ২০২৫ এ প্রকাশিত।











Brilliant article. Call to action.