রকেট উৎক্ষপণের কল্যাণে এই কাউন্ট ডাউন ব্যাপারটা এখন সবাই জানে। কোন কাজ শুরুর জন্য একেবারে ঘড়ি ধরে এগোনোর সময়, একটা সময় কতক্ষণ আর বাকি আছে, সেটা গোনাই হল কাউন্ট ডাউন।
তবে বাঙালির এই কাউন্ট ডাউন সবথেকে ভালো বোঝা যায়, পূজার আর কদিন বাকী তার হিসাব শুরু হলে। মোটামুটি একশ দিন বাকী থাকতে এই উল্টো গণনা শুরু হয়। দোকান বাজারে পূজা এসে গেল, এই রবটা যেমন বোঝা যায়; সেভাবেই সরকারী আপিসে আপনার কোন কাজ বাকী থাকলে এই ব্যাপারটা হাড়ে হাড়ে বুঝবেন।
আর একটা বিরক্তিকর কাউন্ট ডাউন আজকাল টিভিতে দেখছি। তিন মিনিট খবর দেখানোর পর গোটা দশেক বিজ্ঞাপন চলে। তারপর এক কোনে দেখাতে থাকে তিন মিনিট বিজ্ঞাপন চলবে। এই তিন মিনিট এক এক সেকেন্ড করে কমতে থাকে। অবশ্য হাতের রিমোটটা কয়েক সেকেন্ডেই আরও কত চ্যানেল ঘুরে দেখিয়ে দেয় কাদের সব থেকে কম সেকেন্ড বাকী আছে।
ছোট বেলায় আর একটা কাউন্ট ডাউন ছিল, স্কুলের পরীক্ষা। আর দুটি বাকি, আর একটা বাকি, ব্যাস তারপর ছুটি।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত কাউন্ট ডাউন ছিল, প্রথম অ্যাটম বোমার পরীক্ষা। সবথেকে বিখ্যাত, অথচ সবথেকে গোপনীয়। আমেরিকার কুখ্যাত ম্যানহাটান প্রজেক্ট। ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ চলছে। পৃথিবীর সব বড় বড় বিজ্ঞানী গোপনে অ্যাটম বোমা তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন। বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার এই বিজ্ঞানী দলের প্রধান। যেমন বড় বিজ্ঞানী তেমনি বড় দার্শনিক। পৃথিবীর সব বড় বড় দর্শনের বইয়ের সাথে শ্রীমৎ ভগবৎ গীতাও পড়েছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন ব্যাপারটাও খুব ভালো করে জানেন। প্রথম অ্যাটম বোমার পরীক্ষা করার আগে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছে। নিরাপদ দূরত্বে বসে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষার ফল দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। পরে জানা যায় বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার এই কাউন্ট ডাউনের শেষ পনের সেকেন্ডে উত্তেজনায় প্রায় পাগল হয়ে যান। সেই বিশাল বিস্ফোরণ দেখার সাথে সাথেই বিজ্ঞানীর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে গীতার শ্লোক। ভগবানের বিশ্বরূপ বর্ণনায় যেমন আছে; সহস্র সূর্য একসাথে আকাশে উঠলে যেমন অবস্থা হয় এমন।
আমার বহু বছর পর্যন্ত ভুল ধারণা ছিল যে উনি মূল সংস্কৃত শ্লোকটি আবৃত্তি করেছিলেনঃ “কালো’স্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো। লোকান্ সমাহর্তুমিহ প্রবৃত্তঃ।।“ না, উনি ইংরেজীতেই বলেছিলেন, “I am become death, destroyer of the worlds”!
সরকারী চাকরীর শেষ দিকে পৌঁছে কর্মচারীরা দিন গুনতে শুরু করেন। আর কতদিন বাকী অবসরের? কারো কারো ক্ষেত্রে তিন -চার বছর আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় এই কাউন্ট ডাউন।
আমার এক প্রিয় প্রফেসর দাদা এ মাসেই অবসর নেবেন, আর মাত্র পঁচিশ দিন পর। এখন উনি কাউন্ট ডাউন শুরু করতেই পারেন। কিন্তু আমাদের মত যারা প্রায় আমৃত্যু চাকরীর চক্করে পড়েছি তারা আর মাস গণারও সাহস পাই না। খুব আশায় বুক বেঁধে আমি যেমন গুনছি, আর বত্রিশ মাস আছে। বলা যায় না, আঠাশ তিরিশ মাসের মাথায় বলে দিতে পারে, আরও তিন বছর লড়ে যাও বাছাধন।
এই গত কালই সকালে টিভির সামনে বসে একটা গৌরবের কাউন্ট ডাউন দেখলাম। ভারতের হকি দল, টোকিও অলিম্পিকে একটা পদকের কাছে পৌঁছে গেছে। দুর্ধর্ষ জার্মান দলের থেকে পাঁচ-চার গোলে এগিয়ে আমার দেশ ভারত। টিভির সামনে বসে খেলা দেখছি, কোটি কোটি ভারতীয়ের সাথে সামান্য আমিও। খুবই উত্তেজনার খেলা চলছে। কুড়ি মিনিট বাকী থাকতেই টিভির ভাষ্যকার কাউন্ট ডাউন শুরু করে দিয়েছেন। আসলে এই কুড়ি মিনিটে, হকিতে দশটা গোলও হতে পারে। মিনিট চারেক বাকী থাকতে জার্মান দল একটা গোল করে ব্যবধান কমিয়েছে। মাত্র এক গোলের ব্যবধান হকিতে কোন ব্যাপার নয়। এক মিনিট বাকী থাকতে কাউন্ট ডাউন শুরু হল সেকেন্ডে। 50 সেকেন্ড বাকী, 40 সেকেন্ড বাকী, আর মাত্র দশ সেকেন্ড…….. ছয় সেকেন্ড বাকী থাকতে জার্মান দল একটা পেনাল্টি কর্নার পেয়ে গেল। নিজের উৎকণ্ঠার থেকেই বুঝতে পারি, গোটা দেশ কেমন উৎকণ্ঠায় থাকতে পারে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ঐ পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল হল না; মাঠের খেলোয়াড়, টিভির ভাষ্যকার, আর গোটা দেশের সাথে আমিও দারুণ আনন্দ পেলাম। সবাই একটা কথা বলছে, একচল্লিশ বছর পর দেশ হকিতে একটা মেডেল পেল। উচ্ছাস স্বাভাবিক।
কিন্তু ঐ একচল্লিশ বছর আগের একটা দিনের কথা মনে করে, আমি তেমন যেন আবেগে আপ্লুত হতে পারলাম না। দেশের এত বড় একটা সাফল্যও আমাকে তেমন উচ্ছসিত করল না? তবে কি আমার কোন কিছুতে ঘাটতি আছে?
ফিরে চললাম সেই একচল্লিশ বছর আগের একটা কাউন্ট ডাউন-এর দিনে। তখন আমার মাত্র বছর কুড়ি বয়স। আবেগ উচ্ছাস সবই আজকের থেকে অনেক বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আমি কলেজ থেকে গ্রামের বাড়িতে এসেছি। গ্রামের বাড়িতে টিভি এসেছে তারও বছর কুড়ি পরে। আমরা ফুটবল, ক্রিকেট সবই রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনি। কি করে জেনেছিলাম, ঐ দিন বিকেলের দিকে মস্কো অলিম্পিক-এর হকি ফাইনাল খেলা আছে, মনে নেই। গ্রামের বাড়িতে একটা ছোট রেডিও ছিল। সন্ধ্যের মুখে এদিক ওদিক চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে এক সময় শুনতে পেলাম, হকি খেলার ধারাভাষ্য চলছে। একা একাই রেডিওটা বুকের ওপর নিয়ে শুনছিলাম। খুবই আস্তে শোনা যাচ্ছিল। হিন্দি আর ইংরেজী ধারা ভাষ্য , বোধ হয় পাঁচ মিনিট করে করে হচ্ছিল। তখনও হিন্দি আজকের মত, আমাদের হেঁসেলে ঢুকে পড়েনি। কিন্তু তাতে আমার ধারাভাষ্য বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি। একেবারে শেষ মিনিটে, সেবারও ভারত এক গোলে এগিয়ে। সেটা ছিল ফাইনাল খেলা। আমি চোখ বুজে শুনছি, ভাষ্যকার আবেগে আপ্লুত হয়ে বলে যাচ্ছেন, “অলিম্পিক স্টেডিয়াম কে কোনে কোনে মে ভারতকা তেরঙ্গা লেহরতে হুয়ে।“ শুনছি? না কি দেখতেও পাচ্ছিলাম, ভারতের জাতীয় পতাকায় গোটা মাঠের চতুর্দিক রঙ্গিন হয়ে উঠেছে। আর মাত্র দশ সেকেন্ড বাকী; ভাষ্যকার কাউন্ট ডাউন শুরু করেছেন, টেন, নাইন, এইট,সেভেন…………. মাঝের কটা সংখ্যা উনি বলেছিলেন কিনা কোনদিন আর আমার মনে পড়েনি। ভাগ্য ভাল যে তখন বয়সটা মাত্র বছর কুড়ি ছিল। নয়তো একটা হার্ট এ্যাটাকই হয়ে যেত। যতো দূর মনে পড়ে, সিক্স-এর পর আর কিছু শুনিনি সেদিন। হঠাৎ যেন গভীর ঘুম থেকে উঠে শুনলাম ভাষ্যকার চিৎকার করে উঠলেন, “গোল্ড”! গোল বললেন, না কি গোল্ড বললেন, বুঝে উঠতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছিল। জীবনে প্রথম শোনা কাউন্ট ডাউন-এর সেই সোনালী স্মৃতি আজ একচল্লিশ বছর পরেও অমলিন হয়ে আছে।
এটা বোধ হয় আমার দূর্ভাগ্যই যে, আজ আর কোন কিছুতেই তেমন উচ্ছসিত হতে পারি না।