পুরো জীবদ্দশায় কৃমি হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। বিভিন্ন কৃমির মধ্যে শৈশবে কুঁচো কৃমির প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, যার ইংরেজি নাম ‘পিন ওয়ার্ম’ আর বৈজ্ঞানিক নাম এন্টেরোবিয়াস ভারমিকুলারিস। এই কৃমি ছাড়াও অন্য অনেক ধরনের কৃমি মানুষের হতে পারে।
সন্ধে হলেই বাড়ির শিশুটির অধো আধো গলায় ‘মাম মাম কুটু কুটু’ বলে মলদ্বারের দিকে হাত দেওয়া আমাদের কাছে খুব একটা অপরিচিত না। শতকরা প্রায় ৬১ভাগ ভারতীয় শিশুই কুঁচো কৃমির সমস্যায় ভোগে। তাই এই সম্পর্কে দু চার কথা জেনে রাখা খুব দরকার।
কুঁচো নামটার মধ্যে থেকেই এই কৃমির আকৃতির বর্ণনা কিছুটা তো অনুমান করাই যায়। দৈর্ঘ্যে পুরুষরা ২-৫ আর মহিলারা ৮-১৩ মিলিমিটার হয়। এদের মানব শরীরে প্রবেশ ডিম হয়েই। মুখ দিয়ে ডিমগুলি প্রবেশ করার পর ক্ষুদ্রান্ত্রে গিয়ে ডিম ফুটে লার্ভার জন্ম। তারপর সেগুলি খাদ্যরস খেয়ে পেটের মধ্যেই বেড়ে ওঠে আর পূর্ণাঙ্গ কীটে পরিণত হয়। তারপর অন্ত্রের মধ্যেই এই স্ত্রী ও পুরুষ কীটের মিলন হয়। মিলনের পর পুরুষ কীট যায় মরে আর নির্গত হয় পায়খানার সঙ্গে। আর মহিলাটি প্রায় এগারো থেকে ষোল হাজার পর্যন্ত ডিম ধারণ করে। এর পর ডিম পাড়ার পালা। ডিম পাড়তে গেলে দরকার হয় বেশি অক্সিজেনের। তাই ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে তারা বেরিয়ে আসে মলদ্বারের বাইরে। মলদ্বারের বাইরের চামড়ার মধ্যে বা মহিলা শিশুদের যৌনাঙ্গের মধ্যে তারা ডিম পাড়ে। ডিমের গায়ে চটচটে পদার্থ দিয়ে তারা লেগে থাকে চামড়ায়। স্ত্রী কীটের গায়ে থাকা একধরনের কেমিক্যালের কারণে খুব চুলকায় বা জ্বালা করে ঐ জায়গাগুলিতে। মলত্যাগের পর ভাল করে জলশৌচ করলেও অনেক সময় এই কৃমির ডিমগুলি ধুয়ে যায় না। শৌচ করার পর খুব ভাল করে সাবান দিয়ে হাত না ধুলে কৃমির ডিমগুলি হাত বা নখের মধ্যে রয়ে যেতে পারে। রাত্রে পরা অন্তর্বাসের মধ্যে ও জামাকাপড়ে, বিছানার চাদর, আসবাবপত্র এবং খেলনার মধ্যে এই ডিমগুলো লেগে থাকে ও সেখান থেকে আবার মুখে চলে যায়। অনেকসময় আঙ্গুল মুখে দেওয়ার বদ অভ্যাসের ফলেও এই কৃমির ডিমগুলি পেটে চলে যায়। রাতে পরা প্যান্ট বা চাদর জোরে ঝাড়ার ফলে অনেক সময়ই এই ডিমগুলি হাওয়ার মাধ্যমে মেঝেতে ও ঘরের চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। খোলা খাবারের মধ্যে ও মিশে যেতে পারে।
পেটে কৃমির হাওয়ার উপসর্গ:
* ক্ষুধামান্দ্য
* বমি বমি ভাব
* ওজন কমে যাওয়া
* পেট কামড়ানো
* বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলা
* যোনির প্রদাহ
* মলদ্বারে চুলকানি ও সংলগ্ন চামড়ায় ক্ষত
* অস্থিরতা ও ঘ্যানঘ্যান করা
* মলদ্বার দিয়ে ছোট ছোট সাদা কৃমি বেরিয়ে আসা
* ঠিক করে ঘুমোতে না পারা
* কম হলেও ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনও হতে পারে।
কোন কোন অভ্যাস কুঁচো কৃমির ইনফেকশন প্রতিরোধে সাহায্য করবে?
* জলশৌচ করার পর ভাল করে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করা।
* খাবার খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করা।
* হাতের নখ নিয়মিত কাটা।
* অযথা মুখে হাত না দেওয়া আর মুখ দিয়ে দাঁত কাটার আর আঙ্গুল চোষার অভ্যাস ত্যাগ করা।
* রাতে পরা জামাকাপড় নিয়মিত সাবান দিয়ে গরম জলে পরিষ্কার করা।
* খাবার বেশিক্ষণ খোলা না রাখা।
* মাটিতে পড়ে যাওয়া খাবার কুড়িয়ে না খাওয়া।
চিকিৎসা
ডাক্তারবাবুরা বয়েস ও ওজন দেখে অ্যান্টিহেলমিন্থিক ওষুধ দিয়ে কৃমি মারার ব্যবস্থা করবেন। এখানে একটা কথা বলা খুব জরুরী, সব ঋতুতেই এই ওষুধ খাওয়া যায়। শীত আর বর্ষার জন্যে অপেক্ষা করতে গিয়ে কৃমি আরও বেশ কয়েকগুণ বেড়ে বসে থাকবে আর শিশুটি অপুষ্টির শিকার হয়ে যেতে পারে। একটা জিনিষ জেনে রাখা খুব জরুরি, ওষুধ কিন্তু শুধু পূর্ণবয়স্ক কীট গুলিকেই মারতে পারে ডিমকে নয়। ডিম ফুটে কৃমির বাচ্চার জন্ম নিতে প্ৰায় ২-৪ সপ্তাহ সময় লাগে। তাই একবার ওষুধ দেওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ কীটগুলি মরলেও অনেক ডিম পেটে রয়ে যেতে পারে। সেগুলি ২-৪ সপ্তাহে নতুন কৃমির জন্ম দিতে পারে, তাই দু সপ্তাহ পরে আর একবার ওষুধ খেতে হয়। আর ওষুধটি সপরিবারে খাওয়াই ভাল। ওষুধটি খাবার পরে যদি উপযুক্ত সতর্কতা না নেওয়া যায়, তবে কিছুদিনের মধ্যেই আবার ইনফেকশন (রিইনফেকশন)-এর সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে।