আর্টিকেলটি অমর্ত্য সেনের লেখা। ১৫ মার্চ (২০২০), ফিনান্সিয়াল টাইমস এ প্রকাশিত।
অনুবাদ করেছেন ডাঃ রেজাউল করিম।
“আবার হবে তো দেখা”, ১৯৩৯ সালের সেই কালজয়ী গানের একটি কলি গেয়ে সম্প্রতি রানী এলিজাবেথ করোনা মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন। এই মূহুর্তে সবচেয়ে জরুরি ভাবনা এই ভাবনা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু, করোনা পরবর্তী পৃথিবী কেমন হবে? সঙ্কটকালে মানুষের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কাছে শিক্ষণীয় কিছু কি আছে?
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের আগেও পৃথিবী জুড়ে ভয়াবহ সমস্যা তো কম নেই। দেশে থেকে দেশান্তরে আছে পারস্পরিক অসাম্য। আভ্যন্তরীণ অসাম্যও আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। এর ফলে অনেক মানুষ অহেতুক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিতে খরচ কমানোর অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সংকটাপন্ন মানুষের জন্য সরকারী সহায়তা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ব্রাজিল থেকে বলিভিয়া, পোল্যান্ড থেকে হাঙ্গেরি সর্বত্র অগণতান্ত্রিক নীতি বেড়েছে।
সারা পৃথিবী জোড়া সম্মিলিত প্রয়াস কি এই সব চলতি সমস্যা সমাধানে কোন সাহায্য করবে?
সবাই একসাথে কাজ করা দরকার। কারণ তা গঠনমূলক সামাজিক কাজ করার প্রেরণা জোগায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে মানুষ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব অনুভব করতে পেরেছিলেন। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার, বিশ্ব ব্যাংক এইসব প্রতিষ্ঠানের জন্ম যে সময়ে সেই ১৯৪৪-‘৪৫ সালের কিছুদিন আগেই ভেরা লীন গেয়েছেন “আবার হতে তো দেখা” গানটি।
কিন্তু, সংকটকালে আহরিত এই অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট দেশগুলির আভ্যন্তরীণ কোন উন্নতি সাধন কি করতে পেরেছে? আমরা খানিকটা দেখতে পেয়েছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কঠিন সময়ে ব্রিটেন জুড়ে খাদ্যের ঘাটতি ছিল। তবু, অপুষ্টি স্পষ্টতই কমেছিল। খাদ্যপণ্যের বড় সরবরাহ-সঙ্কট সত্বেও ব্রিটেন রেশন ব্যবস্থা ও সামাজিক সংহতির মাধ্যমে সুষম বন্টন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির শিকার মানুষের সমস্যা আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছিল। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়ও ঠিক এটাই ঘটেছিল।
এর ফল হয়েছিল অসাধারণ। যুদ্ধের দশকে ব্রিটেনে পুরুষদের বেঁচে থাকার সম্ভাব্যতা সূচক ইংল্যান্ড ও ওয়েলস এ বেড়েছিল ৬.৫ বছর আগের দশকে যে হার ছিল ১.২ বছর। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হার আগের দশকের ১.৫ থেকে অনেকটা বেড়ে হয়েছিল ৭বছর। সাম্য ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য অতিরিক্ত নজরদারির ইতিবাচক শিক্ষা পরবর্তী সময়ে কল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থা উন্নীত হয়। এনুরিন বেভান, যিনি যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে আরো বেশি সাম্যের সমর্থনে জনমত তৈরী করতেন, ম্যানচেস্টার পার্ক হাসপাতালে জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা উদ্বোধন করেন। তখন ১৯৪৮ সাল।
বর্তমান সঙ্কটের অভিজ্ঞতা থেকে কি এইরকম কোন ইতিবাচক কিছু ঘটবে? সঙ্কট নিরসনে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা নিশ্চিতভাবে নির্ভর করে কিভাবে তার মোকাবিলা করা হয় ও কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় তার উপরে।
শাসিত ও শাসকের সম্পর্কসহ রাজনীতি এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ জনতার জন্য যখন খাদ্য ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সাম্য তৈরী হচ্ছিল তখন ১৯৪৩ সালের ভীষণ দুর্ভিক্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরই অংশ বাংলায় প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার তা প্রতিরোধের কোন উদ্যোগই নেননি।
বর্তমান অতিমারীর বিরুদ্ধে যে নীতি নেওয়া হয়েছে সাম্যের ধারণাটি সেখানে দৃষ্টিগ্রাহ্য অগ্রাধিকার পায়নি। আমেরিকায় সাদা চামড়ার নাগরিকদের তুলনায় আফ্রিকা বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের কোভিড 19 জনিত মৃত্যুহার ভয়ানক বেশি। শিকাগোয় মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের, অথচ সংখ্যার হিসেবে তারা মোট জনসংখ্যার মাত্র এক তৃতীয়াংশ। এই ভোগান্তির আভ্যন্তরীণ প্রভেদ ব্রাজিল থেকে হাঙ্গেরি ও ভারতবর্ষেও কম নয়।
ভারতের উদাহরণ এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রবল অসাম্য রয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলে দুর্ভিক্ষ হয়নি। তা সত্বেও গণবিতর্ক- যা বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরে, রাজনৈতিক ভাবে অর্থপূর্ণ ও বিপদগ্রস্তদের ত্রাতা- সরকার তা সঙ্কোচনের প্রয়াস করছেন। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাও সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ধনীদের জন্য ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থার বিপরীতে রয়েছে দরিদ্র মানুষের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা, যা শালীনতার মানেও নিম্ন। তার সাথে রয়েছে নিষ্ঠুর আধুনিক জাতিবৈষম্য। অতিমারীর মোকাবিলায় বৈষম্যের অবসান হলে ভারতের সুবিধা হতো। তা সত্বেও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার জন্য বিশেষ কোন উদ্বেগ নেই। তার পরিবর্তে হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রণ ও লকডাউনের দিকে দৃষ্টিপাত করেছে (বাস-ট্রেনসহ)। কর্মহীন ও কাজের জন্য অন্যত্র অবস্থানরত দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতম মানুষদের কথা কেউ হিসেবের মধ্যে রাখেন নি।
জানা কথা যে শারীরিক দূরত্ব ভাইরাস সংক্রমণ রোধ করতে পারে। (এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই), কিন্তু, এর সাথে স্বল্পকালীন পরিপূরক ব্যবস্থা- রোজকার খাদ্য, স্বাস্থ্যের সুযোগ ও নজরদারি- এই সব সুবিধা লক ডাউনে বিপর্যস্ত মানুষের প্রাপ্য ছিল। ভারত, ও আরো কয়েকটি দেশে, জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার সমতুল্য ব্যবস্থা প্রয়োজন। কিন্তু, যে বিরাট অসাম্য দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত, বর্তমান অতিমারী থেকে সেরকম কোন শিক্ষণীয় নীতি উদ্ভুত হবে না।
দুঃখের কথা, সম্ভবত আবার যখন দেখা হবে, বর্তমান অসাম্যের থেকে উন্নততর কোন অবস্থা আমরা দেখতে পাবো। তা সত্বেও এরকমটি হতে দেওয়া উচিত হবে না। সঙ্কট নিরসনে অসাম্যের বিরুদ্ধে উদ্বেগ অনেক দেশে ক্লিষ্ট মানুষের দুঃখ মোচনের সহায়ক হবে, ভবিষ্যতে অসাম্যের অবসানে নতুন নতুন অনুভূতির জন্ম দেবে। সঙ্কট পথে আমাদের যাত্রার অর্ধাংশ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি, আমরা কি এখনো আশা করতে পারি যে ইতিবাচক কিছু ঘটবে?