গোলিয়াথ শব্দের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ছেলেবেলায়। তখন সিক্সটিক্সের ছাত্র হয়তো। আমাদের সাবেক বাসাবাড়িতে নতুন ভাড়াটে হয়ে এলেন সন্তোষ দাস, ব্যাচেলর মানুষ।কাজ করেন দমদম গান শেল ফ্যাক্টরিতে। বাঙালি খৃষ্টান। একা হাতে সংসারের সবকিছু ঠিকঠাক সামলাতে পারছেন না দেখে কিছুদিন বাদে নিয়ে এলেন বিধবা মাকে। মহিলার ছোট্ট চেহারা,একটু গোলগাল গড়ন। একসময় আয়ার কাজ করতেন। সন্তোষ দা অফিসে চলে গেলে মানুষটিকে সারাদিন একাই কাটাতে হতো। ছুটিছাটার সময়ে আমরা তিন ভাইবোন গিয়ে মাসিমার সঙ্গে নানান কথা বলে সময় কাটাতাম। আমাদের ত্রিবেণী বাগধারাটির কথকতা মাসিমার খুব পছন্দের ছিল। যাইহোক আলাপের পর্ব একটু জমে উঠতেই মাসিমার কাছে গল্প শুনতে চাইলাম আমরা। এই আবদার সূত্রেই মাসিমা আমাদের একদিন শোনালেন বাইবেলের গল্প – ডেভিড ও গোলিয়াথ।
মাসিমা গল্পের লাটাই খুলে সুতো ছাড়েন –
– গোলিয়াথ হলো এক বিশাল চেহারার ফিলিস্তিনি দৈত্য…
– আমাদের রাবণ রাজার মতো?
– তার থেকেও বড়ো, যাকে বলে প্রকাণ্ড। আর শরীরেও তেমন শক্তি ! লম্বায় প্রায় সাড়ে ছয় হাত ! সামনে এসে দাঁড়ালেই অন্যরা সব ভিরমি খেত ।
আগেই বলেছি যে Goliathus বর্গের অন্তর্ভুক্ত এই বিটল্ বা গুবরে পোকাটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পতঙ্গদের মধ্যে একটি। এই বর্গের আবার পাঁচটি বিশিষ্ট সদস্য রয়েছে। একটি পূর্ণবয়স্ক গোলিয়াথ বিটল্ প্রায় ১১০ মিলিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। অত্যন্ত বর্নিল গাত্র বর্ণের কারণে সহজেই নজর টানে , তবে প্রাকৃতিক নিয়মেই পুরুষদের তুলনায় স্ত্রী বিটলরা কম আকর্ষণীয়। পুরুষ গোলিয়াথ বিটলদের আর একটি আকর্ষণীয় দেহাংশ হলো এদের হর্ণ বা শিং। ইংরেজি Y অক্ষরের মতো দেখতে দুটি শিং ওয়াই অক্ষরের দুটি বাহুর মতো মাথার সামনের দিকে প্রসারিত হয়েছে। স্ত্রী বিটলদের অবশ্য হর্ণ থাকে না।
ক্রান্তীয় বর্ষাবনে খাবারের অভাব নেই। তাই ডিম ফুটে বেরিয়ে আসা শূককীট বা লার্ভারা গাছপালার বর্জ্য পদার্থ খেয়েই ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। কখনো কখনো মৃত প্রাণিদেহর ওপরে হামলে পড়ে মাংসের সোয়াদ নেয়। এভাবে তারা ডালপালা ভেঙে শুধু উদ্ভিজ্জ বর্জ্যের বিয়োজনে সাহায্যের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেনা , এই অর্থে অরণ্য বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় গোলিয়াথ বিটলরা প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে চলেছে।
একান্তই ক্রান্তীয় আফ্রিকার আবাসিক এই বিটলরা একসময় পশ্চিম আফ্রিকার বর্ষা বনের বিস্তৃত অঞ্চলেরই অন্তর্গত সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, গিনি, আইভরিকোস্ট, ঘানা, বুর্কিনা ফাসো, বেনিন, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, দ্য ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, উগান্ডা ও দক্ষিণ সুদানে বিরাজমান ছিল। কিন্তু হায় ! এমনই উপকারী এক আশ্চর্য পতঙ্গ আজ এসে পৌঁছেছে গণবিলুপ্তির শেষ ধাপে। কেন ? তা জানার জন্য আরও কিছু বাড়তি সময় কাটাতে হবে এই অধম কলমচির সঙ্গে।
চকোলেট খেতে আমরা ছোট বড়ো বুড়ো সবাই ভালোবাসি। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের দৌলতে চকোলেট আজ গ্রাম শহরের সাংস্কৃতিক সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে ঘরে। স্বাদ আর ব্র্যান্ডের টানে বিশ্বময় প্রসারিত তার বাজার। মজার ব্যাপার হলো এই, যে দেশগুলোতে চকোলেট তৈরির প্রধান কাঁচামাল কোকো উৎপন্ন হয় , চকোলেট তৈরির ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর উৎপাদিত কোকোর পুরোটাই চলে যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অগ্রণী চকোলেট উৎপাদনকারী দেশশুলোতে।
এই দেশগুলোর অঙ্গুলি হেলনেই চলে কোকোর উৎপাদন। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর অর্থনীতি একান্ত ভাবেই কোকোর রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। ফলে বিশ্ব বাজারে চকোলেটের চাহিদার বাড়া কমার সঙ্গে এই দেশগুলোর উন্নতি অবনতি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। এই দেশগুলোর মধ্যে নিরন্তর টানাটানি চলে বিশ্ব বাজারে কাঁচামাল যোগানের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে। আর তার ফলেই উজাড় হয়ে যায় বনভূমি, বাস্তুচ্যুত হয় বন্যপ্রাণিরা , অস্তিত্ত্বের লড়াইয়ে নিঃশেষ হয়ে যায় কীটপতঙ্গ মায় গলিয়াথ বিটলরা। গাছের রসে লালিত পালিত বিটলরা প্রবলভাবে খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হয় এভাবে নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলার জন্য। পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় সব রাষ্ট্রেরই এই এক হাল। সর্বত্রই বিপন্নতার হাহাকার।
খুব সম্প্রতি এই বিষয়ে মুখ খুলেছেন বিশিষ্ট ইকোলজিস্ট তথা বাস্তু বিজ্ঞানী Luca Lucelli . পশ্চিম আফ্রিকার বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল এই মানুষটি সখেদে জানিয়েছেন যে আইভরিকোস্টে বসবাসকারী ৮০ শতাংশেরও বেশি গোলিয়াথ ক্যাসিকাস প্রজাতির বিটল্
বাগিচা ফসল কোকোর চাষের জন্য জমি বাড়াতে গিয়ে বাস্তুহারা হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পাশাপাশি গোলিয়াথ রিজিয়াস প্রজাতির বিটলদের ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে ঐ একই কারণে। পরিচিত বাস্তুভূমি থেকে জবরদস্তি করে উৎখাত করা হলে বিপন্নতা বাড়ে, বেড়ে যায় অন্ত ও আন্ত প্রজাতির লড়াই। খাদ্য আশ্রয় নিরাপত্তা ও প্রজননের সুরক্ষার অনিশ্চয়তায় ক্ষীয়মান হয়ে পড়ে সদস্য সংখ্যা। আজ গোলিয়াথ বিটলরা এমনই এক সংকটের সম্মুখীন। এই হারিয়ে যাওয়া অবধারিতভাবে আইভরিকোস্ট সহ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে বড়ো রকমের শূন্যতা সৃষ্টি করবে। প্রভাব পড়বে ঐ দেশগুলোর মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায়। অবলুপ্তির উপান্তে এসে দাঁড়ায় গোলিয়াথরা।
ছোটবেলায় পড়া সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গল্পটার কথা মনে পড়ে যায় বারবার। তৃতীয় রিপুর তাড়নায় প্রলুব্ধ হয়ে মানুষ নিজেরাই নিজেদের অস্তিত্বকে সংকটাপন্ন করে তুলছে । কত উদাহরণ আর হাজির করবো ? বাস্তুতন্ত্রের শৃঙ্খলা বিপন্ন হলে আমাদের বিপন্নতা বাড়ে ; এই সহজ সত্যটাকে বুঝে উঠতে আরও কতদিন লাগবে ? গোলিয়াথ বিটলরা হারিয়ে যাবার আগে বুঝতেই পারলো না কি তাদের অপরাধ? মানুষ যখন তার অপকর্মের বিষয়টি টের পাচ্ছে তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক। এই মুহূর্তে আইভরিকোস্ট ও লাইবেরিয়ায় তোড়জোড় চলছে গোলিয়াথ বিটলদের স্বাভাবিক বাসস্থানকে সুরক্ষিত রাখার। বিলম্বিত বোধোদয় হয়তো একেই বলে।
গোলিয়াথ বিটলরা কয়েকটি বিশেষ প্রজাতির গাছ পছন্দ করে তাদের খাবার হিসেবে। বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে সেই সব বিশেষ ধরনের গাছেদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরফলে অবশিষ্ট বিটলদের সংখ্যায় সুস্থিতি আনা সম্ভব হয়েছে খানিকটা। এইসব মূল্যবান পতঙ্গদের নিজেদের সংগ্রহে রাখার একটা ঘাতক প্রবণতা রয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষজনের মধ্যে। স্থানীয় মানুষজনের একাংশ এই অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত। চেষ্টা চলছে যাতে করে তারা নিজেদের ভুল শুধরে নিয়ে সংরক্ষণের কর্মপরিকল্পনাকে সার্থক করে তুলতে পারে। সরকারও চাইছে স্থানীয় মানুষের সক্রিয় সহযোগিতা ও সমর্থন। আন্তর্জাতিক বাজারে এই কীটপতঙ্গের বাণিজ্যিক চাহিদা হ্রাস পেলেই গলিয়াথ বিটলদের সংখ্যায় সুস্থিতি আনা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
পাশাপাশি বনভূমির কিছু অংশে সাধারণ মানুষের অনুপ্রবেশকে বন্ধ করার জন্য আবেদন করা হয়েছে সরকারের কাছে।বিজ্ঞানীরা গোলিয়াথদের কৃত্রিম প্রজননের ব্যাপারে খুব আগ্রহী নন। কেননা তাঁরা মনে করছেন যে এর ফলে বাস্তুতন্ত্র তার সহজাত দান থেকে বঞ্চিত হবে। ব্যাহত হবে স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের স্পন্দন।
গোলিয়াথ বিটলদের বিপন্ন জীবনের স্পন্দন আবার ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম আমরা সবাই।
জবানবন্দি
ছবির জন্য প্রচলিত উৎসগুলোর কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
বুধবার, মার্চ ১২. ২০২৫
খুব সংবেদনশীল তথ্য পূর্ণ লেখা। একটা পতঙ্গের হারিয়ে যাওয়া যে কতটা বেদনার তা ভেবে সত্যিই আপ্লুত হলাম। লেখকের লেখাগুলো সত্যিই অনেক অনেক চিন্তার ফসল। ধন্যবাদ জানাই লেখককে। লিখে যান আমাদের জন্য।
ধন্যবাদ জানাই আপনাকে। বিষয়টি শুধু একটি পতঙ্গের হারিয়ে যাওয়া নয়, গোটা বাস্তুতন্ত্রের শৃঙ্খলা লোপাট হয়ে যাওয়া। উদ্বেগের কারণ এটাই। এই লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো কিছু মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা । আমার পক্ষে লিখে যাওয়া ছাড়া গতি নেই, তাই নিজের একান্ত আনন্দে লিখে চলেছি। ভালো থাকুন। পরিবেশকে ভালো রাখুন।