আমার অসুস্থতার জন্য সুদুর বাংলাদেশ থেকে সার্ক পুরস্কার বিজেতা ফরিদুর রহমান দাদা আমাকে দেখতে এসেছিলেন। তিনি যাওয়ার সময় আমাকে তার স্বরচিত একটা গল্পের বই আর আমার মেয়ের জন্য সাত দিনে সাত দেশে বইটা উপহার দিয়ে যান।
এই সাত দিনে সাত দেশে বইটা পড়ে মনে হল আপনাদের কেও জানাই লেখককের এই সাত দেশের বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। লেখক ফরিদুর এখানে প্রথমেই সরাসরি ভাবে বলে দিয়েছেন যে
“বাল্টিক সাগরের উপকূল ঘিরে থাকা দেশের সংখ্যা নয় হলেও আমাদের গন্তব্য ছিল সাতটি দেশে। পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, সুইডেন এবং ডেনমার্ক। যাত্রা শুরু হবে, জার্মানির মুনশেনগ্লাডবাখ থেকে আবার শেষও হবে হবে সেখানেই।”
এখানে একটু বলে রাখা ভাল লেখক যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিক এবং তার বাংলা ভাষা ও লেখার সঙ্গে আমাদের কিছু পার্থক্য রয়ে যায়। তাই আমার একান্ত অনুরোধ উদ্ধৃত উক্তিতে সে বিষয়গুলো একটু এড়িয়ে যাওয়ার।
লেখককের পুরো ভ্রমণ কাহিনী যেন তিনি একদম একটা সুন্দর মোড়কে বেঁধে দিয়েছেন। যাত্রার স্থল আর শেষ জার্মানির মুনশেনগ্লাডবাখ শহরের যাত্রা শেষের কথা বলে। , শুরুতে তিনি শুধু দেশের নাম গুলো উল্লেখ করে ক্ষান্ত হননি, সেইসঙ্গে পুরো ভ্রমণ মূল্য কত এবং তা বাংলাদেশের টাকায় কত হচ্ছে বা ট্রেন্ড টুরস নামক ভ্রমণ সঙ্গীর সঙ্গে তাঁর প্রথম আলোচনা, বিমান টিকিট, ভিসা ইত্যাদি সবকিছুই তিনি পাঠকের নজরে এনেছেন। তিনি প্রথম পরিচয়ের সূত্র জানাচ্ছেন ” ট্রেন্ডট্যুরস-এর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল বাসের যাত্রীদের বাহান্ন জনের আটচল্লিশজনই জার্মান ভাষাভাষী। বাকি চারজন বাঙালির দুজন আমি ও আমার স্ত্রী হেনা। অন্য দুজন কন্যা আনিকা ও জামাই অপু। বাসের প্রধান চালক ইয়রগেন ও ট্যুর গাইড ম্যাক্সমিলিয়ন জার্মান আর অন্যতম চালক কাম সহকারী রিকি ক্রোয়েশিয়ান।”
একটু খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যায়, লেখক ফরিদুর এই ভ্রমণ বৃত্তান্তে কোনও দিক না ছুঁয়ে কিন্তু শেষ করেননি । যেমন তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সব বাঙালির দিকে আঙ্গুল তুলেছেন এই বলে যে,
বড় কথা।
“আমাদের দেশের নারী পুরুষ নির্বিশেষে একটা বিরাট অংশ বিদেশে বেড়াতে যাওয়া মানেই মনে করেন কেনাকাটার বিশাল সুযোগ। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জ্ঞানী বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীসহ বিপুল সংখ্যক নব্য ধনী ও তাদের স্ত্রী বা স্বামী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে এই ধরনের ট্যুরিস্টের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। একেই বলা যেতে পারে শপিং ট্যুরিজম। এই শ্রেণিভূক্ত পর্যটকদের বেশিরভাগই কলকাতা, দিল্লি, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, বড়জোর কুয়ালালামপুর ভ্রমণে যেতে পছন্দ করেন। এক সপ্তাহের সফরে একাধিকবার কলকাতা গেলেও এদের অনেকেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি কখনোই দেখতে যান না।”
সেইসঙ্গে তিনি বাঙালিদের অনেক লাগেজ নিয়ে ভ্রমণে যাওয়াও তীক্ষ্ণ ভাষায় আক্রমণ করেছেন। এখানে মজাচ্ছলে বলা যেতেই পারে যে বাঙালি হিসেবে লেখকের হয়তো সহধর্মিনীর সঙ্গে লাগেজ নিয়ে দাম্পত্য কলহ হয়েছিল। তিনি মুনশেনগ্লাডবাখের কথাও বিশদে লিখেছেন।
লেখক সাহিত্যিক ফরিদুর রহমান সাত জায়গা নিয়ে ভ্রমণ বৃত্তান্ত বলার সময় সে সব দেশের ইতিহাস ও ছুঁয়ে গেছেন। আর ভ্রমণ বৃত্তান্ত যখন তখন তো ভূগোল নিয়ে শারীরিকভাবেই নাড়াচাড়া করতে হবে কিন্তু সেইসঙ্গে হাস্যরস এমন ভাবে ছড়িয়েছেন যেন পূজারীর ফুল ছড়িয়ে পুরো স্থানের আকর্ষণীয়তা বাড়িয়ে তোলা। প্রথমে মুনশেনগ্লাডবাখের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন “জার্মানির বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারণেও উচ্চারিত হয়ে থাকে মুনশেনগ্লাডবাখ-এর নাম। এর মধ্যে হোকশুলে নিদারহাইন ইউনিভার্সিটি অফ এ্যাপ্লাইড সায়েন্স-এ শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও এখানে বেশি। বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে পড়তে আসা ছাত্র ছাত্রীদের একটা বড় অংশ হোকশুলে নিদারহাইনে পড়াশোনা করেন।
পাশের দেশ নেদারল্যান্ডসের সীমান্ত থেকেও মুনশেনগ্লাডবাখ সবচেয়ে কাছের শহর। ট্রেনে চেপে মাত্র আধাঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় ওপারে সীমান্ত সংলগ্ন শহর ফেনলো। পারাপারের কোনো সমস্যা না থাকায় অনেকেই সস্তায় চিংড়ি মাছ অথবা সবজি কিনতে চলে যায় পাশের দেশে। কেনাকাটা ছাড়াও যে কোনো দিন সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই ঘুরে আসা যায় ছোট নদী মিউসের তীরে ছোট্ট সুন্দর শহর ফেনলো থেকে। লিমবার্গস মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টসহ ফেনলোর জাদুঘরগুলোও এই শহরে ঘুরতে যাবার বড় আকর্ষণ।”
যাই হোক মুনশেনগ্লাডবাখের কথা দিয়ে শুরু হলেও, পোলান্ড থেকে যাত্রা শুরু করা হল, সেই ভয়ানক ওয়ারশো দিয়ে, লেখক এখানে আট বছর আগে যেহেতু এসেছিলেন সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তফাৎ চলে এসেছে প্রাচীন ও আধুনিকের। তবে তিনি খুব সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলেছেন যে রাজনীতিতে পার্থক্য এলেও সব জায়গায় বাম মনোভাবের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে। সে কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন “গাড়িটা থেমে যাবার পরে ভেবেছিলাম সফরের শুরুতেই হয়তো পোলিশ শিল্পকলা সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া হবে। কিন্তু ট্যুর গাইডের জার্মান বক্তব্য যখন অনুবাদে জানতে পেলাম বাসযাত্রী পর্যটকদের ‘বিশেষ প্রয়োজন’ মেটাতেই এখানে যাত্রা বিরতি দেয়া হয়েছে, তখন ‘হা হোতস্মি’ বলে বাস থেকে নেমে পড়লাম। ট্যুরিস্টদের প্রায় সকলেরই বয়স ষাটের ওপরে। সত্ত্বর কিংবা আশির ওপরেও আছেন কয়েকজন। কাজেই তাঁদের ঘন ঘন প্রক্ষালন কক্ষ ব্যবহারের প্রয়েজন হবে, এতে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু তাই বলে যেখানে এখন আধুনিক শিল্পকলার প্রদর্শনী চলছে, সেখানে!”
তার উক্তিতে আমরা বুঝতে পারি যে প্রাচীন পারি শহরে মানে অধুনা প্যারিসে এমন কার্যকলাপ একজন রসে বসে সাহিত্য শিল্প প্রেমিক বাঙালির ভীষণই অপছন্দের বিষয় হয়েছে।
এখানে তিনি তার কলমকে ১৯১০ সালের গল্পে নিয়ে গিয়ে সুন্দরভাবে আবার ২০২২ দিনপঞ্জীর জুন মাসে পাঠককে নিয়ে আসেন। পিলসুডেস্কির ভাস্কর্যের সামনে মেয়ে ও জামাই যুগল ছবি দিয়ে জানালেন অপু আনিকা।এতক্ষনে আমরা জেনে গেছি, এরা লেখকের কন্যা এবং জামাতা।তবে এখানে একেকটি লেখার সঙ্গে দেওয়া ছবিগুলো যেন তথ্যের সাক্ষী হয়ে হাত তুলে উপস্থিত জানাচ্ছে। পোলান্ডকে আমরা যেন চর্মচক্ষে দেখতে পাচ্ছিলাম।
এরপর লিথুয়ানিয়া দেশে পৌঁছে ঠিক তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ইতিহাস ভূগোল আর সাহিত্যকে মিশিয়ে এক দুর্দান্ত স্বাদের রেসিপি এই বইতে পরিবেশন করেছেন। তাই এখানে খেয়াল করলে দেখা যাবে তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত আর পাঁচটা ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে বেশ একটু আলাদা। তিনি কলমকে কখনো পাঠিয়ে দেন ১৫-১৬০০ খ্রিস্টাব্দে, আবার সমান্তরাল লাইনের মধ্যে ইতিহাস ও আধুনিক সমাজকে নিয়ে চলেন, একসঙ্গে। এখানে একজায়গায় সাহিত্য সড়কের ছবি ও বিবরণ পড়তে পড়তে মনে হয় আমিও যেন লেখকের সঙ্গী। এই দেশের বর্ণনার শেষ দিকে লেখক বলেছেন, “সোভিয়েত শাসনামলে কমিউনিস্ট মতাদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক হবার ফলে ক্রস স্থাপন পুনরায় নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬১ সালের ৫ই এপ্রিল রাতে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় হিল অব ক্রস। কাঠের ক্রসগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়, ধাতবে নির্মিতম ক্রস তুলে নিয়ে গলিয়ে ফেলা হয় এবং কংক্রিট ও পাথরের ক্রস চূর্ণ করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে আরও অন্তত চারবার অবস্থান থেকে উৎখাত হবার পরে বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে ক্রুশের পাহাড়। যতোবার ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে ততোবারই আরও বেশি শক্তি নিয়ে এগিয়ে এসে পুনর্নিমাণ করেছে বিশ্বাসী মানুষ। কর্তৃপক্ষীয় নিষেধাজ্ঞা, বিপদ বাধা ও জেল জুলুমের ভয় অগ্রাহ্য করে রাতের অন্ধকারে কখনো একা আবার কখনো দলবদ্ধভাবে এসে এখানে রেখে গেছে তাদের উপেক্ষার চিহ্ন। আমার মনে হয় ধর্মীয় কারণে যতোটা না, তারচেয়ে এক সময় ক্ষমতাসীনদের প্রতি মানুষের ঘৃণা ও ক্রোধের সাহসী প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল এই ছোট্ট পাহাড়।”
তারপর চলে আসেন লেখক, লাটভিয়ায় এখানে রিগাল রাজপথ বলে শুরু করেন। সেই সঙ্গে একটা গল্প বলেন যেখানে আমরা জানতে পারি লেখককের বাবা অষ্টম শ্রেণীতে থাকাকালে পুরস্কার হিসেবে যে গ্রিম ব্রাদার্স ফেয়ারি টেল বইটা পুরস্কার হিসাবে পেয়েছিলেন। তার থেকে তিনিও তাঁর ছোটবেলায় গল্পগুলো পড়ে জেনেছিলেন ব্রেমেনের বাদ্যযন্ত্রীদের গল্প।
আবার আমরা ইতিহাসের ভূগোলের হাত ধরে ধরে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এগিয়ে চলি লেখক এর সাত দিনের সাত দেশের বইটির কালি অক্ষরগুলোকে সঙ্গে করে। সেখানে তিনি আমাদের জানাচ্ছেন লাটভিয়ার প্রাচীনতম এই পর্যটন কেন্দ্রে সারা বছর দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। ফলে স্মারক সামগ্রির দোকানও দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক আমাদেরই মত যেন, তাই না!!?। এই লাটাভিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্য লেখক এত সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন যে বইটি না পড়লে হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। তিনি এক গুহার বর্ণনায় বলছেন “গুহার ভেতরে ঢোকার আগেই চোখে পড়ে বেলে পাথরের গুহামুখে এবং দেয়াল জুড়ে হাতে লেখা অসংখ্য নাম ঠিকানা, স্বাক্ষর এবং তারিখসহ নানা রকম কারুকাজ। ধারণা করা হয় সপ্তদশ শতক বা তারও আগে থেকেই শিলালিপি খোদাই করার কাজ চলে আসছে। গত চারশ বছর ধরে যারা এখানে এসেছে তারাই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাদের উপস্থিতির প্রমাণ রেখে গেছে। আলো আঁধারিতে ঘেরা প্রস্তরময় এই সুড়ঙ্গের ভেতরে খুব বেশি দূর এগিয়ে যাবার সময় ছিল না। ভেতরে অনেক রাজা মহারাজা, ব্যারন, কাউন্ট কিংবা ডিউক এবং ডাসেস-এর কারুকার্যখচিত নাম পাথরের গায়ে স্থায়ীভাবে খোদাই করা আছে। সেকালে স্থানীয় কারিগরা হাতুড়ি, বাটাল, ছেনির মতো যন্ত্রপাতি নিয়ে সম্পদশালী দর্শনার্থীদের জন্য অপেক্ষা করতো। বতর্মানে হাজার বছরের পুরোনো এই গুহার দেয়ালে নিজের নাম বা গুহাচিত্র আঁকার ইচ্ছে থাকলে তা আর সম্ভব নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ভূতাত্ত্বিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসাবে চিহ্নিত করে ইতিমধ্যেই এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
এরপর এস্তোনিয়া দেশ, শিরোনাম ছিল তাল্লিনের পথে পথে। এখানেও খুব সুন্দর প্রাকৃতিক বিবরণ পাওয়া যায় লেখক এর কলমে। আর লেখকের তোলা ছবিগুলো যেন আলোক চিত্রের একটা আলাদা মাত্রা স্থাপন করে। এখানে এক জায়গায় তার লেখায় আমরা পাই ৩০০ বছর পরে “তিনশ বছর পরে, পূর্ব পুরুষের অতীত অহংকারের এইসব নিদর্শন দেখতে পরবর্তী প্রজন্মের রুশ, জার্মান, সুইডিশ এবং এস্তোনীয় বড়লোকেরা এখনও এখানে পরিদর্শনে আসেন। চার্চের মেঝেতে মধ্যযুগে সমাহিত অভিজাতদের পরিচিতি ফলক, এমন কি কারো কারো প্রতিকৃতিও স্থায়ীভাবে খোদাই করে রাখা হয়েছে। একটি খিলানের নিচে চিরনিদ্রায় শায়িত সুইডিশ রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি, এস্তোনিয়ার গভর্নর পন্তাস দেলা গার্দি। এইসব রাজা-গজাদের নাম জানা বা মনে রাখার কোনো কারণ নেই। তবে সুইডিশদের পক্ষে যুদ্ধ করা এই ফরাসি জেনারেলের কথা ভিন্ন। ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে নাভরার যুদ্ধে জার আইভান দ্য টেরিবলকে যিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিলেন তিনি পন্তাস দেলা গার্দি। আর চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ সের্গেই আইজেনস্টাইনের শেষ ছবি ১৯৪৪ সালে নির্মিত আইভান দ্য টেরিবল!
সোভিয়েত নাস্তিকতার যুগে ধর্মধারীদের এইসব বিপুল আয়োজন, বিশাল মঠে পাদ্রি পুরোহিতদের সদম্ভ পদচারণা, ঝকমকে গির্জায় মনি মুক্তাখচিত সোনা রূপার ক্রুশবিদ্ধ যিশু এবং আকাশ ছোঁয়া বেল টাওয়ারের ঘণ্টা ধ্বনি, এসব কোথায় ছিল এবং কেমন করে টিকে গিয়েছে তা জানতে চাইলে একটিই উত্তর পাওয়া গেছে। তা হলো, ‘ঈশ্বরই রক্ষা করেছেন!’ কে জানে নাস্তিকদের ঈশ্বর এবং বিশ্বাসীদের ঈশ্বর এক এবং অভিন্ন কি না!”
এই উক্তি থেকে তার মানসিকতার একটা চিত্র পাওয়া যায়। সেখানকার একটি ভিরু গেট ও ভীরু স্ট্রিট নাম নিয়ে মজা করতেও ছাড়েননি। তেমনি পিরতা নদীর নাম নিয়ে বলেছেন পিরিতি হলে মন্দ হত না। রসিক ফরিদুর রহমানের ভ্রমণ কথা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে সাহিত্যের নয়টি রস তাঁর ভ্রমণ বর্ণনায় ছুঁয়ে গেছে।
এরপরে ফিনল্যান্ড, এবার জাহাজ যাত্রা। বোধহয় লেখকের মতে জার্মান গাইডের আইন, সোয়াই, দ্রেই, ফিয়ার করে মাথা গোনা বন্ধ হয়নি। যেমনটা আমাদের ট্রাভেল বাসে এক দুই তিন করে গোনা হয়ে থাকে। লেখক এখানেও স্বধর্ম বজায় রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব বিবরণ দিয়েছেন। সঙ্গে সেই উপস্থিত স্যর বলা ছবিগুলো। এখানে তিনি এক জায়গায় পড়ে যাওয়ার সময় রেস্টুরেন্টের কর্মীদের সহমর্মিতা খুব সুন্দর করে তুলে বোধায় বোঝাতে চেয়েছেন সে দেশের নাগরিকরা শুধুই যান্ত্রিক নয় মানবিকও বটে।
তিনি বেশ হাস্যরসের দ্বারা জানিয়েছেন যে মে আনিকা ভুল করে একজন জার্মান শখের আঁকিয়েকে বাংলাদেশের প্রফেশনাল আঁকিয়ে ভেবে তার সঙ্গে গল্প জমিয়ে ফেলে। আবার আমরা হেসে ফেলি তার বর্ণনায়, যখন তিনি, তার এবং জামাই এর নাম উচ্চারণের সময় জার্মান গাইডের নাজেহাল অবস্থা দেখেন। বাংলাদেশের লেখক ফরিদুর রহমান কতটা যুক্তিবাদী মানুষ, তা তার এইসব ছোট ছোট হাস্যরস পরিবেশনের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়।
এরপর নোবেলের শহরে মানে সুইডেন এখানে সবচেয়ে সেরা লক্ষণীয় বিষয়ে ছিল সেটা হল সাহিত্যিকের উদারতা তিনি এক জায়গায় বলছেন
“লেকের পাড় ধরে গাছের সারি। আমরা কাছাকাছি যেতেই ঝাঁকড়া দুটো গাছ থেকে এ ঝাঁক পাখি মহা হৈ চৈ করে উড়ে পালালো। এখানে এরা সাদা অথবা লালমুখো চেহারার লম্বা চওড়া মানুষ দেখতে অভ্যস্ত। সেখানে বেঁটে খাটো কালা আদমি, তাদের একজন আবার শাড়ির মতো অপরিচিত পোশাক পরা, এই দুজনকে দেখে পাখিরা নিরাপত্তার অভাবে পালিয়ে বেঁচেছে।”
এই উক্তি থেকে বোঝা যায় কতটা সরল মনের হলে একজন ভাল সাহিত্যিক হওয়া যায়। এখানে আমরা জানতে পারি লেখকের মেয়ে আনিকা ক্যান্ডি কিনে গাইডের দায়িত্বে দিয়ে বিতরণ করায়, ক্যান্ডির নাম পোলকা।
এরপর শেষে ডেনমার্ক নিয়ে লিখেন মৎস্যকন্যার দেশে। এই বর্ণনায় আমরা লেখক ও তার স্ত্রীর যুগল ছবিটি প্রথমে দেখতে পাই। তিনি এখানে বলছেন দু’বছর আগে একবার তিনি এসেছিলেন বলে তার সবকিছু মনে ছিল। তারা যখন ফ্রেড্রিক চার্চে দেখতে ঢুকলেন তখন ঠিক তার মতই একজন ফিসফিসিয়ে তাঁর কানে বললেন “আই এম ফেড আপ উইথ অল দিস চার্চেস।”
এক্ষেত্রে সহযাত্রী বেশি বিরক্ত হওয়ার আগেই একসঙ্গে গাড়িতে উঠে বসে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করলেন। আপনারা যাই বলুন এর থেকে কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার যে বিশ্বজুড়ে নাস্তিকের সংখ্যা বাড়ছে। এটা আমাদের মতো নাস্তিকদের জন্য কিন্তু একটা বেশ সুখবর। এরপর লেখক ফরিদুর আশি বছর পেরিয়ে যাওয়া রানী মা রানীগিরি ছাড়াও যে অনুবাদের কাজ করেন ছবি আঁকেন বই ইলাস্ট্রেশন করেন এমন কি ছদ্ম নামেও চিত্রনাট্য লেখেন। সেই কথা তিনি তুলে ধরেছেন। এরকম আমরা কী ভাবতে পারি!!!
আমাদের সার্ক বিজয়ী সাহিত্যিক যে শুধু সাহিত্যকর্ম করেন নিজের নাম যশের জন্য তা কিন্তু নয়, তার মানবিক নারীবাদী ও নাস্তিক মানসিকতার চিত্রও আমরা প্রতিটি বিবরণে পাই। তার এই নারীবাদের কথা বিশদে বুঝিয়ে বলতে গেলে তার একটি প্যারাগ্রাফের বর্ণনা দিয়ে উল্লেখ করা যায়। “…ওপরে বসানো লিটল মারমেইডের সাথে ছবি তুলতে চায়। আমরা কিছুক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে মৎসকন্যা ঘিরে নানা ধরনের পর্যটকের কীর্তিকলাপ দেখছিলাম। বানর যদি মনুষ্য জাতির পূর্বপুরুষ হয়ে থাকে তাহলে তাদের বসবাস যে শুধু বাংলাদেশে নয়, ব্রোঞ্জের মারমেইডের শরীর বেয়ে ওঠা গুটিকতক শ্বেতাঙ্গ বানর দেখে তার যথার্থ প্রমাণ পাওয়া গেল এদেশেও।”
লেখক ভ্রমণবৃত্তপূর্ণ করে এখন আবার ব্রেমেনের সেই শহরে সেই বাদ্যযন্ত্রীর গল্পের শহরে থেকেই যাত্রা শেষের শুরু করলেন।এখানে একটি বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে গাইডদের বকশিশ দিয়ে যাত্রার অন্ত শুরু হল। প্রথমেই দুজন যাত্রী নেমে গেলেন তারপর ধীরে ধীরে নামতে নামতে একদম শেষে লেখকের সপরিবার আর দুজন সহযাত্রী মুনশেনগ্লাডবাখে নামলেন।
এই ভ্রমণ পুস্তকে আমার এমন কোনও বিষয় নজরে পড়ল না, যা নিয়ে সমালোচনা করা যায়। তবে লেখককে বলব প্রচ্ছদটা বোধহয় আরও অনেকটা ভাল করা যেত। প্রকাশক জনান্তিককে ধন্যবাদ তাদের বইয়ের পাতার মান, ছবির মান সবকিছুই সুন্দর করে তুলে ধরার জন্য, আর বাংলাদেশের ৩৫০ টাকা বা বিদেশের হিসেবে ১৫ ডলার এরকম একটি বইয়ের ক্ষেত্রে বোধ হয় সত্যি বেশ কম মূল্য।
শেষে একটা কথা না বললেই নয় যে এই বইটা তিনি কিন্তু সেই মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে মানে অপু আর আনিকাকেই উৎসর্গ করেছেন। এই বইটি আপনারা অনলাইনেও পেতে পারেন।










