(পূর্ব-প্রকাশিতের পর)
হ্যাঁ, গ্রামবাংলায় আজও এক অজানা কারণে শ্বেতীকে ‘ফুল’ বলে ডাকা হয়। এবং সংক্রামক কোনো অসুখ হিসেবে, কুষ্ঠ হিসেবে পরিগণিত করা হয় তাকে। ‘ফুল’ হওয়া খুব লজ্জার ব্যাপার, সমাজচ্যুত হবার ভয় থাকে। যেহেতু এটাকে মারাত্মক অসুখ ভাবা হয়, সেহেতু ‘ফুল’ নামে তাকে ডেকে তার তথাকথিত ক্ষতিকারক দিকটা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার চেষ্টা করা হয়। যে মানসিকতা থেকে সাপকে ‘লতা’ বলে ডাকা হয় (যেন ‘সাপ’ কথাটা উচ্চারণ করলেই সে হয়ে উঠবে উদ্যত ছোবল, বিষধর),ঠিক সেই একই মানসিকতা থেকে শ্বেতীকে ‘ফুল’ বলে চিহ্নিত করা হয়। মনোবিদরা হয়তো এর সঠিক কারণ বিশ্লেষণ করতে পারবেন।
শ্বেতীর শুরুটা কিন্তু খুব ধীরে। নিঃশব্দে ফুটে উঠতে থাকে সাদা ছোপ। প্রথমে হাল্কা, তারপর আর একটু গাঢ়, তারপর আর একটু—এইভাবে। এ-রোগের চলন্টা বেশ গোলমেলে। কেন যে হয়, কেন যে বাড়ে, আবার কেনই বা হঠাৎ থমকে যায় তা আজ পর্যন্ত ঠিক-ঠিকভাবে বোঝা যায়নি। তবে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা শুরু হলে অনেকখানিই কিন্তু বাগে আনা যায় এই অসুখকে। এমনকী সারিয়েও দেওয়া যায় শ্বেতী। কীভাবে? পরে আসছি সে-কথায়।
শরীরের কোনো অংশে কেটে গেলে, ছড়ে গেলে সাধারণত শুকিয়ে যাবার পর কিছুদিন একটা হাল্কা বাদামী রঙের দাগ থাকে। আর পরে সেটাও মিলিয়ে যায়।
কিন্তু শ্বেতী সক্রিয় থাকলে ত্বকের আঘাতপ্রাপ্ত অংশটা শুকিয়ে গিয়ে সেখানে কিন্তু ফুটে উঠতে পারে নতুন সাদা দাগ। একে বলে কোয়েবনার’স ফেনোমেনন। কিছু কিছু সময়ে এই কোয়েবনার’স ফেনোমেনন দিয়েই সূচনা হতে পারে শ্বেতীর।
এছাড়াও মানসিক চাপ, আঘাত থেকেও কিন্তু অবনতি হতে পারে শ্বেতীর। গর্ভারস্থায় এবং প্রসবের পর অনেক সময় বেড়ে যেতে দেখা যায় সাদা দাগ।
ভ্যালেসিও ধরনের শ্বেতী বেশ মারাত্মক। হঠাৎ হয়, দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ছড়িয়ে পড়ে সর্বাঙ্গে। তবে স্বস্তির কথা এই ধরনটা সাধারণত কমই দেখা যায়।
শ্বেতীর ধরনের কথা যখন উঠলই, তখন আর একটু বিস্তারিত ধারণাই করে ফেলা যাক।
সাধারণভাবে বলতে গেলে শ্বেতী দু’রকমেরঃ
- ভিটিলিগো ভালগারিস
- ভিটিলিগো সিউডোসেগমেন্টালিস
‘ভালগারিস’ কথাটির অর্থ হল ‘কমন’ বা সাধারণ। এই ধরনের শ্বেতী সারা শরীরে জুড়ে হতে পারে। শরীরে দু’দিকে সামাঞ্জস্যপূর্ণভাবে হতে পারে এর বিস্তার। আবার এরই একটা ধরনে হাত-পায়ের আঙুল, তালু, ঠোঁট এবং যৌনাঙ্গ বা পায়ুর আশেপাশে হতে পারে। একে বলে অ্যাক্রো-অরিফিসিয়াল টাইপ। আর একটা ধরন হল লিপ-টিপ। নামেই মালুম, ঠোঁটে আর আঙ্গুলের ডগায় হয় এই ধরনের শ্বেতী। এর চিকিৎসা কিন্তু বেশ শক্ত। কেন শক্ত, সে কথায় পরে আসব।
সেগমেন্টাল ভিটিলিগো হয় শরীরের যে-কোনো একটা দিকে। এক বা একাধিক ডার্মাটোম-এর বিস্তার বরাবর (ডার্মাটোম হল ত্বকের সেই নির্দিষ্ট অংশ, যাতে একটা স্পাইনাল নার্ভ ক্রিয়াশীল)। তবে সবসময় এক-একটি ডার্মাটোম বা নার্ভ-সেগমেন্ট মেনেই যে সীমাবদ্ধ থাকে এর বিস্তার, তা নয়। তাই ওই সিউডোসেগমেন্টালিস কথাটা বেশি সুপ্রযুক্ত।
এর বাইরেও ফোকাল ভিটিলিগো বা স্বল্প জায়গায় সীমায়িত শ্বেতী দেখা যায়।
শ্বেতীর ইতিকথা
প্রাচীন পুঁথির হলদে হয়ে যাওয়া পাতা উলটে যা পাওয়া যায় তা শুধু উল্লেখযোগ্য যে তাই নয়, কখনও কখনও যথেষ্ট বিস্ময়করও।
খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ সাল বা তারও আগে ঋগ্বেদে এই বিশেষ রোগটার উল্লেখ মেলে। সেখানে এর নামটা বেশ মজার—‘কিলাস’। যার মানে হল সাদা চিতল হরিণ। তবে সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ উল্লেখ বলতে যা বোঝায় তা প্রথম পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ২২০০সালে রচিত ইরানি পুঁথি ‘তারখ-এ-তিবল-এ-ইরান’-এ। যেখানে অ্যাসিরীয় সভ্যতার সময় এ অসুখের কথা বলা হয়েছে। মানব ইতিহাসের প্রাচীন্তম সভ্যতাগুলোর একটা মিশরীয় সভ্যতা। ১৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্যাপিরাসে মিলেছে এ-রোগ সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য।
প্রায় সমসাময়িক ভারবর্ষে খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ সাল নাগাদ রচিত অথর্ববেদে এই রোগটাকে চিহ্নিত করা হল ‘শ্বেতীকুষ্ঠ’ বলে। সূচনা হল পরবর্তী সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে চলে আসা এক মারাত্মক ভুল ধারণার।
আমাদের দেশে আজও অনেকে শ্বেতীকে কুষ্ঠরোগের একটা প্রকারভেদ বলেই মনে করে থাকেন। স্পষ্টভাবেই বলা যাক, এই ধারণাটা সম্পুর্ণ ভিত্তিহীন।
তবে ওই অথর্ববেদেই কিন্তু বিস্ময়করভাবে মেলে শ্বেতীর চিকিতসার প্রথম সঠিক ওষুধের নাম। সেখানে উল্লিখিত ‘ভাসূচিকা’ আর কিছু নয়, এ-রোগের চিকিৎসায় আজও ব্যবহৃত একটা লতা। এর বীজ থেকে পাওয়া যায় Furocoumarin নামের ওষুধটা।
প্রাচীন চীনা-পুঁথিতে অনেকটা একই রকম একটা ওষুধের কথা পাওয়া যায়, যার নাম ‘পু-কু-সি’। ত্রয়োদশ শতকে মিশরের ইবন-এব-বিতার উল্লেখ করেন ‘অ্যাম্মি মেজাস’ নামে একটা গুল্ম প্রকৃতির উদ্ভিদের কথা। সাতশো বছর পর বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্থে ওই ‘অ্যাম্মি মেজাস’ থেকে নিষ্কাশিত করা সম্ভব হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ‘ফুরোকুমারিন’।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র পুস্তক ত্রিপিটকের একটা ভাগ হল ‘বিনয়পিটক’। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে লেখা এই পুস্তকে শ্বেতীকে ঋগ্বেদের অনুসরণে ‘কিলাস’ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে শ্বেতীকে কুষ্ঠের একটা ধরন বলে ভুল ধারণাটি যে শুধু অথর্ববেদেই পাওয়া যায় তা নয়, ওল্ড টেস্টামেন্টে সাদা দাগের বিবরণ দেওয়া আছে Leviticus Chapter 13-এ। সেখানে হিব্রু ‘জোরা আট’ (Zora at) শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে এই রোগটার কথা বোঝাতে। দুর্ভাগ্যবশত বাইবেলের গ্রীক এবং ইংরেজি অনুবাদে শব্দটা বদলে গিয়ে হয়েছে ‘লেপ্রা’ অর্থাৎ কুষ্ঠ!
তবে ‘ভিটিলিগো’ শব্দটা যে ঠিক কীভাবে এল তা আজও স্পষ্ট নয়। ল্যাটিন শব্দ ‘ভিটিলিয়াস’ যার অর্থ ‘বাছুরের হালকা গোলাপি মাংস’, অনেকের মতে এটাই উৎস। আবার ওই ল্যাটিন শব্দকোষেরই আর একটা শব্দ ভিটিয়াম মানে কলঙ্ক। অনেকের বিশ্বাস, ‘ভিটিলিগো’ শব্দ এসেছে এই শব্দটা থেকে।
বিখ্যাত রোমান চিকিৎসক সেলসাস দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক উনিশশো বছর আগে প্রথম ‘ভিটিলিগো’ শব্দটা ব্যবহার করেন এই বিশেষ ত্বকরোগটাকে বোঝাতে।
শ্বেতীর সুরাহা
অসুখটা যেমন গোলমেলে, বহু বছর ধরে চলে আসা এর চিকিৎসাগুলোও তেমনই হতাশাজনক ছিল। অন্তত রীতিগত মেডিক্যাল চিকিৎসা। আজ পর্যন্ত বহু ওষুধ ব্যবহৃত হয়েছে শ্বেতী সারাতে। কিন্তু ইশপের গল্পের সেই অতি চালাক শেয়ালের মতো (যে পালানোর হাজারটা উপায় জানত, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কোনোটাই কাজে লাগাতে পারেনি) সেই ওষুধগুলোর অধিকাংশুই কাম্য ফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তবে হ্যাঁ, সোরালেন আবিষ্কারের পর শ্বেতীর চিকিৎসায় কিন্তু বিপ্লব এসেছে। জেগেছে আশার আলো। সঠিক সময়, ওষুধের ঠিকঠাক প্রয়োগে, মেডিক্যাল চিকিৎসাতেই আরোগ্য লাভ করেছেন বহু রোগী। ট্রাইমিথকসিসোরালেন, ৮-মিথকসি-সোরালেন—এই দুটো ওষুধই ব্যবহৃত হয় বেশি। ইদানীং আবার ৫-মিথকসিসোরালেন ব্যবহার শুরু হয়েছে।
সোরালেন শ্বেতীর চিকিৎসায় কাজ করে অতিবেগুনি রশ্মির সঙ্গে হাত মিলিয়ে। অর্থাৎ Psoralen+Ultraviolet-a Radiation বা সংক্ষেপে PUVA শ্বেতীর চিকিৎসায় যুগান্ত এনেছে। সোরালেনের ব্যবহার দু’ভাবেই হয়। খাবার ওষুধ হিসেবে এবং লাগাবার মলম বা লোশন হিসেবে। এই লাগানোর সোরালেন নিয়ে চিকিৎসকের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হয়। নইলে বিপদ। রোগগ্রস্ত অংশটিতে ত্বক লাল হয়ে ফোস্কা পড়ে ঝলসে যেতে পারে।
এছাড়াও আর একটা অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধ হল কর্টিকোস্টেরয়েড। এক্ষেত্রেও মুখে খাবার, ইঞ্জেকশন অথবা লাগানোর মলম, জেল, লোশন সব ভাবেই প্রয়োগ করা হয় স্টেরয়েড। বিশেষ করে যে-সমস্ত ক্ষেত্রে অন্য চিকিৎসায় ফল মেলেনা সেভাবে, অথবা দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়া অসুখে স্টেরয়েডের সুচিন্তিত এবং সুপরিকল্পিত প্রয়োগ কার্যকারী হতে দেখা যায়।
ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন বেশ কাজ দেয় কোনো কোনো শ্বেতীতে। যেমন নীচের ঠোঁটে বা শরীরে অন্য কোনো সূর্যস্নাত অংশে।
এছাড়াও বহু ওষুধ প্রয়োগ করেছেন চিকিৎসা-বিজ্ঞাবীরা শ্বেতীর চিকিতসার লক্ষ্যে। ফল হয়েছে মিশ্র। যেমন-ফিনাইল অ্যালানিন, খেলিন, লিভামিসোল, ফেনোথায়াজিন, গ্রিসিয়োফাল্ভিন, ৫-ফ্লুরোইউরাসিল, ক্লোফাজিমাইন, এমনকী হ্যাঁ ড্যাপসনও।
১৯৮৬ সালে কিউবা থেকে এল প্ল্যাসেন্টা (গর্ভফুল)-র একসট্র্যাক্ট। বিশ্ব জুড়ে হইহই পড়ে গেল। এসেই গেল বুঝি শ্বেতীর মহৌষধ। আজ আরো দেড় দশক পেরিয়ে এসে দেখা যাচ্ছে, ঝড় থেমে গেছে। থিতিয়ে গেছে সব। শ্বেতীর মূল ওষুধ হিসেবে নয়, অনেকগুলো ওষুধের একটা হিসেবে থেকে গেছে এটা।
তবে যত চিকিৎসাই হোক না কেন, শ্বেতী কিন্তু আজও রহস্যময়। তার উৎস, চলন ইত্যাদি বিষয়ে কিছু জিনিস জানা গেলেও অজানার আঁধারে থেকে গেছে অনেকখানিই।
আগেই বলেছি লোমের গোড়ায় থাকা হেয়ার ফলিকল রঞ্জক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শরীরের লোমশ অংশে, যেমন—মুখে, গালে, হাতে (নিম্নবাহু), পায়ে, ঊরু এবং হাঁটুর নীচের অংশে রোদ পড়ে, সে-সমস্ত অংশে রং ফেরেও দ্রুত। লোমের গোড়ার চারদিকে প্রথম ফিরে আসে রং। একে বলে পেরিফলিকুলার পিগমেন্টেশন। তবে ঠোঁট, হাত ও পায়ের নীচে, লিঙ্গমুন্ডে, অর্থাৎ যেসব জায়গায় আদৌ কোনো লোম তথা হেয়ার ফলিকল নেই সেইসব জায়গায় শ্বেতী সারতে বেশ সময় নেয়। আবার হাড়ের ওপর, যেমন—কনুই, হাঁটু বা পায়ের গোড়ালির আশেপাশে শ্বেতীর দাগও বেশ একগুঁয়ে স্বভাবের। সারতে চায় না।
তাই অনেক রোগী বিভ্রান্ত হয়ে মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দেন বা বিভিন্ন ধরনের ‘প্যাথি’র শরণাপন্ন হন। ফল হয় ভয়াবহ। রোগ তো বেড়ে যায়ই, অনেক সময় অনেক বিতর্কিত মলম লাগিয়ে বীভৎসভাবে পুড়েও যায় ত্বক। বিপদ এঁদের নিয়েই।
(চলবে)