শক্তি চাটুজ্জে মশাই বলেছিলেন, ধর্মে আছি জিরাফেও আছি। তাতেই আমরা ভেবে কূল পাইনে কবিতা থেকে কফি হৌস থাকতে হঠাৎ জিরাফ কেন। তবে জিরাফের গলা ধরে ল্যামার্ক আর ডারউইন ঝুলোঝুলি করেছিলেন, তাতে অবাক কাণ্ড দেখিনে। অমন একখান গলা এল কেমন করে, তার একটুখানি ব্যাখ্যান না দিলে বংশধারায় পরিবর্তন অর্থাৎ কিনা Descent with modification ওরফে বিবর্তনের তত্ত্ব তৈরি হয় কেমনে? কিন্তু জিরাফের গলা লম্বা হবার কথা মহাজনেরা ঢের কয়েছেন, আমি তার একখান নার্ভ, বাংলায় যারে কয় স্নায়ু, তাই নিয়ে নার্ভাস হবার বেতান্ত বলি বরং।
‘রেকারেন্ট ল্যারিঞ্জিয়াল’ স্নায়ু। বেচারি চার ইঞ্চি পথ পেরোতে ১৮০ ইঞ্চি হাঁটে। তার কাজ হল ল্যারিংস তথা স্বরযন্ত্রে পৌঁছে তার পেশীগুলোকে কাজ করানো। জিরাফের মস্তিষ্ক থেকে বেরোয় ‘ভেগাস’ স্নায়ু, তার থেকে শাখা হিসেবে বেরোয় ‘রেকারেন্ট ল্যারিঞ্জিয়াল’ স্নায়ু। যেখানে সে বেরোয় তার চার ইঞ্চি দূরত্বে স্বরযন্ত্র। কিন্তু কার ষড়যন্ত্রে সে যে ১৫ ফুট ঘুরপাক খায় তা কে জানে।
কোনও ইঞ্জিনিয়ার এমন ডিজাইন করলে তার চাকরি নট হতে দু’মিনিট সময় লাগত। সৃষ্টিকর্তার অবশ্য সে-ভাবনা নেই। কিন্তু যদি এই স্নায়ু বিবর্তনের ফসল হয়, তাহলে চিন্তা হয়, কেমন করে প্রাকৃতিক নির্বাচন এত বাজে ডিজাইন মেনে নিল। এতটা অপচয় সহ্য করল।
সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাধারণ পূর্বসূরী ছিল ডাঙ্গায়-ওঠা এক প্রাচীন মাছ। তার দেহে এইরকম স্বরযন্ত্র ছিল না, কিন্তু স্বরযন্ত্র ভ্রূণের যে সব স্ট্রাকচার থেকে উৎপন্ন হয়, তারা ছিল। মাছ-জাতীয় প্রাণীর দেহে এই স্নায়ু-পূর্বসূরীর গতিপথ ছিল সোজা। মাছের ঘাড় বা গলা বলে কিছু নেই। তার শরীরের জন্য স্নায়ুটির গতিপথ ছিল যথাযথ। আর জিরাফের গলা হল কয়েক মিটার লম্বা, তার জন্য মাছের স্নায়ুটির উত্তরসূরীই ক্রমশ পরিবর্তিত হয়েছে। ভেগাস স্নায়ু থেকে বেরনোর পরে এই স্নায়ু বৃহৎ ধমনীগুলোর নীচ দিয়ে ঘুরে ওপরে ওঠে ও তার গন্তব্যস্থল স্বরযন্ত্রে যায়। জিরাফের দেহে এই পথ বিরাট লম্বা।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মানুষের শরীরে কীভাবে বাঁদিকের রেকারেন্ট ল্যারিঞ্জিয়াল স্নায়ু অ্যাওর্টিক আর্চের নীচ দিয়ে পাক খেয়ে স্বরযন্ত্রে পৌঁছায়। জিরাফের দেহে একই পথে এই স্নায়ু ঘুরপাক খায়, কিন্তু তার গলা লম্বা বলে দু-চার ইঞ্চির দূরত্ব পার হতে এই স্নায়ুকে ১৫ ফুট ঘুরে আসতে হয়।
(চিত্রঋণঃ https://futurism.com/evolutianary-proof-the-recurrent-laryngeal-nerve-2)
জিরাফের রেকারেন্ট ল্যারিঞ্জিয়াল স্নায়ুর নকশায় সত্যিকার পূর্ব-পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট। মার্কিন জীবাশ্মবিদ স্টিফেন জে গুলড-এর ভাষা ধার করে বলা যায়, আপাত-অদ্ভুত সজ্জা আর হাস্যকর সমাধান হল বিবর্তনের পথের নজির, যে পথ কোনও বুদ্ধিমান ঈশ্বর নেবেন না, কিন্তু [জীবের বিবর্তনীয়] ইতিহাসের দ্বারা সীমাবদ্ধ হবার কারণে যে পথ প্রাকৃতিক নির্বাচন নিতে বাধ্য থাকে। (Odd arrangements and funny solutions are the proof of evolution-paths that a sensible God would never take, but that a natural selection, constrained by history follows perforce.)