মানুষ নামের আশ্চর্য প্রাণিদের দাপটে এখন মানুষেরই প্রাণান্তকর অবস্থা। প্রকৃতি আমাদের যে সব উপহার উজাড় করে দিয়েছিলেন যেমন ভূমি,নীর,মরুৎ,আলো আর আকাশ , তাদের সবকটিরই আজ রীতিমতো বেহাল দশা। কেন, কীভাবে তাদের এমন জীর্ণতা প্রাপ্তি, তাও আমাদের অবিদিত নয়। দ্রুত বেড়ে ওঠা জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান বাড়াতে গত শতকের ষাটের দশকের আশেপাশের সময়ে পৃথিবীতে নতুন ধারার কৃষির ভাবনা প্রচার করা শুরু হোলো। পুরুষানুক্রমিক চিরায়ত জীবিকাসত্বা ভিত্তিক কৃষিকে দূরে সরিয়ে জায়গা নিতে শুরু করলো রাসায়নিক কৃষি – জৈব সারের বদলে এলো রকমারি রাসায়নিক সার ইউরিয়া,পটাশ, ফসফেট, নাইট্রেট ইত্যাদি। কৃষিতে এল বিপ্লব (?) – উৎপাদন বাড়ল, কৃষকদের আয় বাড়লো , কিছুদিন পর কমলো প্রান্তিক উৎপাদন, মাঠ ঘাট নদীনালা সব কেমন বিষাক্ত হয়ে উঠলো। আমরা নরুণের কাছে নাক খোয়ালাম। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে তো হবেই দাদা!
আমার আজকের গপ্পো অবশ্য এসব নিয়ে নয়। খুব সম্প্রতি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে CGWB বা সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ডের পক্ষ থেকে। কী বলা হয়েছে এই রিপোর্টৈ ? জানানো হয়েছে ভারতের ৫৬ শতাংশ জেলার ভৌম জল এই মুহূর্তে নাইট্রেট এবং ইউরেনিয়াম দূষণের শিকার। আরও ভেঙে বললে বলতে হয় দেশের মোট ৪৪০টি জেলার ভৌম জলে নাইট্রেটের মাত্রা সাধারণের সহনসীমার (৪৫ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার ) অনেকটাই ওপরে। ২০১৭ সালের তুলনায়(৩৫৯টি) আক্রান্ত জেলার সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে গেছে (৪৪০– ৩৫৯ = ৮১) এবং এই প্রবণতা থেকে স্পষ্টতই আশংকা জাগে যে আগামীদিনে তা আরও বাড়বে ; যার অর্থ আমরা দেশের মূল্যবান পেয়ে জলের ভাণ্ডারের সিংহভাগ যা লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি বছর ধরে ভূপৃষ্ঠের গভীরে সঞ্চিত হয়েছে ,তাকেও নষ্ট করে ফেলতে চলেছি। শুধু তাই নয় এই অবক্ষয়ের কারণে আমাদের শরীরে নানান ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, বাড়তে পারে দূষিত পানীয় জল ঘটিত নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা।
এই গবেষণার কাজে ১৫২৩৯ টি জলের নমুনা সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে যে পরীক্ষিত নমুনার ১৯ . ৮ শতাংশ নমুনায় নাইট্রেট বা নাইট্রোজেন ঘটিত যৌগের উপস্থিতি নিরাপদ মাত্রার ওপরে রয়েছে। রাজ্যওয়াড়ি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে রাজস্থান ( ৪৯%) , কর্নাটক (৪৮%) এবং তামিলনাড়ু (৩৭%) ভৌমজলে নাইট্রেট সঞ্চয়ের বিচারে শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে। এদের পরেই রয়েছে মহারাষ্ট্র ( ৩৫.৭৪ শতাংশ), তেলেঙ্গানা (২৭. ৪৮ শতাংশ), অন্ধ্রপ্রদেশ ( ২৩.৫ শতাংশ) এবং মধ্যপ্রদেশ (২২.৫৮ শতাংশ)। এই পরিসংখ্যান থেকে একটা বিষয় খুব পরিস্কার , যেসব রাজ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ তুলনামূলক ভাবে কম হওয়ায় ভৌমজলের উত্তোলন হার বেশি সেই সব রাজ্যেই এমন সমস্যার পাল্লা ভারী। নাইট্রেট জনিত সমস্যার এটা যেমন একটা দিক অন্যতর দিকটি হলো পানীয় জলের সঙ্গে নাইট্রেট যৌগ শরীরে প্রবেশ করার ফলে দেখা দিচ্ছে নানান ধরনের রোগ যাদের মধ্যে অন্যতম হলো Infant Methemoglobinemia. নামের আগে ইনফ্যান্ট শব্দটি দেখেই হয়তো বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন যে এই রোগে শিশুদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। নিশ্চয়ই অপরিচিত এই রোগটির নাম দেখে পাঠকদের মধ্যে অনেকেই গুগলে সার্চ করতে শুরু করে দিয়েছেন ? তাঁদের আশ্বস্ত করতে বলি এই রোগটি Blue Baby Syndrome নামেই অধিক পরিচিত।
রক্তে পরিশুদ্ধ লোহিত কণিকা বা হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেলে আক্রান্ত শিশুর দেহটি নীল বর্ণ (Cyanotic) ধারণ করে। মানব শরীরে হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন কোষ ও টিস্যুতে অক্সিজেন সরবরাহ করা। যখন কোনো বিশেষ কারণে রক্ত অক্সিজেন বহন করতে পারে না তখনই শরীর অক্সিজেনের অভাবে নীল বর্ণ ধারণ করে। পৃথিবীর অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত দেশগুলোতে এই রোগটি সে ভাবে দেখা না গেলেও পৃথিবীর বিকাশশীল দেশগুলোতে বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে যেখানে পরিশ্রুত পানীয় জলের জোগানে ঘাটতি রয়েছে সেখানে এই রোগের প্রকোপ দেখা যায়। ভারতের বেশ কিছু অংশে যেখানে পানীয় জলের সঙ্গে মিশে আছে নাইট্রেট যৌগ সেখানে ব্লু বেবী সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের দেখা যায়।
কৃষি বিপ্লবের অনুষঙ্গে ভারতীয় কৃষিতে বেড়েছে নাইট্রোজেন ঘটিত সারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। এই রাসায়নিক পদার্থ সেচের জল এবং বৃষ্টির জলের মাধ্যমে পৌঁছে যায় মাটির গভীরে। এরফলে ভৌমজল সংক্রমিত হয়। সেই জলই ব্যবহার করা হয় পানীয় জল হিসেবে। এই জলেই তৈরি করা হয় শিশুদের খাবার। শরীরে ঢুকে এই নাইট্রেট যৌগ পরিবর্তিত হয় নাইট্রাইটসে। এই নাইট্রাইটস রক্তের হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে হয়ে পরিণত হয় methemoglobin এ যা অক্সিজেন সংবহনে অপারগ। অক্সিজেনের সংকটে শিশুদের শরীরের ত্বক ক্রমশই নীল রঙের হয়ে ওঠে। সাধারণভাবে তিন মাসেরও কম বয়সী শিশুদের মধ্যে এই রোগটি বেশি দেখা গেলেও অন্যদের মধ্যেও বিশেষ করে যাদের জিনগত ত্রুটি বা বিশেষ প্রবণতা রয়েছে , যাঁরা আলসার বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভুগছেন, যাঁদের মধ্যে কিডনির সমস্যা রয়েছে বা নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয় – তাঁদের মধ্যেও এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে।
তবে শরীরের ত্বক নীল হয়ে যাবার অর্থই যে ব্লু বেবী সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়া তা কিন্তু নয়। শিশুদের মধ্যে জন্মকালীন হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকলেও অনেকসময় তাদের এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই রোগের প্রধান সাধারণ লক্ষণগুলো হলো —-
১.শ্বাসকষ্ট
২. বমন
৩.ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া
৪. নেতিয়ে পড়া
৫.মুখদিয়ে অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ
৬. অচেতন হয়ে পড়া
৭ . খিঁচুনি
উপসর্গের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে অনেক সময় আক্রান্ত শিশুটির মৃত্যু ঘটতে পারে। সুতরাং শরীর নীল হয়ে গেছে দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসক শিশুটির বিষয়ে অনুপুঙ্খ খোঁজখবর নেবেন তার অভিভাবক তথা মায়ের কাছ থেকে এবং তারপর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করবেন।
ভারতবর্ষে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে বেড়েছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার। ফলে এই সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও একটু একটু করে বাড়ছে। ভারতে সবুজ বিপ্লবের ডঙ্কা প্রথম বেজেছিল যে রাজ্যে সেই পঞ্জাবের জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার জাতীয় গড়ের অনেক ওপরে। এরফলে ভাতিন্দা এবং লুধিয়ানা জেলার ভৌমজল ব্যাপকভাবে সংক্রমণের কবলে পড়েছে। সমস্যা অন্যখানেও। একটা সহজ হিসাব আমাদের বুঝতে হবে। যতবেশি সার প্রয়োগ – তত বেশি মাটি দূষণ– তত বেশি ভৌমজলের দূষণ – তত বেশি ব্লু বেবী সিনড্রোমে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা। যে ভৌমজলকে প্রকৃতি সঞ্চয় করে রেখেছিলেন সৃষ্টির আদিকাল থেকে,সেই পবিত্র জলকে আমরা কলুষিত করছি প্রতিনিয়ত। অথচ পৃথিবীতে পেয় জলের জোগান নিঃশেষ হবার মুখে। এও এক নাকের বদলে নরুণ পাওয়ার করুণ গল্প। নিবন্ধটি শুরু করেছিলাম কৃষি বিপ্লবের কথা দিয়ে, শেষ করলাম সেখানেই। খালি মাঝখানে কয়েকটি নীল শরীরের শিশুর কথা বলে নিলাম বিপ্লবের অনুষঙ্গে। ভারতীয় পুরাণের কাহিনি আমাদের নীলকন্ঠ শিবের কথা জানিয়েছে। সমুদ্র মন্থনের ফলে উদ্ভূত হলাহল পান করে তিনি পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলেন। আর একালে আমাদের ঘরের শিশুরা জন্ম নিচ্ছে নীল শরীরের মহাদেব হয়ে। এই সমাপতন বিষাদের।
এসব মেনে নিয়েই আমাদের ব্যথিত দিনযাপন।
মধ্যমগ্রাম।
জানুয়ারি ৮. ২০২৫
এ’ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো অঙ্গীকার করে অনেক “বিপ্লব” আনলাম। পরিণামে বিশ্ব হলো শিশুর নরক। নবজাতক, আমাদের ক্ষমা করো ।
সমস্যা ক্রমশই চিন্তার সীমানার বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রথমে ভৌমজল বিভাগের খবরটা পড়ি । তারপর ব্লু বেবী সিনড্রোমের কথা জানলাম। তারপর লেখা তৈরি হলো। নরকের পথ বড়ো ভয়ঙ্কর। আমরা সবাই বরং সচেতন হই।
Otyonto bhoyabaho ! Lekha ti podey onek kichu jantey parlam. Er jonyo lekhak ke ashesh dhonyobad. Ashar alo dekhtey pachchi na ar. Ki korey bancha jabey eii dushan er thekey?
আছে, এখনও আলো আছে। ঐ কালো পর্দার আড়ালে। সবাই মিলে তাকে সরিয়ে দিতে হবে। সেজন্যই তো পথে নামা।
Chiranjoy chakraborty
মতামত কই ?
The relevant topic is presented in such a well and easily understandable way. Thank you dada 👍
These are written for general awareness. We are still in dark and don’t understand the situation. Share with others.
এতো এক ভয়াবহ পরিস্থিতি! শিশুর শরীরে নাইট্রেট পৌঁছচ্ছে কী করে? মায়ের দুধ থেকে হলে আরও চিন্তার বিষয় । সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে পৃথিবী ধূসর হয়ে গেল। সমাধান অধরাই থেকে যাবে?
কৃষি বিপ্লবের ফলে এক অসুস্থ প্রজন্মের দীর্ঘ কাতার অপেক্ষমাণ। সময় সতর্ক হবার।
সবুজ বিপ্লবের ফলস্বরূপ উৎপাদন বৃদ্ধির যে ক্ষণস্থায়ী প্রভাব আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে তার প্রতিকার প্রয়োজন, দেশজ কৃষি পদ্ধতি এবং দেশীয় বীজের বৈচিত্র্যতা ই একমাত্র উপায়।
মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ জানাই। কৃষির উন্নয়ন মানে কৃষ্টির উন্নয়ন। দেশজ সংস্কৃতির ওপর আমাদের ভরসা বোধহয় কম। তাই সখাত সলিলে ডুবে মরার উপক্রম হয়েছে। প্রাণঘাতী রাসায়নিকেরা এখন আমাদের শরীরে বাসা বাঁধছে।সময় সত্যিই নতুন করে ভাবার।
আরও একটি সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন লেখক।ধন্যবাদ।
অনেক সংস্থা নিজেদের মতো করে জৈব কৃষি প্রসারের চেষ্টা করছেন।কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।আমাদেরই আগ্রহ কিন।😢