২০২৪ এ আটাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে গণ আন্দোলনের জোয়ার এক অভূতপূর্ব ইতিহাস রচনা করেছে। ২০২৪ এর আগস্টে আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকের নির্মম হত্যাকাণ্ড ও পাশবিক ধর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় সূচনা হওয়া এই আন্দোলন প্রথম বৃহৎ গণ অভ্যুত্থান যেখানে কোন ঘোষিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়াই দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়। ঘুম ভাঙ্গার গান নিমেষে বিদ্যুৎপ্রবাহ তৈরি করে শীত ঘুমে শুয়ে থাকা শিরদাঁড়ায়, ঋজু মেরুদণ্ড নিয়ে পালাবদলের স্বপ্নে সামিল হয় বাংলার মানুষ, গ্রাম শহর মাঠ পাথার বন্দরে ডাক ওঠে –‘জোট বাঁধো তৈরি হও।‘
প্রথমে একজোট হন মেডিক্যাল কলেজগুলির প্রতিবাদী ছাত্র চিকিৎসকেরা। অচিরেই সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ গণ আন্দোলনের জন্ম দেয়। মানুষ পথে নামেন, ন্যায় বিচারের দাবিতে। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া বা ইংল্যান্ডের লিডসের আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় বাংলায় বহমান আন্দোলনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে ‘Reclaim the Night, Reclaim the Right’। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে মহানগরের গন্ডি ছাড়িয়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে, অন্যান্য রাজ্যে, এমন কি দেশের সীমানা ছড়িয়ে প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে।
হাসপাতালে লাগাতার কর্মবিরতি, লালবাজার অভিযান, স্বাস্থ্যভবনে অবস্থান, ধর্মতলায় অনশন, দ্রোহের কার্নিভালে জোয়ারের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করে আন্দোলনের গতি খানিক স্তিমিত হলেও প্রতিবাদ থামেনি। জয়েন্ট প্লাটফরম অফ ডক্টরস এর উদ্যোগে এক ছাতার তলায় শতাধিক সংগঠন একত্রিত হয়ে গড়ে তুলেছে অভয়া মঞ্চ যার শিকড় একে একে শহর গ্রাম মফস্বলে ছড়াতে শুরু করেছে।
প্রতিবাদের আশ্চর্য সমাপতন ঘটেছে এই আন্দোলনে। সরকারি মদতপুষ্ট এই প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা নারী এবং প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের স্বাধিকার ও নিরাপত্তাকে প্রবল ভাবে আঘাত করে। নারী এবং ট্রান্সক্যুইয়ার গোষ্ঠীর মানুষেরা বিচারের দাবিতে দলে দলে পথে নামেন। কলকাতার রাজপথে বা আন্দোলনের পরিসরে এই বিপুল সংখ্যায় প্রান্তিক যৌনতার মানুষ এর আগে কখনো দেখা যায়নি। যৌন কর্মীরা প্রতিবাদে মুখর হন। আদিবাসী তরুণীর ধর্ষণ ও মৃত্যুর বিচারের দাবি ওঠে রাজপথের মিছিলে। দ্রোহের কার্নিভালে যোগ দেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বর্ধমান বীরভূম থেকে আদিবাসী জনজাতির মানুষ। রাতদখল, মানব বন্ধনের সঙ্গে এক হয়ে যায় ডেলিভারি শ্রমিক, মৃৎশিল্পী, রিকশা চালকদের মিছিল।
রাজনৈতিক পরিসরের বিস্তৃতির সঙ্গে সাংস্কৃতিক নতুন রূপরেখা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে ‘কলকাতার আকাশে এক আগুনপাখি’ নিবন্ধে অধ্যাপক অশোককুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন-
“ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরাশি বছর পরে। সেই অগাস্ট বিপ্লবের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ল অভয়া তিলোত্তমার বিচার চাওয়া ডাক্তারদের আন্দোলনের আয়নায়, এই ২০২৪ এর অগাস্ট এ। এ আন্দোলনের স্বকীয়তা তার নতুন রকমের ভাবনায়। প্রতিবাদের এত বৈচিত্র, এত বিভিন্ন প্রকরণ গত পঞ্চাশ বছরে চোখে পড়েনি “।
নতুন গান, নতুন শ্লোগান জন্ম নিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। হোক কলরব আন্দোলনের শ্লোগান ও নতুন চেহারায় ফিরে এসেছে। রাস্তা জুড়ে গ্রাফিতি, প্রতিদিনের মিছিল, পথসভায় হারিয়ে যাওয়া গণসংগীতের সঙ্গে নতুন গান উঠে এসেছে। প্রতিদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে দ্রোহসাহিত্যের তালিকা। এক দ্রোহের অভিঘাতে জেগে উঠছে বিগত দ্রোহের চর্চা ।
২০২৪ এর বই মেলার অন্যতম বিষয় দ্রোহসাহিত্য। ২০২৪ এর ডিসেম্বরে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম এর সম্পাদনায় ধর্মতলার অবস্থান মঞ্চে প্রকাশিত হয়েছিল প্রবন্ধ ও কবিতা সঙ্কলন ‘দ্রোহকাল ২০২৪’। অভয়া মঞ্চের সম্পাদনায় বই মেলায় প্রকাশিত হল নির্বাচিত কবিতা সঙ্কলন ‘দ্রোহের দিনলিপি’। নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্কট ও তিলোত্তমা’।
সুতপা চক্রবর্তী ভট্টাচার্য র দুইটি বই প্রকাশিত হয়েছে, একটি শ্রীসুন্দরম প্রকাশনা থেকে দ্রোহের গল্পগুচ্ছ, অন্য টি গ্রন্থমিত্র প্রকাশনার অগাস্ট থেকে ডিসেম্বরের কবিতা। গ্রন্থমিত্রম থেকে আর একটি গল্পের বই, লায়লী মুখোপাধ্যায়ের ‘তিলোত্তমা তোমার জন্য’।
সৃজন ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় এন বি এ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘জাগরণের নাম তিলোত্তমা- আর জি কর আন্দোলনের ইতিবৃত্ত’। আন্দোলনের শুরুর দিকের কালপঞ্জি এবং প্রকরণ নিয়ে আলচনা আছে এই বইয়ে ।
দিনলিপির আঙ্গিকে নীল মালাকার লিখেছেন ‘দ্রোহ কালের DIARY’. শালিধান প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আন্দোলনকে ঘিরে যে হাজার হাজার মানুষের আবেগ উদ্বেলতা সেই মানুষেরাই নীলের লেখার প্রধান উপজীব্য।
‘আমরা’ প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে মোহিত রণদীপ আর শুভ প্রতিমের সম্পাদনায় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘দ্রোহকালের দলিল’। নিরন্তর প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে সঙ্কলন ‘দ্রোহের ভাষ্য’ ।
কুচবিহার প্রতিবাদী সংগঠন সিটিজেনস ফর জাস্টিস থেকে প্রকাশিত হয়েছে সঙ্কলন গ্রন্থ ‘দ্রোহের বেণু’ ।
শারদীয় অনুষ্টুপে শ্যামল চক্রবর্তী ৮০ র দশকের চিকিৎসক আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন। সুজাত ভদ্র লিখেছেন আর জি কর আন্দোলন নিয়ে। লিঙ্গ রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন্ রিয়া মুখার্জি।
সি পি আই (এম এল) এর মুখপত্র দেশব্রতী পত্রিকায় ‘সার্বজনীন স্বাস্থ্য ও মানুষের অধিকার ’ এবং শ্রমজীবী সংগঠন থেকে প্রকাশিত শ্রমজীবী ভাষা তে ‘সংগঠকের চোখে’ প্রবন্ধে অভয়া আন্দোলনের অন্যতম কর্ণধার ডঃ পুণ্যব্রত গুণ খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন।
মাতৃভূমি প্রভৃতি পত্রিকায় অভয়া আন্দোলন, স্বাস্থ্য দুর্নীতি নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ আছে। ‘অনিডায়েরি ও বন্ধুরা ‘ থেকে প্রকাশিত হয়েছে দ্রোহ-সঙ্কলন ‘তিলোত্তমা র বন্ধুরা’।
প্রণতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ডঃ শুভাংশু পালের দ্রোহকালের দিনলিপি’ আর ডঃ পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষমশাল জ্বলে- শহীদ তিলোত্তমাকে নিয়ে কবিতামালা’ । শুভাংশুর বই টির পরিধি ৯ অগাস্ট থেকে ২৯ অক্টোবর- অনশন অবস্থান প্রত্যাহার পর্যন্ত। তথ্য ও বিশ্লেষণে এই সময়ের অন্যতম সেরা দলিল।
প্রকাশিত হয়েছে রাত দখল অধিকার দখল সংগঠনের লিঙ্গ রাজনৈতিক বার্তা ‘রুটি গোলাপের ইশতেহার। অনুরাগ মৈত্রেয়ীর সম্পাদনায় রঙ ধনু প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে অনন্তর। Counter Era প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে বহ্নিহোত্রী হাজরার বই- ‘নির্ভয়া থেকে তিলোত্তমা’-মুক্তি কোন পথে’। এই বই এ গণ আন্দোলনে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ে শক্তিশালী আলোচনা আছে।
সাহিত্য গবেষণা ও সামাজিক রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে অভয়া আন্দোলন। অভয়া আন্দোলন আর ন্যায় বিচারের দাবির সঙ্গে নারী ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষের অধিকার, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবিগুলিও সামনে চলে এসেছে।
পথসভায় কয়েক যুগ পর কিছু গান শোনা যাচ্ছে যে গুলো লেখা হয়েছিল অতীতের কোন গণজাগরণের প্রেক্ষাপটে। ‘ও আলোর পথযাত্রী’, ‘গৌরীশৃঙ্গ তুলেছে শির’ , ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’ , ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে ‘ – এই গানগুলি আবারো জোয়ারের স্বপ্ন দেখায়। এর পাশাপাশি নতুন গান তৈরি হচ্ছে। অরিজিৎ সিং এর ‘আর কবে আর কবে কণ্ঠ শক্তি পাবে, আর কবে আর কবে চিত্ত স্বাধীন হবে’ এই সময়ের জনপ্রিয় সুর হায়ে উঠেছে। পল্লব কীর্তনিয়ার ‘সূর্যোদয়ের আগে’ নতুন ভোরের দিশা দেখায়। অভয়া মঞ্চের সহযোগী সংগঠন মানবজমিন ‘গানপন্থী’ নামে একটি মিউজিক্যাল ট্রুপ তৈরি করেছে যারা বেশ কিছু নতুন গান তৈরি তৈরি করছে । ‘অভয়া এক আগুনের নাম’, ‘স্বাস্থ্যের কঙ্কাল, শিক্ষার জঞ্জাল মুক্ত সুস্থ এক সমাজের/ রেখে যাব আমাদের স্নেহে গড়া শিশুদের/তাই চলো মিলি দ্রোহ শপথে’ অথবা ‘অভয়ার জন্মদিন আমাদের দ্রোহের দিন/হোক খুনি ধর্ষকের বিনাশের কালো দিন/ তিলোত্তমার ভয় নাই/দ্রোহের পথ ছাড়ি নাই/ যতদিন না বিচার পাই/এই লড়াই এ ছেদ নাই’- প্রতিবাদের সঙ্গীত প্রতিরোধ সংগঠিত করতে সাহায্য করছে।
নতুন প্রতিবাদী নাটক সাংস্কৃতিক পুনর্নির্মাণকে সম্পূর্ণ করছে। সম্প্রতি ধর্মতলার অবস্থান মঞ্চে একটি নাটক মঞ্চস্থ হল যেখানে অভয়া-কে রক্তকরবীর নন্দিনী আর সফক্লিসের আন্তিগনের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। দ্রোহের কার্নিভালে মঞ্চস্থ হয়েছে নিশান রচিত ‘বাবা তুমি ঘুমিও না’- বেদনাবিদ্ধ বাবা মা র আখ্যান। শ্রীরঙ্গম আর বাংলার অভয়ার নতুন প্রযোজনা ‘আবার হীরক রাজা’। সীমা মুখোপাধ্যায়ের রঙ রূপের নতুন নাটক ‘আমার দুর্গা’ , ‘স্বর্গে জীবন্ত মানুষ’ । পুরানো নাটক ও অভিনীত হচ্ছে। ‘স্পেয়ার পার্টস’ নাটকটি সারা রাত ধরে অভিনীত হয়েছে দ্রোহের নাট্যোৎসবে ।
পথের লড়াই এর পাশাপাশি এই নতুন সংস্কৃতির নির্মাণ- চলতেই থাকবে।
রাজনীতির কালবৈশাখীর ঝড়, সংস্কৃতির মরা বানে জোয়ার- এই সবই একটি মৃত্যুর অভিঘাত, যে মৃত্যু কোন সাধারণ মৃত্যু নয়। ‘একটি মৃত্যুর আঘাতে চূড়ায় নেমেছে ধ্বস’…
এই মরণের ‘ভারে “হার মানে ওই পাহাড় হিমালয়, সব মরণ নয় সমান। “
লড়াই তীব্র থেকে তীব্রতর হোক, প্রতিবাদের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হোক – এই হোক জন্মদিনের মৃত্যুঞ্জয়ী শপথ –
‘মিছিলের সমস্ত পা একসাথে /তালে তালে বেজে উঠলে
অনুনাদে ভেঙ্গে পড়ে/ দম্ভের হীরক মিনার ‘
তথ্য-ঋণ
ডঃ পুণ্যব্রত গুণ
স্মরজিত রায়
সীমা মুখোপাধ্যায়
ইলোরা দেবনাথ
সমন্বয় সেনগুপ্ত
কবিতা ঋণ
প্রতুল মুখোপাধ্যায়
দেবাশিস গোস্বামী