২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫
পুজোর নির্ঘন্ট অনুযায়ী আজ ষষ্ঠী। হুতোমপেঁচি বিরসবদনে নতুন কাপড়টি পরে, অনেক হিসেব করে আব্রু বাঁচিয়ে হাঁটু অবধি সেই শাড়ির পাড় উত্তোলিত করে পাড়ার রাস্তার সাতপচা জমা জল ঠেঙাতে পথে নামল। দুয়ারে মহাকাশ থেকে দেবদূত নেমে এলেও আসতে পারে এই হোগলাবনে, কিন্তু তার সাধের চারচাকার আসা অসম্ভব। জল ভেঙে গাড়িতে উঠে পেঁচি দেখল, গোটা পাড়া জলে ভাসলেও, পুজোমণ্ডপ চত্বর ইষ্টকখণ্ডচর্চিত। বিস্তর রাঙা রাঙা ইঁটের টুকরো ফেলে রোলার চালিয়ে প্রতিমা সহ প্যাণ্ডেলকে দ্বীপের মতো জাগিয়ে রাখা হয়েছে। ডাকের সাজের শ্বেতবসনা অনুপম মাতৃমূর্তির উদ্বোধনে ধোপদুরস্ত সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা ড্যাকরা স্বঘোষিত নেতাটা ফের এসেছে, যেন পদ্মবনে জলহস্তী! বিতৃষ্ণায় মুখখানা ঘুরিয়ে রাখল সে।
ফটফটে রোদ্দুরে ‘প্যাণ্ডাল হপিং’ করতে বেরিয়ে পড়েছে জেন জ়েডের দল — বিচিত্র তাদের পোশাক, মুখে বিচিত্রতর বুলি। ট্যাটুশোভিত বাইসেপ আঁকড়ে ধরে রয়েছে পাশের অফ শোল্ডার ড্রেসের মাখন মাখন কাঁধকে। কারো মাথায় টুপি, কারো হাতে সেলফি স্ট্যাণ্ড — চরকিপাক চলছে — দ্রষ্টব্য কোথাও আলুভাজার মণ্ডপ তো কোথাও নোয়ার নৌকো, আবার কোথাও বা আলফা সেন্টরি নাকি মহেঞ্জোদরো — কি একটা এনে ফেলেছে উদ্যোক্তারা, সেসব ক্যাপচার করতে না পারলে জীবনই বৃথা। হ্যাঁ, সেই সঙ্গে জিরো ফিগার, মাকড়শা সদৃশ মা জননীকেও লেন্সবন্দি করতে হবে বৈকি — ইদানীং অবিশ্যি দেবীমূর্তির ক্ষীণতনুর সঙ্গে বিশালাকার মাথার চল হয়েছে, ঐ অ্যালিস ইন ওয়াণ্ডারল্যাণ্ডের হেলেনা বনহ্যাম কার্টারের মতো! তা হোক। দুগ্গাঠাকুর তো বটে। ছবিছাবা না তুললে যদি পাপ দেয়!
বীতশ্রদ্ধ হুতোমপেঁচি বাকি পথটা চোখ বন্ধ রেখেই হাসপাতালে পৌঁছে গেল। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে হাঁপালো খানিক — বয়স তো হচ্ছে, হাঁপ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
“শুভ ষষ্ঠী, ম্যাম”
নোমোস্কার মেডাম”
“হ্যাপ্পি পূজা, দিদি”
ইত্যাদি বিবিধ বচনে সম্ভাষিত হতে হতেই ব্যাগ হাতড়ে চেম্বারের চাবি বার করল সে। করিডোর দিয়ে ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেল স্ক্যাভেঞ্জিং স্টাফ গাজিপুরী রাঘব সিংএর চৈনিক মোবাইলে উচ্চস্বরে বাজছে ‘হারা হারা শাম্ভু, শিভা মাহাদেভা — হারা হারা শাম্ভু, শাম্ভু, শাম্ভু’ —
পাশেই বসে ছিল পাঁশকুড়ার ভীষ্ম মাইতি, গ্রুপ ডি স্টাফ। সে রাঘবকে দাবড়ানি দিল — “এঃ, যত্ত খোট্টা গান চালিয়েছে! কেন,
মহিষাসুরমর্দিনীটা চালাতে কি হয়? ইউটিউব ফিউব খুলে তো দিব্যি সার্চ মারতে পারো!”
ঘরে ঢুকে ঘামটাম মুছে এসি-টা চালিয়ে হুতোম শুনল রাঘব সখেদে বলছে, “হাঁ হাঁ, উ তো হাম পারিই — লেকিন সোচো ভীষম্ ভইয়া, সতী সে পহলে তো পতি কা নাম লেনা চাহিয়ে, না? দেওতালোগ তুমার আমার জ্যায়সা মডান থোড়ি না আছে কি ঘর-কোয়াটার কে দরওয়াজে পর প্যাহলে মিসিজ কা নাম লিখল বা!”
পেঁচি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেজিস্টার খাতাটা টেনে নিয়ে দিনের হাজিরা চেক করতে আরম্ভ করল। এর পর কোল্ড রুমের ইমার্জেন্সি স্টক থেকে দিনের বরাদ্দ রক্ত বের করার কাজটা ঝটপট করে ফেলতে হবে। উৎসবে রাজ্যিসুদ্ধু ব্লাডব্যাঙ্ক রক্তাল্পতায় ভোগে — হিসেব করে খরচ করতে হবে। এই পুজোগণ্ডার দিনেও রোগীর বাড়ির লোককে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করে তাদের থেকে রক্ত নেওয়া চলছে। কঠিন কাজ। আর এ হেন অপ্রিয় কাজটি যে কর্মচারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই ডাকাবুকো মেয়ের পোশাকি নাম যা-ই হোক না কেন, কর্মক্ষেত্র তাকে ‘ডন’ বলে চেনে এবং ডাকে। কিছুক্ষণ পরে কোল্ড রুমের অন্দর থেকেই পেঁচির কানে গেল ডন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছে। সঙ্গে আরো কিছু অচেনা গলার চিৎকার, প্রতিবাদ, ঘ্যানা বাচ্চার কান্না — সব মিলিয়ে এমন উদ্ভট ক্যাকোফোনি আছড়ে পড়ল সারা ব্লাডব্যাঙ্কে, যে হুতোম তড়িঘড়ি ঠাণ্ডিঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হলো।
“কি হয়েছে” প্রশ্নটুকু মুখ থেকে খসাতেও দিল না ডন, তার আগেই গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল — “দেখুন না ম্যাম, অসভ্য স্বার্থপ্পর লোক একটা — নিজের মায়ের জন্য ছেলে হয়ে রক্ত তো দেবেই না, উপরন্তু এই পাঁউরুটির স্লাইস মার্কা চেহারার হদ্দ অ্যানিমিক বউটাকে জোর করে নিয়ে এসেছে শাশুড়ির জন্য রক্ত দেয়াতে — আমি আপত্তি করেছি বলে বলছে, মেয়েরা তো দেবী দশভুজা, ওট্টুকুনি রক্ত দিলে ওর বউয়ের নাকি কিছুই হবে না — কত বড় শয়তান ভাবুন –”
মারমুখী ডনকে নিরস্ত করে হুতোমপেঁচি তার রুগ্ন রুধিরভাণ্ডার থেকে এক পাউচ রক্ত বের দিয়ে রুগ্না ‘দশভুজা’কে এবারের মতো বাঁচাবার চেষ্টা করে।
দুপুর গড়ায়। পর্দাঢাকা এসি রুমের বাইরে আকাশে ছায়া ঘনায় — অসময়ের মেঘ জমতে থাকে আশ্বিনের উৎসবমুখর উঠোনে। পেঁচি তার ছোট্ট টিফিনকৌটো খুলে টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ চিবোয় ধীরে ধীরে। ভীষণ ইচ্ছে করে সিকিউরিটির ছেলেটাকে দিয়ে একটু ঝাল মটর বা বাদামভাজা আনাতে — লিকার চায়ের সঙ্গে খাবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই দন্তুর ডেনটিস্ট মশায়ের নৃশংস হাসি মনে পড়ে যায় — “রুট ক্যানাল তো করে দিলাম, কিন্তু মনে রাখবেন ম্যাডাম, নো মাংসের হাড্ডি, নো ঘটিগরম, নো চালভাজা — নাথিং। ঐ সব চালালে আপনার দাঁতের লাইফের গ্যারান্টি আমি দিতে পারব না, হ্যাঁ!”
খুব মন দিয়ে নরম পাকা পেঁপে গিলতে গিলতে পেঁচি দাঁতবিশারদটার নাম মনে করার চেষ্টা করে — মগনলাল দত্ত ছিল? না হুব্বা বুল্টন? কে জানে। বয়স হচ্ছে, স্মৃতি বড্ড বিশ্বাসঘাতকতা করে আজকাল!
পরের শিফটের কর্মীরা আসতে আরম্ভ করেছে। আর্জেন্ট ক্রসম্যাচ রুমের দিক থেকে আবার একটা গণ্ডগোলের আওয়াজ পেয়ে হুতোমপেঁচি বাধ্য হয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠে। নাঃ, এরা পুজোটাও শান্তিতে কাটাতে দেবে না দেখা যাচ্ছে!
আর্জেন্ট সেকশনে তখন ধুন্ধুমার চলছে। প্রত্যেক ঈদে দশদিন করে ছুটি নেওয়া বুলবুল হাসানকে পুজোয় অন্যদের চেয়ে একটু বেশি ডিউটি দেওয়া হয়েছিল। সে সময়মতো এসেছে ঠিকই, তবে শিফটের সহকর্মী অজিতেশের সঙ্গে তার তুমুল বচসা বেধে গিয়েছে। “অ্যাই গোরু, তোদের আবার পুজো কি রে? চুপচাপ টেবিলে বসে ক্রসম্যাচ কর, বেশ কয়েকটা ওটি কেসের ব্লাড পেণ্ডিং আছে, শেষ না করে চা খেতেও যেতে দেব না তোকে — এঃ, গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে, নিজেদের পার্বণের ছুটি তো নেবেই, আবার ডিউটির মধ্যে পুজো দেখতে যাওয়ার শখ!”
ডন তখন রক্তদান-উদ্বুদ্ধকরণের পুণ্যকাজ শেষ করে একটা জাম্বো রোল দু’হাতে ধরে সাঁটাচ্ছিল। মুখ ভর্তি খাবার নিয়েই অজিতেশকে সাপোর্ট করে বলল — “ঠিক বয়েচ অজিদ্দা, সেদিনও একটা জানাজা না কি দেখতে যাবে বয়ে স্যারের কাছে একব্যায়া ছুটি কয়েচে”—
হুতোম হাঁহাঁ করে ওঠে, “ওকি কথা! জানাজা মানে মৃতের শেষযাত্রার কফিন — তাই দেখতে কেউ ছুটি চায়? তোরা এত্ত ইগনোরান্ট কেন বল্ তো অপরের ধর্ম সম্বন্ধে? এক জায়গায় কাজ করিস, এই রকম করলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বলে আর কিছু থাকবে?”
রাঘব সিং ডিউটির শেষে তার ‘মিসিজ’ নামাঙ্কিত কোয়ার্টারে ফিরবার জন্য ব্যাগ গুছোচ্ছিল, ঘাড় নেড়ে গ্রাম্ভারি গলায় বলল — “ও বাত তো ঠিক আছে মেডাম, লেকিন হাসান কো পুছিয়ে তো গণেশজিকা বাহন কোন্ আছে? হংসা ভি কিসকে পয়ের কে নিচে থাকে? লছমিজি ইয়া সরসতিয়াজি? পুছিয়ে পুছিয়ে –”
পেঁচি থমকে গিয়ে হাসানের বিপন্ন মুখচ্ছবি প্রত্যক্ষ করে — উত্তরের আশায় ইতিউতি তাকাচ্ছে বেচারা! কিন্তু যমের অরুচি ল্যাবটায় পাঁচখানা ক্যালেণ্ডারে শিব, গৌতম বুদ্ধ, আজারবাইজানের প্রাকৃতিক শোভা, ঘুনসি পরা মাতৃদুগ্ধপায়ী গাবলা শিশু মায় একখানা টি রেক্সের সাইজের রক্তের ফোঁটার ছবি থাকলেও সপরিবার দুর্গার একটি ছবিও নেই।
এদিকে নিষ্ঠুর রাঘবের খ্যাঁকখেঁকে হাসি আরও জোরালো হচ্ছে —
“কা হুয়া রে, মালুম নেই তো! মেডাম, এর ঠাকুর-উকুর দেখনে কা কোই মতলব নাহি, উ কালিজ ইস্কোয়ারের বগল মে জো বিরানি কা ইস্টল লাগা হ্যায়, শালা উখানে যাচ্ছে — দো তিন পাকিট অকেলাই খায়ে আসবে। কি রে বুলবুলোয়া, ঠিক অন্দাজা লগায়া না?”
অগত্যা পেঁচিকে আরও ঘন্টাখানেক আটকে যেতে হলো ব্লাডব্যাঙ্কে। অজিতেশ আর হাসান গলাগলি করে কলেজ স্কোয়্যারের ঠাকুর দেখতে গেল, ডনের এখনও রিলিভার আসেনি, সে গেল পাশের অ্যান্টিরুমে বরের সঙ্গে ঝগড়া করতে।
আর্জেন্ট ল্যাবে হুতোম মাথা নিচু করে স্লাইডে রক্তের গ্রুপ নির্ধারণ করতে করতে ডনের দাম্পত্য-আলাপ শুনতে থাকে – “নবমীতে আমার মা-বাবাকে রাত্তিরে খেতে বলেছি। ও সব ইমার্জেন্সি টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স ডিউটি ফিউটি আমাকে দেখিও না। আগে থেকে রোস্টার চেঞ্জ করে নাওনি কেনওওওও? সোজা কথা, তোমাকে বাড়িতে থাকতেই হবে, আর যদি ম্যানেজ না করতে পারো, যখন ফিরবে, জেনে রেখো, এক কিক মেরে তোমাকে আমি ফ্ল্যাট কেন, এক্কেবারে পাড়াছাড়া করে দেব, বলে রাখলাম।”
সকলকে শারদ শুভেচ্ছা। পুজো ভাল কাটুক, স্বস্তিতে কাটুক।