পান্তুর উৎসাহেই হোক, আর গুপ্তধনের কথাতেই হোক, ছৈনা মন দিয়ে ঠগীদের সম্বন্ধে পড়াশোনা শুরু করল। কেবল থিসিস না, ঠগীদের সম্বন্ধে পান্তুর অনেক বইও ছিল, সেগুলোও মন দিয়ে পড়ে পড়ে পান্তুর সঙ্গে আলোচনা করত।
“ঠগী কি সত্যিই ছিল?”
পান্তু হেসে বলল, “সে নিয়ে তো মত দ্বৈধতা আছেই।”
ছৈনা বলল, “না। ভালো করে ভেবে দেখ — হাজারে হাজারে লোক মারা যাচ্ছে, কয়েক হাজার ঠগী দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে… স্লীম্যানের আগে কেউ তাদের কথা জানতই না? কেউ লিখে যায়নি?”
পান্তু সোফায় শুয়ে ছিল। উঠে বসে বলল, “তুই আজকের ক্রিটিসিজমের কথা বলছিস। তারাও কিন্তু অনেক কথা নিজেদের মতো করে সাজিয়েছে। ঠিক স্লীম্যান যেমন করেছিল। নিজেরা যে কথাগুলো ঠিক বলে মনে করেছে, সেগুলো জোর দিয়ে লিখেছে, যেগুলো ঠিক মনে করেনি, লেখেনি। তুই নিজে ভেবে দেখ — ঠগীরা যত লোক মেরেছে বলে স্লীম্যান আর ওর দলবল দাবী করেছে, তত লোক হয়ত মরেনি। কারণ একটা ঠগীর দলে সবাই খুন করত না। দশ পনেরো জনের দলে কেউ ছিল শমশেরা — হাত পা চেপে ধরত, কেউ ছিল লুহ্গা — কবর খুঁড়ত… এমন অনেকে থাকত যারা খুন করত না। কেউ তো শুধু ভীড় বাড়াতে যেত। অথচ স্লীম্যানরা অনেক সময়েই অঙ্ক করেছে ওইভাবে — একজন ভুর্তোৎ হয়ত বলেছে আমি এক বছরে দু’শো লোক মেরেছি — ওরা দেখেছে তার দলে কুড়িজন রয়েছে, অঙ্কে দেখিয়েছে ওদের দলটা দশ বছরে চার হাজার লোক মেরেছে। এরকম কারচুপি করে নিজেদের দর বাড়িয়েছে, আর ডিপার্টমেন্টের টাকার লগ্নি বাড়িয়েছে। স্লীম্যান নিজেই লিখেছে, যত লোক ঠগীর হাতে মারা যায়, তার অনেক বেশি এ দেশে মারা যায় সাপের কামড়ে। ফলে মৃতের সংখ্যাটা আকাশছোঁয়া ছিল না।”
“তবু তো কোনও রেকর্ড থাকা উচিত ছিল?”
“যারা বলে আগে রেকর্ড ছিল না, তারা আগের রেকর্ডগুলো দরকার মতো ইগনোর করে। বা তাচ্ছিল্য করে। প্রথমত, ভাব, রেকর্ড থাকার কথা ছিল কি? ওই সময়ে ভারতবর্ষে কত চুরি হয়েছে তার রেকর্ড আছে? পথিকদের কাছ থেকে কত টাকা চুরি হয়েছে তার খতিয়ান পাওয়া যাবে? কত খুন হয়েছে কেউ জানে? সব শুরু হয়েছে সাহেবরা আসার পরে। তার ওপর এই খুনগুলো সাধারণত হত নির্জন ফাঁকা জায়গায়। ধর, একটা লোক গোয়ালিয়র থেকে দিল্লি যাচ্ছে। আজকের দিনে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে, ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার — হাঁটলে একটু কম। আগেকার দিনে এ রকম রাস্তা ছিল না। রাস্তাই ছিল না, কাদা-মাটির পথ, চলাচল করা অত্যন্ত কষ্টকর। আজ একটানা হাঁটলে… এই দেখ গুগুল ম্যাপস বলছে ছেষট্টি ঘণ্টা। মানে তিন দিন প্রায়। রাতে বিশ্রাম করতে হবে। অর্থাৎ পাঁচ থেকে ছ’ দিনের ব্যাপার। তখনকার জনবসতিহীন কোনও জায়গায় যদি কোনও পথিককে মেরে ফেলা হত, তার মৃতদেহ কেউ দেখতে পেলেও কাকে গিয়ে রিপোর্ট করবে? তখন তো আজকের মতো গ্রামে গ্রামে থানা ছিল না। আর পুঁতে ফেললে তো কথা-ই নেই। আবার ভাব, যে গিয়েছে, তার বাড়ির লোক জানে কাজে গেছে, ব্যবসা করতে গেছে — যা-ই হোক, কয়েক মাসের আগে ফিরবে না। সুতরাং কেউ বাড়ি থেকে বেরোলে তো তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরুই হত হয়ত ছ-আট মাস পরে। এবং তার পরেও সে কার কাছে যাবে নালিশ করতে? পুলিশ বলে তো ছিলই না কিছু।”
“তুই রেকর্ডের অভাবের কথাটা বলছিস না।”
“সম্রাট জালাল-উদ্দিন-খিলজি প্রায় হাজারখানেক ‘ঠগ’কে নিজের সাম্রাজ্য থেকে লখনৌটি — অর্থাৎ গৌড়ে নির্বাসন দিয়েছিলেন — ১৩৫৬র রেকর্ড।”
“কিন্তু ওরা যে ঠগীই ছিল, তার তো কোনও প্রমাণ নেই।”
“দেখ, তুইও ওই ক্রিটিকদেরই মতো কথা বলছিস। যেটা পছন্দ হবে না, বলবে সেটার প্রমাণ নেই, প্রমাণ থাকলে যে প্রমাণটা এনেছে, সে বাজে লোক। আচ্ছা, বেশ — বাদশা ঔরংজেব ১৬৭২ সালে ফরমান দিয়েছিলেন ফাঁসিগরদের বিরুদ্ধে।”
“সেটা অবশ্য…”
“ঠগী নয়, ফাঁসিগর — তাই তো? ওই একই সুর। তখন ওরা নিজেদের কী বলত তা কেউ জিজ্ঞেস করেছিল?”
“কিন্তু ১৬৭২-এর পরে আবার সেই ইংরেজদের সময়ে? মাঝখানে এতদিন কোথায় ছিল ঠগীরা?”
“ওই যে বললাম — মৃত্যু রিপোর্ট করার কেউ নেই, হারিয়ে যাওয়া মানুষ রিপোর্ট করার জায়গা নেই, দল বেঁধে গেলেও যদি সকলেই মারা যায় একসঙ্গে… খবরটা নিয়ে আসবে কে? ভালো কথা, স্লীম্যানের পঁচিশ বছর আগেও ইংরেজরাই ম্যাড্রাস প্রেসিডেন্সিতে ঠগীদের কাজ কারবার সম্বন্ধে লিখে রেখেছিল, স্লীম্যান জানতই না — সেটা পড়েছিস? পড়িসনি? দাঁড়া। বইটা আমার কাছে আছে — এই নে…”
ছৈনা বইটা নিল, উলটে-পালটে দেখে বলল, “ও, হ্যাঁ, দাঁড়া… ভাষার কথাটাও আমার অদ্ভুত লাগছে। সারা দেশে যত ঠগী একই ভাষায় কথা বলত? ওই রামাসিয়ানা, না কী যেন?”
পান্তু মাথা নাড়ল। “আমার মতে ওটা ভাষা নয়। পরিভাষা। টেকনিকাল টার্ম। সেটা একই হতেই পারে। যদি সত্যিই ঠগীরা বহু শতাব্দী ধরে থেকে থাকে, আর যদি দেশের বিভিন্ন অংশের ঠগীদের সঙ্গে ওদের কাজের সূত্রে দেখা হতেই থাকে, তাহলে কিছু কিছু শব্দ, বা নাম একই হয়ে যেতেই পারে। যেমন সারা পৃথিবীর সব ইঞ্জিনিয়ারই তাদের যন্ত্রপাতিকে একই নামে ডাকে। বয়লার সব ভাষাতেই বয়লার। ইঞ্জিন সব ভাষাতেই ইঞ্জিন। ইংলিশভাষী ডাক্তাররাও সারা দুনিয়ায় বসন্ত-কে স্মল-পক্সই বলে। মায়ের দয়া বলে না। এইসব পরিভাষাগত শব্দ বা নামের লিস্ট করে স্লীম্যান তার নাম দিয়েছিল রামাসিয়ানা এবং বলেছিল ওটা আলাদা ভাষা। যেহেতু সাহেবরা ভারতীয় ভাষা প্রায় কিছুই জানত না, খানিকটা বাংলা, খানিকটা হিন্দুস্তানী, খানিকটা ফার্সি দিয়ে কাজ চালাত, এবং সেই সব ভাষার গ্রাম্য ধরণও বুঝত না, তাই ওদের কাছে সবই ছিল বিজাতীয়। তাই স্লীম্যানের থিওরি সবাই বিশ্বাস করেছিল। তবে একটু ভাবলেই বুঝবি, যে ঠগীদের ভাষা ছিল না, পরিভাষা ছিল।”
কিছুদিন পরে আবার ছৈনা পান্তুর সঙ্গে আলোচনা শুরু করল।
“তাহলে ঠগীরা খুব বেশি রোজগার করত না — অত হাজার হাজার টাকা পেয়েছে বলে লেখা আছে, কিন্তু ভাগাভাগি করে, জমিদারকে, পুলিশকে — না জানি আর কাকে কাকে — ঘুষ দিয়ে সামান্য টাকা-ই পড়ে থাকত। গুহার মধ্যে জমিয়ে রাখার মতো লাখ লাখ টাকা নয়।”
পান্তু বলল, “পুলিশ আবার কোথায় সেই সময়ে? তবে বাকিটা ঠিক। ঠগীদের দলে যারা থাকত, তারা সব্বাই সমান। হিন্দু-মুসলমান, উঁচু-নিচু জাত, বাচ্চা-বুড়ো — সব্বাই। সঙ্গে গেলেই সমান ভাগ পেত, কিছু করুক, চাই না করুক। কেবল যে খুন করছে — অর্থাৎ ভুর্তোৎ, আর যে দলপতি বুরকা — বেশি পেত, তা-ও সামান্য বেশি। তার থেকে আবার ভুর্তোৎ-রা বাড়ি ফিরে তাদের গুরুদের ভাগ দিত। এত ভাগাভাগির পরে, মাথাপিছু কারওরই তেমন টাকাকড়ি জুটত না। অনেক সময় যদি বুঝত শিকারের হাতে বেশি টাকাকড়ি নেই, না মেরে ছেড়ে দিত।”
ছৈনা বলল, “না, কয়েক টাকার জন্যও খুন করত…”
মাথা নাড়ল পান্তু। “সবাই নয়। মাথাপিছু অন্তত আট আনা না পেলে খুন করত না এমন দলও ছিল। ঠগীদের একটা দলে যদি জনা পনেরো লোক থাকত, তাহলে সবাইকে আট আনা পেতে গেলে শিকারের কাছে অন্তত সাত আট টাকা থাকতে হবে।”
ছৈনা একটু ভাবিত হয়ে বলল, “তাহলে গুহার মধ্যে জমিয়ে রাখার মতো টাকা আসবে কোত্থেকে? কিন্তু ওরা তো কখনও বিশ তিরিশ হাজার টাকা, কখনও লাখ-দেড় লাখও পেয়েছে…”
পান্তু বলল, “অনেকই পেয়েছে হয়ত। দুটো বিখ্যাত কেস রয়েছে — একটাকে সাহেবরা নাম দিয়েছে সিক্সটি সোল অ্যাফেয়ার, আর একটাকে মার্ডার অফ ফর্টি। দুটোতেই কিন্তু অনেক ঠগী ভাগ পেয়েছিল।”
ছৈনা বলল, “তাহলে, বলছিলি যে আক্কা আঙ্কেলের গল্পে চল্লিশজনকে খুন করার ব্যাপারটা তোর বিশ্বাস হয় না?”
পান্তু মাথা নেড়ে বলল, “চল্লিশজনকে খুন করেনি বলিনি। বলেছিলাম চল্লিশজনকে খুন করতে পঞ্চাশজন ঠগী যথেষ্ট নয়। মার্ডার অফ ফর্টিতে কত টাকা পেয়েছিল আমার মনে নেই… তবে ছ’শো ঠগী — মাথাপিছু তিরিশ টাকার বেশি কেউ পায়নি…”
আবার ছৈনা পান্তুকে থামাল। বলল, “সে আমি জানি। কিন্তু ওরা যে আফিম ব্যবসায়ীদের টাকা চুরি করত বা ধর, যখন রাজার খাজনাবাহক, বা সেরকম কোনও শেঠের টাকা নিয়ে যাচ্ছে এমন পিওনকে মারত? কম লোককে মেরে অনেক টাকা…”
“ঠিক। কিন্তু রাজার খাজনার হিসেব নেই। আমি কোথাও পড়িনি ওমুক রাজার এত টাকা ঠগীরা চুরি করেছে। সেটা সেরেফ আন্দাজ। আফিম ব্যবসায়ীদের বেশ কিছু টাকা চুরি গেছিল, কিন্তু শেঠরা নিজেদের গোয়েন্দা লাগিয়েছিল — তারা কিছু টাকা উদ্ধার করে ফেরত দিয়েছিল, আর বেশ কিছু টাকা নিজেরাই মেরে দিয়েছিল।”
এবারে লাফিয়ে উঠল ছৈনা। “এই দেখ। কত টাকা কে নিয়েছিল, কোনও হিসেব নেই। তাহলে ঠগীদের হাতে আরও টাকা রয়ে গিয়েছিল — তা ভাবা যেতেই পারে?”
ঘাড় নাড়ল পান্তু। “আমরা বসে বসে যা খুশি ভাবতে পারি। তাতে কী এসে গেল? এসব তাত্ত্বিক আলোচনা অনেক করেছি। একদল বলেছে ঠগী ছিল, তারা অর্গানাইজড ক্রিমিনাল গ্যাং, কালীর উপাসক প্রজাতি, সম্প্রদায়, বা ধর্মানুগামী… আবার একদল বলছে, না, তারা কিছুই না, তারা কেউ ছিলই না — স্লীম্যানের উর্বর কল্পনাপ্রসূত সব। তৃতীয় এক দল তার্কিক বলছে — কোনওটাই পুরোপুরি ঠিক না। ঠগী ছিল, তারা খুন করে লুঠপাট করত, কিন্তু তারা কালী, বা ভবানীকে পুজো করত মানেই তারা সম্প্রদায়, বা ধর্মানুগামী নয়, প্রজাতি তো নয়ই। ডাকাতরাও কালীকে পুজো করত। তাতে কী হয়েছে? সব কালীভক্তই কি এক সম্প্রদায়? বাংলার রঘুডাকাতও কালীপুজো করত, জয়পুরের রাজা-ও কালীপুজো করে, আবার আমাদের হাউসিং কমপ্লেক্সের মিঃ ব্যানার্জিও। সবাই এক হলো?”
“রাজারা তো একপ্রকার ডাকাত-ই,” বলল ছৈনা।
মাথা নাড়ল পান্তু। “এই আলোচনায় যাব না। রাজারা ডাকাত, ব্যবসায়ীরা ডাকাত, ডাক্তাররা ডাকাত… যে গরীব লোক কিছু নেই বলে বড়োলোকের জিনিস আত্মসাৎ করে, সে-ও ডাকাত — অন্তত চোর… এই আলোচনার অন্ত নেই। আমার বিশ্বাস, ঠগী ছিল। তারা চোর, ডাকাত, বা ঠ্যাঙাড়ের মতোই অন্যের টাকা নিয়ে নিত, কিন্তু ওদের মোডাস অপারেন্ডি — কাজের ঢং — আলাদা ছিল বলেই ওদের আলাদা নাম। প্রধানত দুটো ব্যাপারে আলাদা। এক, ওরা ওদের শিকারের সঙ্গে দিনের পর দিন একসঙ্গে চলে তাদের বিশ্বাসভাজন হয়ে যেত তাই — ঠকাত বলে — নাম ঠগী, আর দুই, ওরা প্রধানত গলায় রুমাল পেঁচিয়ে খুন করত।”
“সবাই না,” বলল ছৈনা। “কেউ কেউ আড়ালে থাকত। হঠাৎ গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করত।”
পান্তু বলত, “তবে তারা ঠগী নয়। ফাঁসুড়ে।”
ছৈনা বলল, “আলাদা?”
পান্তু বলল, “নয়? ঠকানোই নেই তো।”
ছৈনা বলল, “তাহলে তো সবার আলাদা আলাদা নাম দিতে হবে। যারা ধুতরোর বিষ দিয়ে মারত, তারা বিষুড়ে?”
পান্তু বলল, “চটাতে পারবি না। তুই জোর করে আমার পেছনে লাগছিস। মোডাস অপারেন্ডি — কাজের স্টাইল দিয়ে নামকরণ আজকের কথা নয়, এবং আজও চলছে — আমরা যখন ছোটো ছিলাম, তোর মনে আছে কি না জানি না, দক্ষিণ ভারতে একরকমভাবে ট্রেনে ডাকাতি হত। বিস্কিটের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মেশানো থাকত, একা যাচ্ছে এমন কোনও যাত্রীকে দিত। সে ঘুমিয়ে পড়ত — ঘুম ভেঙে দেখত, টাকাকড়ি মালপত্র কিচ্ছু নেই। সব নিয়ে চলে গেছে। তাদের নাম ছিল বিস্কিট গ্যাং। ইংরেজির প্রচলন বেড়েছে বলে ইংরেজিতে নাম দেওয়া হয়েছিল। না থাকলে ওদের নাম ঘুমুড়ে, বা বিষুড়ে হতেই পারত, না?”
ছৈনা বলল, “ছোটোবেলায় কেন? এই তো সেদিনের কথা — ট্রেনে দক্ষিণ ভারতে যাচ্ছিলাম। একটা ইয়ং ছেলে উঠল। গল্প-টল্প হলো। বলল, কোন টেকনিকাল কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্র। কথা বলতে বলতে চা-ওয়ালা এল, আমি চা খাওয়ালাম। তারপরেই একজন ফেরিওয়ালা বিস্কিট বিক্রি করতে এল, ও বিস্কিট কিনল। প্যাকেটটা খুলে আমার সামনে মেলে ধরল — আমি হাত বাড়ানমাত্র উলটো দিকে একজন মুসলমান ভদ্রলোক বসেছিলেন, বললেন, ‘ট্রেন মে বিস্কিট-খানা নেহি লেনে কা…’ সাউথে ওরা কী রকম অদ্ভুত সুরে হিন্দি বলে না? আমি যেই চমকে তাকিয়েছি, এপাশ থেকে বিস্কিট হাতে ছেলেটা উঠে চলে গেল। আমি খুব ঘাবড়ে গেছিলাম। মুসলমান ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি বলছেন, ও বিস্কিট গ্যাং-এর লোক ছিল?’ ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘রিস্ক নিয়ে কী লাভ? আপনি একলা যাচ্ছেন। মালপত্র আছে। ওর সঙ্গে কিচ্ছু নেই — লং ডিসট্যান্স ট্রেনে কেউ মাল ছাড়া ওঠে? তারপরে আপনার সঙ্গে ভাব জমাল, আপনি চা খাওয়ালেন আর ও এত কিছু থাকতে বিস্কিটই দিল?’ আমি বললাম, ‘বিস্কিট তো কিনে দিল…’ উনি বললেন, ‘বিস্কিটওয়ালাও তো গ্যাং মেম্বার হতে পারে — জানলেন কী করে?’ আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাই তো, আমরা চলাফেরার সময় কত কথা ভাবিই না। তাই না? দেখ, ওই ছেলেটা কী ছিল আমি জানি না, কিন্তু সত্যিই যদি ওই উদ্দেশ্য নিয়ে এসে থাকে, তাহলে সবই ঠগীদের মতো — কেবল গলায় ফাঁস লাগিয়ে খুনটা বাদ…”
পান্তু বলল, “ঠিক। আর ওরা কোনও জাতি, জনগোষ্ঠী, কোনওটাই না। ওরাও কোনও দেব-দেবীর পুজো করে — হয়ত সকালে সেই ঠাকুরকেই নমো করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল… কিন্তু তার মানে সেই দেবদেবীর সব উপাসকই ওরকম নয়। যে বিস্কিট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে, সে-ও হয়ত সেই ঠাকুরকেই পুজো দিয়ে সেদিন বেরিয়েছে। সেটাও কিন্তু স্লীম্যানের বিরুদ্ধে নালিশ। ঠগীরা ভবানীর উপাসক বলেই বলতে চেয়েছিল কালীভক্ত বলেই ওরা এমন। ভাগ্যিস স্লীমান অ্যামেরিকান বা ইতালিয়ান মাফিয়ার কথা জানত না। নইলে হয়ত বলত সব যীশু-উপাসকই মাফিয়া।”
ছৈনা খুব হাসল। তারপরে বলল, “ভালো কথা, হঠাৎ মনে পড়ল, বিস্কিট গ্যাঙের একটা দেশী নাম আছে — জহর খুরানি — মানে বিষ খাওয়ানেওয়ালা। জহরের এই উচ্চারণটা বাংলায় করা যায় না। জেহর… জ-টা জেড-এর মতন।”
পান্তু বলল, “তবেই দেখ। সব্বারই হয়ত আলাদা আলাদা নাম আছে। ইংরেজি আর উর্দু নাম জানিস। হয়ত — কে জানে, তামিল, তেলেগু — অন্য অন্য ভাষাতেও আলাদা নাম আছে — ঠগীদেরও হয়ত ছিল।”
ছৈনা বলল, “তা ছাড়া, বিস্কিট গ্যাং টাইপের জেহর খুরানিরা এখনও আছে। এই তো গতবছর ডিসেম্বর মাসেই একটা দল ধরা পড়েছিল — রিক্সাওয়ালাদের ঘুমের ওষুধ মেশানো কোল্ড ড্রিঙ্কস খাইয়ে রিক্সা, মোবাইল ফোন, টাকাকড়ি নিয়ে পালাত। কিছুই শেষ হয়ে যায় না। শুধু তুই যেটাকে মোডাস অপারেন্ডি বললি, সময়ের সঙ্গে সেটা বদলে যায়।”
কাজের ফাঁকে ক্যাফেটেরিয়াতে বসে ওরা কথা বলছিল। পান্তুর ক্লাস আছে, উঠে পড়ল। ছৈনা আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে একটা নোট-প্যাডে পরের চিন্তাগুলো লিখে নিল — যেগুলো পান্তুর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
এক) ঠগীদের দলপতি — বুরকা, বা সুবেদার-জমাদাররা লুটের ভাগ বেশি পেত। সেই নিয়ে অনেক সময়ে ঝগড়া হত।
দুই) বিখ্যাত ঠগী দলপতি ফিরিঙ্গিয়ার কাকা বা জ্যাঠা — রাই সিং একবার একটা পঁয়ষট্টি হাজার টাকা দামের হীরে নিজের জন্য রেখেছিল। দলে প্রবল অসন্তোষ হয়েছিল। অথচ অন্য এক দলপতি রত্নখচিত তরোয়াল তার ভাগে রেখেছিল — সেটা স্বাভাবিক ভাবা হয়েছিল।
তিন) এই সব তরোয়াল, হীরে-জহরত — বিক্রি করা কঠিন এবং অনেক কৈফিয়তও দিতে হত বলে অনেক সময় বিক্রি করা হত না, এমন হতে পারে?
চার) ঠগীরা অনেক সময় কাউকে মেরে তার জিনিসপত্র নিজেরাই ব্যবহার করত। এক জমাদারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, যার পরনের রঙিন ছিটের কাপড়ের আংরাখা দেখে তার মালিকের ভাই সহজেই চিনতে পেরেছিল।
পাঁচ) বহু এমন জিনিসের কথা রয়েছে — যেগুলো ঠগীরা চুরি করেছে, কিন্তু সেগুলো নিয়ে কী করেছে স্পষ্ট নয়। হয়ত বিক্রি করতে গেলে লোকে চিনে ফেলত — ওই আংরাখার মতো? আন্দাজ করা হয় সেগুলো কম দামেই বিক্রি হয়েছে, যারা কিনেছে তারা সেগুলো গলিয়ে ফেলেছে, বা ভেঙে তার দামী অংশটা আলাদা করে বিক্রি করেছে। কিন্তু তারও কোনও প্রমাণ নেই। সেগুলোর কি কোনও গোপন ভাণ্ডার থাকতে পারে?
*
গুপ্তধন আছে কি নেই, থাকতে পারে, কি পারে না — এ সব নিয়ে পান্তুর কোনও মাথাব্যথাই নেই। তাই এসব এখন ছৈনাকেই ভাবতে হয় একা একা। পান্তুর চিন্তা কেবল একটাই। কত তাড়াতাড়ি গুহাগুলোতে যাওয়া যায়।
“অভয়ারণ্যের মধ্যে বলেই সমস্যা। অনুমতি লাগবে, আর বনদপ্তর ওদিকটায় যাবার অনুমতি দিচ্ছে না এখন। ওদিকে নাকি এখন আস্তে আস্তে লেপার্ডের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে ভালুকও। ফলে…”
অভয়ারণ্যে ঢুকতে ছৈনার অনুমতি লাগে না। আদিবাসী গ্রামে আদিবাসীদের যাতায়াত অবাধ। কিন্তু পান্তুর অনুমতি লাগবে। ছৈনাদের গ্রামে যাবার অনুমতিটুকু হয়ত পাওয়া যাবে, কিন্তু গুহাগুলো ওখান থেকে অনেক দূর। ছেলেবেলায় পিকনিকে গিয়ে যেখান থেকে গুহা দেখা গেছিল, সেখান অবধিও গাড়িতে যেতেই সময় লেগেছিল অনেকটা। ভোরবেলা বেরোতে হয়েছিল। আর খাদের ওপরে যেখান থেকে গুহাতে নামতে হবে, জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা পেরিয়ে সেখান অবধি যেতে তো অনেক সময় লাগবে। ওদিকে কোনও আদিবাসী জনবসতিও নেই।
একদিন পান্তু বলল, “বোরাম পাহাড়ের আশপাশ থেকে অভয়ারণ্য শুরু। ওখান থেকেই সবচেয়ে কাছে হবে। তাহলে দেখ — তোদের গ্রাম থেকে একদিকে হাঁটা পড়বে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার। চড়াই আছে — সামান্য। ঘণ্টায় যদি ৫ কিলোমিটার যেতে পারি, তাহলে আমি হয়ত ছ-ঘণ্টায় পৌঁছতে পারব। তুই পারবি না।”
ছৈনা দ্বিরুক্তি করল না। পান্তু ভোরবেলা প্রায় দেড় ঘণ্টা জগিং করে। তারপর কমিউনিটি সেন্টারের জিম-এ গিয়ে ব্যায়াম করে কতক্ষণ, ছৈনা জানে না। দু-মাস আগে ছৈনাকে বলেছিল, গুহা-অভিযানে যেতে হলে রক ক্লাইম্বিং শিখতে এবং অভ্যাস করতে হবে। তার আগে শরীরটা পোক্ত করতে হবে। তাই ছৈনা এখন ভোরে পান্তুর সঙ্গে দৌড়তে যায়। ঘণ্টাখানেক দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসে — পান্তুর অর্ধেক শক্তিও ওর নেই। তবে আশা করে ছেলেবেলায় পোক্ত ছিল বলে পান্তুর সমান-সমান হতে সময় লাগবে না বেশি। কয়েক দিন দুজনে রক ক্লাইম্বিং-ও করেছে ইউনিভার্সিটির ক্লাবের সঙ্গে।
ছৈনা বলল, “আমি যদি অর্ধেক স্পিডে যাই, তাহলে আমাদের দু-দিন লাগবে পৌঁছতেই?”
মাথা নাড়ল পান্তু। “অর্ধেক স্পিড তোর না। দিন দেড়েক লাগতে পারে… মানে দ্বিতীয় দিন দুপুরে, বা দুপুরের পরে খাদের মাথায় পৌঁছব। ভালোই হবে। ক্যাম্প করে সরেজমিনে তদন্তের সময় পাব। ওদিকটা পশ্চিমমুখী — সূর্যের আলো থাকবে গুহার মুখে। পাহাড়ের মাথা থেকেই ভালো করে দেখা যাবে। আক্কা আঙ্কেল বলেছিল খাদের ধার ধরে পাথর কেটে সিঁড়ি বানানো আছে — কিন্তু সে কতটা ব্যবহার করা যাবে, এত বছরে ক্ষয় হয়ে কী আকার ধারণ করেছে কে জানে।”
ছৈনা বলল, “কী কী নিয়ে যেতে হবে।”
পান্তু বলল, “পাহাড়ে নামতে-উঠতে যা যা লাগবে, সবই আমার আছে। তুই শুধু তৈরি হতে থাক। বাড়ির এত কাছে এক্সপিডিশন, কিন্তু প্রস্তুতি ভালোই হতে হবে।”
চলতে থাকে প্রস্তুতি। তিন দিনের খাবার, রক ক্লাইম্বিং-এর সরঞ্জাম, তাঁবু। শীত শেষ হয়ে গ্রীষ্ম শুরু হলে যাওয়া — সুবিধে এই, যে গরম জামাকাপড়, কম্বল ইত্যাদি বইতে হবে না, দিনের আলোও থাকবে বেশিক্ষণ, কাজ করার সময় পাওয়া যাবে বেশি। আবার গরম বেশি বাড়ার আগেই গেলে পোকামাকড়, আর পথকষ্ট বাড়বে না।
ওরা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল — অভিযানের আসল উদ্দেশ্য কাউকে জানানো যাবে না। ঠগীদের গুহায় সাত রাজার ধন এখনও রয়েছে, এ কথা স্থানীয় লোকে মাঝে-মধ্যে বলাবলি করলেও কেউ খুব বিশ্বাস করে না। তবু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু-জন সেখানেই অভিযানে যাচ্ছে খবরটা যদি রটে, তাহলে একই সঙ্গে গুপ্তধনের কথাও রটতে পারে। তখন ওদের পক্ষে সামলানো মুশকিল হবে।
কিন্তু আর কী অজুহাতে উজানগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-জন ইতিহাস শিক্ষক বোরামবুরু অভয়ারণ্যে ট্রেকিং করতে চাইবে — সেও আবার সাধারণ ট্যুরিস্টের এলাকায় না, একেবারে গভীর অরণ্যে — যেখানে কারও যাওয়া বারণ?
অনেক ভেবে শেষে পান্তু আর ছৈনা ঠিক করল, সত্যি কথা বলা যাবে না। তাই উজানগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ অভয়ারণ্যের আদিবাসী জাতির জীবনযাত্রা নিয়ে কাজ করবে — এই কারণ দেখিয়ে বনবিভাগে আবেদন করা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু নৃতত্ত্ববিভাগ নেই, তাই ইতিহাসের প্রধান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সকলেই আবেদনে সাড়া দিলেন, বনবিভাগের অনুমতি এল — নতুন করে প্ল্যান করতে বসল ছৈনা আর পান্তু।
*
দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন এসে গেল। বিকেল বেলা বুদবুদিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, সাবধানে চলাফেরা করবে এমন কথা দিয়ে ওরা বেরোল। ছৈনার গ্রাম অবধি গাড়ি করে… সেখানে গাড়ি রেখে ছৈনার গ্রামের বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোর থাকতেই বেরিয়ে পড়বে পায়ে হেঁটে। দুজনের পিঠেই থাকবে ব্যাকপ্যাক — তাতে জামাকাপড়, খাবারদাবার ছাড়াও পাহাড় চড়ার সরঞ্জাম আর নানারকম আলো। গুহার ভেতরটা কতটা অন্ধকার, আর কতটা সময় ওদের থাকতে হবে জানা নেই বলে।
ছৈনার পুরোনো বাড়িটা ঝেড়েঝুড়ে সাফ করে রেখেছে মংলু। ও-ও যাবে সঙ্গে। সেটা প্রথম থেকেই প্ল্যান ছিল, কিন্তু কাউকে জানানো হয়নি। মংলুও আদিবাসী — ওরও জঙ্গলে ঢুকতে অনুমতি লাগে না।
পৌঁছনোর কয়েক মিনিটের মধ্যে গ্রামসুদ্ধ লোক ভীড় করে পান্তুকে দেখতে এল। এরকম অভিজ্ঞতা ওর আগে কখনও হয়নি। সবাই ওকে দেখতে চায়, অনেকেই ছুঁতে চায়। কেউ কেউ গেস্ট হাউসের মাইনির মতো প্রণাম করতে আসে। অনেকে খাবার এনেছে। পান্তু চুপিচুপি ছৈনাকে জিজ্ঞেস করল, “এগুলো সব আমাদের জন্য? এত কে খাবে?”
এরা অনেকেই পান্তুকে চেনে। পান্তুর কাছাকাছি বয়সী যারা, তারা অনেকেই ছোটোবেলায় ওর সঙ্গে খেলা করেছে। তখন যারা জোয়ান ছিল, তারা বুড়ো হয়ে গেছে। পান্তুর সময়কার গাঁওবুড়া আর নেই, তার বউও না। তাদের ছেলে মাঙ্কা এখন গাঁওবুড়া — যদিও বুড়ো সে মোটেই না, বড়োজোর বছর চল্লিশের মতো বয়স।
পান্তুর মনে হলো, একমাত্র মাঙ্কা-ই যেন ওকে পছন্দ করছে না। কাছে আসছে না, কথা বলছে না, দূর থেকে কেমন কটমটিয়ে দেখছে ওকে।
ছৈনা সবাইকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সবার আনা খাবার থেকেই কিছু কিছু রেখে ওদের বিদায় দিল। সবাই চলে যাবার পরেও রয়ে গেল মাঙ্কা আর ওর দলবল। জানতে চাইল পান্তু আর ছৈনা কেন অভয়ারণ্যে যাচ্ছে? সবাইকে যেমন বলা হয়েছিল, ওরা তা-ই বলল, আদিবাসীদের জীবনযাত্রা জানতে। মাঙ্কা ছাড়ে না। আরও জানতে চায়। খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে। একটু পরে ওরা বাংলা ছেড়ে ওদের ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করল। ওদের ভাষার সঙ্গে বাংলার খুব মিল, কিন্তু অনেক শব্দ আলাদা — তাই তাড়াতাড়ি কথা বললে পান্তুর বুঝতে অসুবিধে হয়। পান্তুর মংলুকে বলতে যাবে, তুমি ছোটোবেলায় আমাকে বলেছিলে তোমাদের ভাষা বাংলা, কিন্তু আমি তোমাদের সব কথা বুঝতে পারি না… হঠাৎ খেয়াল করল, মংলু মন দিয়ে ছৈনার দিকে তাকিয়ে আছে।
ছৈনা ব্যাগ থেকে ম্যাপ বের করল। আঙুল দিয়ে দেখাতে থাকল কোথায় কোথায় যাবে ওরা। মংলু একদৃষ্টে এখনও মাঙ্কা আর ছৈনাকে দেখছে। পান্তু খেয়াল করল, ওরা যেখানে যেখানে যাবে, ছৈনা সেদিকে দেখাচ্ছেই না। ম্যাপে যেখানে যেখানে আদিবাসী গ্রাম রয়েছে, সেই জায়গাগুলো দেখাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনেক প্রশ্ন করে মাঙ্কা বিদায় নিল। ছৈনা ম্যাপটা ভাঁজ করছে, পান্তু জিজ্ঞেস করতে যাবে, “তুই মাঙ্কাকে সব ভুলভাল জায়গা দেখাচ্ছিলি কেন?…” ছৈনা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “চুপ।” তারপর ঘরের আলো নিভিয়ে বাইরের আলো জ্বালাল। জানলাগুলো নিচু, খুপরি খুপরি। বাইরেটা ভালো দেখা যায় না। দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখে এল। আলোটা আবার জ্বেলে দিয়ে বলল, “মাঙ্কাকে বিশ্বাস নেই। ভাবলাম যদি বাইরে দাঁড়িয়ে ও বা ওর সাকরেদ কেউ আমাদের কথা শোনে…”
পান্তু বলল, “কিন্তু তুই ওকে ঠিক ঠিক বলছিলি না কেন?”
ছৈনা একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “ওর ইন্টারেস্টটা আমার স্বাভাবিক লাগল না। কোথায় যাব, কেন যাব — এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তারপরে — কোন গ্রামে আগে যাব, কোথায় পরে যাব, কোন রাস্তায় যাব… এসব কেন?”
পান্তু বলল, “স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসা হতে পারে না?”
ছৈনা একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “আসল ব্যাপারটা কী তোকে বলিনি। আমরা কাউকে বলি না, কিন্তু আমাদের পরিবারের সবাই মনে করে মংলুকে ও খুন করার চেষ্টা করেছিল।”
চমকে উঠল পান্তু। “খুন? কেন?”
মংলু বলল, “আগের গাঁওবুড়া মরে যাবার পরে ও ধরে নিয়েছিল ও-ই গাঁওবুড়া হবে। কিন্তু গ্রামের কিছু লোক অন্তত ওকে চায়নি। ও তো বদমাইশ। ওকে গাঁওবুড়া করবে কেন লোকে? মানবেই বা কেন? অনেকেই আমাকে ধরেছিল গাঁওবুড়া হতে। আমাকে সবাই পছন্দ করত। এমনকি আগের গাঁওবুড়াও বলেছিল, মংলু, আমি মরলে তুই গাঁওবুড়া হোস। লোকে আমাকেই চাইতে লাগল। মাঙ্কার পছন্দ হল না। গ্রামের লোকেদের ভয় দেখাতে শুরু করল — ওকে গাঁওবুড়া না করলে দেখে নেবে… এ সব কথা। কিন্তু পরে বোধহয় ভেবেছিল দেখে না-হয় নেবে, কিন্তু গাঁওবুড়া তো হওয়া হবে না। আমাকে এসে বলেছিল, গাঁওবুড়া হবার সখ হয়েছে? নাম কেটে দাও, নইলে বুঝবে মজা।”
ছৈনা বলল, “মংলুর যে মোটেই গাঁওবুড়া হবার ইচ্ছে ছিল না, সেটা মাঙ্কাকে বলেনি। ওটাই ভুল করেছিল। গাঁওবুড়া-নির্বাচনের আট-ন’দিন আগে একদিন মংলু কাজ থেকে ফিরল না। এমন হয় না — তখন মরশুমি ফুলের সময়, অনেক দিনই ফিরতে রাত হয়, কিন্তু রাতে রোজ ফিরে আসে। ওর মা-বাবা, আমরা — খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছি, গ্রামের লোকেও অন্ধকারে বেরিয়ে মংলুকে ডেকে ডেকে এসেছে, পাওয়া যায়নি। পরদিন সকালে দেখা গেল, পাহাড়ি ঢালে পড়ে রয়েছে। মাথায় চোট, অজ্ঞান। হাসপাতালে কিছুদিন যমে মানুষে টানাটানি চলল। পুলিশ এল — বুঝতেই পারছিস, উজানগড়ের পুলিশ, তা-ও চোট পেয়েছে একটা আদিবাসী জংলী। কিছুই করল না। আমরা পরে জানলাম, মাঙ্কা আর ওর দলবল পুলিশকে বলেছিল যে মংলু মদ খেয়ে ফিরতে গিয়ে মাতাল অবস্থায় পাহাড় থেকে পড়ে গেছে। পুরো মিথ্যে। মংলু মদ খায় না তা নয়, কিন্তু শুধু পরবের সময়, সবাই মিলে একসঙ্গে। উজানগড়ের কলোনির বাইরের — তখনও কলোনি এখানেই ছিল — বেআইনি মদের দোকানে বসে কোনও দিন খায়নি। ওসব করত মাঙ্কা আর তার দলবল। এখনও করে। সেইজন্যই আমরা মনে করি মাঙ্কা বা ওর দলের কেউ রাতে মংলুকে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছিল। আমাদের এখন খুব সাবধানে থাকতে হবে। চল, খেয়ে নিই। গ্রামের লোকেদের কল্যাণে খাবারের অভাব নেই আজ।”
(চলবে)