কেউ কোভিড আক্রান্ত হয়ে হেল্পলাইনে ফোন করলে, সরকারি এম্বুলেন্স পৌঁছে যাচ্ছে বাড়িতে, আগে থেকে ড্রাইভারের নাম্বার এসে যাচ্ছে এসএমএসে, তারপর অসুস্থ মানুষটিকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেওয়া, সম্পূর্ণ নিখরচায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা করানো এবং অবশেষে ছুটির পর বাড়ি পৌঁছে দেওয়াও হচ্ছে!
কোনো প্রথম বিশ্বের দেশ নয়, এই আপাত অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো ঘটছে আমাদের দেশে, আমাদের রাজ্যে!
অনেকে অনুযোগ করছেন, এই পুরো সময়টা, রোগীর সঙ্গে বাড়ির যোগাযোগ করা যাচ্ছে না!
অন্যদিক থেকে যদি দেখি, তবে বুঝতে পারবো, কোন আত্মীয় স্বজন (অনেক সময়ে তাঁরাও আক্রান্ত) বা তথাকথিত পেশেন্ট পার্টি ছাড়াই কিন্তু চিকিৎসাটা যথাযথ এবং যথাসাধ্যই হচ্ছে!
হয়ত ব্যাপারটা বেশ ভয়ের, শীতল, যান্ত্রিক এবং হ্যাঁ, নৈর্ব্যক্তিক!
কিন্তু কার্যকারীও তো বটে! অচেনা, অজানা, অসহায় সাধারণ নাগরিককে সরকার নিজের ব্যাবস্থাপনায়, দায়িত্ব নিয়ে ডোরস্টেপ টু ডোরস্টেপ পরিষেবা দিচ্ছেন, বিনা শুল্কে এ অভিজ্ঞতা আমাদের আগে হয়েছে কি?
অনাত্মীয় সরকারি এম্বুলেন্সের ড্রাইভার আই ডি হাসপাতালে বৃদ্ধ অশক্ত অসুস্থ দম্পতিকে পৌঁছে দিয়ে বলছেন, চিন্তা করবেন না ম্যাডাম, আমি বাইরেই আছি, দুজনে ভর্তি হয়ে গেলে একটা ফোন করে দেবেন!
আর অসুবিধে হলে, জানাবেন, চলে আসবো!
দেখেছি আগে?
অথবা রাত এগারোটার পর একা বৃদ্ধ রোগীকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের দিকে যাবার সময় সরকারি এম্বুলেন্সের ড্রাইভার বৃদ্ধের বাড়িতে অসুস্থ আত্মীয়কে ফোন করে বলছেন- রিপোর্টের হার্ড কপিটা লাগবে স্যার, ভর্তির সময়, ওটা তো ওনার কাছে নেই, আপনি রিপোর্টটা আমার মোবাইলে হোয়াটস্যাপ করে দিন, আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি …
শুনেছি কোনোদিন?
না!
কিন্তু এই সব যে কল্পকথা নয় সরকারি প্রচারও নয়, সেটা উপলব্ধি করলাম নিজের কোভিড হবার পর!
একটি কর্পোরেট হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে পজিটিভ হবার কিছুক্ষণ পরেই প্রথম ফোনটা আসল স্বাস্থ্য ভবন থেকে।
সেই শুরু!
তারপর কখনো স্বাস্থ্যভবন, কখনো স্বাস্থ্য দফতর আবার কখনো বা পুরসভা!
হোম কোয়ারান্টাইনের দিনগুলিতে রোজ সরকারের পক্ষ থেকে ফোন করে খোঁজ খবর নেওয়াটা আমাকে অভিভূত করেছে!
যথাযথ কথোপকথন। কখনো যান্ত্রিক, কখনো বেশ আন্তরিক!
প্রতিবারেই আলাদা পুরুষ বা মহিলা কণ্ঠ, ভদ্র, মার্জিত ভাবে জানতে চাইছেন, আজ কেমন আছি!
খুব গায়ে পড়া গলায় না হলেও যথেষ্টই উষ্ণ, আন্তরিক স্বরে!
-কেমন আছেন আজ? কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? ওষুধ পত্র খাচ্ছেন তো নিয়মিত? প্রেশার, শ্যুগারের সমস্যা ছিল না কি কোনদিন? বাড়ির অন্যরা ঠিক থাকে আছেন তো?
এই প্রশ্নগুলি ছাড়াও যে কথাটায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম
– একটু রেস্টে থাকুন কদিন, পুষ্টিকর খাবার খান, জল খান বেশি করে, মাথাটা হালকা রাখুন আর হ্যাঁ ভালো ভালো সিনেমা দেখুন আর গল্প-কবিতার বই পড়ুন!
দেখবেন সময়টা সুন্দর কেটে যাবে!
এর পরেও আছে!
-কেমন আছেন স্যার? কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? নামগুলো একটু কনফার্ম করে নি স্যার!
বাড়ির দরজায় দুজন রুগ্না মাঝবয়েসী মহিলা, মুখে মাস্ক, পরণে আটপৌড়ে শাড়ি!
ওঁরা এসেছেন কর্পোরেশন থেকে
-জ্বর আসছে না তো স্যার? নিঃশ্বাসের কোনো অসুবিধে? বাড়ির অন্যরা ঠিক আছেন তো? আজ আপনাদের কতদিন হলো যেন?
কথা বলছেন আর খাতায় লিখে নিচ্ছেন মনোযোগ দিয়ে।
-ছেলে তো নেগেটিভ, ও সাবধানে আছে তো? ওকে একটু ক্লোরোকুইন দিয়ে যাই?
ঘাড় নাড়ি।
তার পর কাঁধের ঝোলায় খোঁজাখুঁজি শুরু, নেই!
-সে কি রে! শেষ হয়ে গেলো, এ রাম! আমরা স্যার এখুনি দিয়ে যাচ্ছি চিন্তা করবেন না!
তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠুন স্যার সবাই মিলে।
আপনা থেকেই দুহাত জোড় হয়ে গেলো বুকের কাছে!
অজান্তেই আমার ঠোঁট নড়ে উঠলো, ফিসফিস করে বললাম- আপনারাও ভালো থাকুন দিদি, সাবধানে থাকুন!
ওঁরা ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেছেন! আমার কথা ওঁদের কানেও পৌঁছলো না!
এটা আলাদা করে কোনো রাজ্য সরকারের করে প্রশংসা করছি না!
সারা দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই কম বেশি একই ছবি!
একটা তৈলাক্ত মেশিনের মত অবিরাম, অক্লান্ত কাজ করে চলেছেন চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী, ড্রাইভার, পুলিশ, সাফাইকর্মী, শিক্ষক!
সারা দেশ এক অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা!
আমাদের মধ্যেই ছিল এই নিয়মানুবর্তিতা, এই শক্তি, আমরা জানতামই না!
দুর্গাপুজো, কালীপুজো পেরিয়ে, একটু একটু করে ছন্দে ফিরছে সব কিছু।
রুজিরুটির জন্য অজস্র মানুষ রোজ ফের গণপরিবহণ ব্যবহার করছেন, শারীরিক দূরত্ব বিধি সেখানে বিলাসিতা, অবাস্তবও!
প্রথম ঢেউ আমরা পেরিয়ে গিয়েছি, দ্বিতীয় ঢেউ কবে আসবে, সুনামি হবে কি না জানি না!
রোগটা নতুন, রোগলক্ষণ নির্দিষ্ট নয়, চিকিৎসা নিয়ে কোনো ঐক্যমত্য নেই, কার্যকরী আর নিরাপদ প্রতিষেধক এখনও নিশ্চিত ভাবে হাতে আসে নি , অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়, ব্যক্তিগত ভাবেও কেউ ভালো নেই কিন্তু তবু সারা দেশ লড়ছে!
রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এতরকমের বিভাজনের মধ্যে একটা একশো আটত্রিশ কোটির গরীব দেশ এক হয়ে লড়ছে!
এই অবিশ্বাস্য, ঐতিহাসিক লড়াইটাই ভ্যাকসিন!
সামাজিক নৈকট্যের এই আন্তরিক আদানপ্রদানটাই প্রতিষেধক!
করোনা একদিন চলে যাবে, কিন্তু আমার দেশের মানুষের এই অদৃষ্টপূর্ব লড়াইটা একটা আত্মবিশ্বাস বুকের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে যাচ্ছে যে, আমরা পারি!
আর করোনা যতবড় দানবই হোক না কেন,
আমরা জিতব!
জিতবই!