(বিরাটির তরুণ গবেষক শ্রীময় ভট্টাচার্য পোস্ট ডক্টরেট গবেষণার সূত্রে ছিলেন সেন্ট্রাল চায়না নর্মাল ইউনিভার্সিটিতে। তার গবেষণার বিষয় হাই এনার্জি ফিজিক্স। এই ইউনিভার্সিটিটি অবস্থিত উহান শহরে, নোভেল করোনা ভাইরাসের পীঠস্থান যেই উহান। দেশে ফিরে ডক্টরস ডায়লগের জন্য কলম ধরলেন তিনি। তার কলমে পড়ুন উহান থেকে ফিরে। আজ প্রথম পর্ব।)
১.
গতকাল দুপুরে অবশেষে দেশে পৌঁছাতে পারলাম। জানি না আমি সুস্থ কি না। জানিনা এই ভাইরাস আমার শরীরে ঘাঁটি গেঁড়েছে কি না। শুধু বুঝতে পারছিলাম ওই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না।
দেশের মাটিতে যখন প্লেনের চাকা আগুন ধরালো তখন সকাল ৯ টা। জানলা দিয়ে দেখলাম আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে উষ্ণতামাপক যন্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছেন আপাদমস্তক সাদা পলিথিনে মোড়া কিছু মানুষ। এই অভ্যর্থনায় আমরা ঠিক কতটা উষ্ণ, তা থার্মোমিটারে মেপে নিয়ে আমাদের সেনাবাহিনীর বাসে তুলে দেওয়া হল। শুনলাম আমাদের গন্তব্য মানেসর সেনা নিবাস।
বাস এসে নামালো প্রায় জনমানবশূন্য একটা জায়গায়। কাছে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ক্যাম্প টেন্ট, আর তারই মাঝে মাঝে লম্বা লম্বা কয়েকটা ছাউনি দেওয়া ঘর। এই ঘর গুলোই আমাদের আগামী চোদ্দ দিনের ঠিকানা।
একটা লম্বা ঘর। ডানদিক বাঁদিক মিলিয়ে পাশাপাশি ২২টা খাটিয়া, তোষক কম্বল বালিশ গায়ে চাপিয়ে শুয়ে আছে। আমরা একে একে যে যার মত ছড়িয়ে গেলাম একেক বিছানায়। এখন ঘরটা অনেকটা মেডিকেল কলেজের জেনারেল ওয়ার্ড এর মত দেখতে লাগছে। তফাৎ শুধু এটুকুই, এখানে আমরা জানিনা আমরা সুস্থ না অসুস্থ।
গত ২৩শে ডিসেম্বর থেকে ৩১ শে জানুয়ারি অব্দি আটকে ছিলাম চীনে, নিজের তিন কামরার ফ্ল্যাটে।
প্রতি মূহুর্তে মনে হত জ্বর আসছে না তো, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না তো। সারাদিন মেঘলা থাকতো। সূর্য উঠলে মনে হত আশার আলো নিয়ে গোটা আকাশ আস্বস্ত করছে আমায়। ভেবেছিলাম দেশে ফিরলে এই ভয় হয়তো চলে যাবে। এখানে আকাশ পরিষ্কার, রোদ উঠেছে ঝলমলিয়ে, তবু ভয় যায় নি। আশেপাশে তাকালে যে সব অর্ধনগ্ন মুখাবয়ব দেখতে পাচ্ছি, তাদের বেরিয়ে থাকা চোখেও একই ভয়। আমরা সবাই ভীত আমাদের এই ভয়ের রাজত্বে। যে কোনও দিন, যে কোনও মূহুর্তে আমরা চিহ্নিত হতে পারি আক্রান্ত হিসেবে। মাঝেমধ্যে মুখের ওপর পরানো এই মাস্কটা দেখে নিজেই নিজের পরিচয় জানতে চাইছি। উত্তর আসছে “ব্যারাক ১২, ২১ নম্বর বেড।”