গত সপ্তাহেই ক্ষুব্ধ হয়ে আমি আমার স্কুলের বন্ধুদের হোওয়াটস অ্যাপ গ্রুপ থেকে বেরিয়ে গেলাম। আমার এক অত্যন্ত কাছের বন্ধু ডাক্তারদের ‘প্রফেশনাল’ বলেছিল। এতে অবশ্য আমার আনন্দিত হবার কথাই ছিল; কিন্তু আমি তা হতে পারিনি। কারণ, সে ‘প্রফেশনাল’ বলতে বোঝাতে চেয়েছিল, ডাক্তাররা অর্থলোভী ও রোগীদের সম্পর্কে উদাসীন। তারা যেন তেন প্রকারেণ অর্থ উপার্জনেই উৎসাহী। বেশিরভাগ মানুষই ‘প্রফেশনাল’ বলতে এরকম একটা বিরুপ ধারণাই মনে মনে পোষণ করেন। আমার মনে হয় আমরা অনেকেই পেশা কি সে সম্পর্কে সম্মক অবগত নই। তাই, আমরা প্রায়শ একটা বড় ভুল করে ফেলি। পেশা বলতে আমরা বিশেষ এক ধরনের জীবিকা বুঝি যার এক এবং একমাত্র লক্ষ্য বহু অর্থ উপার্জন করা। আদতে, এটা ঠিক উল্টোটা। পেশা ও জীবিকা এক নয়, এ দুটির মধ্যে মৌলিক তফাৎ আছে, যেটা সকলের বুঝে নেওয়া দরকার।
পেশার প্রকৃত সংজ্ঞা দেওয়া মুশকিল। বস্তুত, এটা সমাজতাত্ত্বিকদের কাজ, ডাক্তারদের নয়। পেশা এমন এক বৃত্তি বা জীবিকা যেখানে অত্যন্ত উঁচুমানের শিক্ষা, জ্ঞান ও কুশলতার প্রয়োজন হয়। অভিধান বলে, পেশা বলতে এমন এক জীবিকা বোঝায় যা বৌদ্ধিক ও কায়িক কুশলতার তুল্য-মূল্য সংমিশ্রণ। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক চিত্রকলা, ভাস্কর্য বা শল্যচিকিৎসার কথা, যেখানে মানুষের ক্রিয়াকুশলতা বুদ্ধি ও চিন্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণভাবে যে কোন জীবিকা এমন কোন জিনিস উৎপন্ন বা ব্যবস্থাপনা করে যা বিক্রয়যোগ্য। পেশা এক্ষেত্রে একটু সতন্ত্রতার দাবী রাখে। এই প্রসঙ্গে পেশার বিশেষত্বটা একটু বিশদে আলোচনা করলে পেশার সঙ্গে জীবিকার প্রভেদটা আমাদের বুঝতে একটু সুবিধা হবে।
প্রথমতঃ, পেশার মাধ্যমে যে কাজ সম্পন্ন হয় তা বিশেষত্ব এবং কুশলতার দাবী রাখে। এই ধরনের কাজে কায়িক সক্ষমতার তুলনায় মানসিক সক্ষমতা আরো জরুরী। পুঁথিগত বিদ্যা এক্ষেত্রে যথেষ্ঠ নয়, হাতেকলমে শিক্ষার অভিজ্ঞতাও পেশার ক্ষেত্রে অবশ্য প্রয়োজনীয়। একজন দর্জি, বৈদ্যুতিক বা কলমিস্ত্রীরও তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করবার জন্য নিঃসন্দেহে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু কিছু কিছু কাজের জন্য এই প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা এমন বিশেষ মানের হওয়া আবশ্যক যা অত্যন্ত কঠিন ও উচ্চমানের। ধরা যাক, উকিল বা চার্টার্ড আকাউন্টেন্টদের কথা। বিশদ জ্ঞান, শিক্ষা ও দক্ষতাই একমাত্র তাদের সফলতার চাবিকাঠি।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল নীতি ও মূল্যবোধ। পেশা এমন এক উচ্চমানের মূল্যবোধ দাবী করে যা সাধারণ নীতি এবং সততারও ঊর্ধ্বে। পেশাগত নীতিবোধ এমনই হতে হবে যা কোন কোন ক্ষেত্রে উপভোক্তার চাহিদা পূরণ নাও করতে পারে। ধরা যাক, একজন রোগী তার ডাক্তারের কাছে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য এলেন। ডাক্তারবাবু যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছেন যে এই প্রতিস্থাপন অপারেশনে কোন আর্থিক লেনদেন নেই, ততক্ষণ তিনি এই অপারেশন করবেন না। খেয়াল করতে হবে যে, এক্ষেত্রে ডাক্তারবাবু কিন্তু তার রোগীর চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে পারলেন না। আবার, একজন স্থপতি পরিবেশ ও মানুষের সার্বিক স্বার্থের বিরুদ্ধে কোন কাজ করতে পারেন না। ধরা যাক, কেউ তার কাছে এমন এক নির্মাণকার্যের প্রস্তাব নিয়ে এলেন যা বন ও বন্য পশুপাখিদের আস্থানার ক্ষতিসাধন করবে। বহু অর্থের প্রস্তাব পেলেও তিনি এই নির্মাণকার্যে নিজেকে জড়িত করবেন না। তেমনি, যে কোন কোম্পানির চার্টার্ড আকাউনটেন্ট তার পেশার প্রতি দায়বদ্ধ, এমনকি তা তার মক্কেলের স্বার্থের পরিপন্থী হলেও।
তৃতীয় বিষয়টি হল, পেশা নিয়ন্ত্রণ। এটা পেশার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট। দুভাবে পেশার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সংস্থাগত নিয়ন্ত্রণ। চার্চের পাদ্রীদের আদিম পেশাজীবীদের মধ্যে ধরা হয়। তারা কিন্তু আত্মনিয়ন্ত্রিত। মুম্বাই এবং কলকাতায় কিছু কিছু সলিসিটর আছেন যারা ব্রিটেনের সলিসিটরদের মত কাজ করেন। এদেরও কিন্তু নিজনিয়ন্ত্রিত পেশা।
কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেশা কোন সরকারী সায়ত্বশাসিত সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ডাক্তার, উকিল ও চার্টার্ড আকাউনটেন্টরা এই দলে পড়েন। এদের কর্মকান্ড ন্যায় ও নীতিবোধের উপর নির্ভর করে সুচারু ও সুনির্দিষ্টভাবে সম্পন্ন হয় যার জন্য তাদের জীবিকা পেশার সমমানে উন্নীত হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বলে রাষ্ট্র তাদের এই কাজকে আইনগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। একটা বিষয় এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন। পেশা আত্মনিয়ন্ত্রিতই হোক আর রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিতই হোক, তা কোন সুসংহত সংগঠিত সংস্থা ছাড়াও কাজ করতে পারে, যাকে সম্মিলিত সংস্থা বলা যেতে পারে। কিন্তু, সামাজিক অনুমোদন থাকা সেক্ষেত্রে অবশ্যই জরুরি। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পেশার ক্ষেত্রে একটা আইনগতভাবে স্বীকৃত নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকে। ডাক্তারদের ক্ষেত্রে যা মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া অথবা (2019 সাল থেকে) ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল। যারা এই সংস্থার নথিভুক্ত, একমাত্র তারাই ভারতে চিকিৎসা পেশা নির্বাহ করবার অধিকারী। কোন ডাক্তার এই সংস্থায় নথিভুক্তিকরণ ব্যতিরেকে ভারতে আইনগতভাবে কোন রোগীর চিকিৎসা করতে পারেন না।
চতুর্থত, পেশা সাধারণভাবে অতিশয় সম্মান ও সামাজিক স্বীকৃতি ভোগ করে। স্বভাবতই পেশাজীবীদের তার বিনিময়ে সমাজকে কিছু বেশি দিতে হয়। কারণ, তার কাছে সমাজের আশা অন্যান্য বৃত্তিধারীদের তুলনায় বেশি। তাই, যে কোন জীবিকাই শেষপর্যন্ত পেশায় উন্নীত হবার স্বপ্ন দেখে।
এই শেষ কারণটিই অধুনা কালের চিকিৎসা সম্পর্কিত যত জটিলতার উৎস বলে আমি মনে করি। চিকিৎসা এমন একটা পেশা, বেঁচে থাকবার জন্য যার সাহায্য যে কোন মানুষকেই গ্রহণ করতে হয়। তা, সে মানুষ যতই ক্ষমতা ও অর্থের অধিকারী হোন না কেন। সাম্প্রতিক করোনা মহামারী তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সকল মানুষকেই ডাক্তারের সংস্পর্শে আসতে হয় এবং ডাক্তারবাবুকে চিকিৎসার প্রয়োজনে এমন এমন গোপন তথ্য তার কাছে প্রকাশ করতে হয়, যা সে এমনকি ধর্মগুরুর কাছেও করবার কথা ভাবতে পারে না। যন্ত্রণা ও কষ্ট মানুষের মধ্যে থেকে তার সত্যিকারের সত্ত্বা উন্মোচিত করে। চিকিৎসকের সৌভাগ্য হয় মানুষকে সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও সত্যরূপে অবলোকন করবার। পেশা হিসেবে চিকিৎসকের প্রতি মানুষের বিশ্বাস আর পেশাজীবী হিসেবে মানুষের প্রতি চিকিৎসকের বিশ্বাসযোগ্যতা – এই দুইয়ের মিলন পেশা হিসেবে চিকিৎসককে অনন্য মাত্রায় উন্নীত করেছে, যা চিকিৎসক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আরো বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং, “প্রফেশনাল” হিসেবে সংকুচিত নই, বরং আমরা গর্বিত। সঙ্গে সঙ্গে “প্রফেশনাল” হিসেবে নিজেদের উপযুক্ত করে তৈরি করার জন্য আমাদেরও আরো বেশি বেশি করে ভেবে দেখবার অবকাশ রয়েছে ।
খুব ভালো আলোচনা।
আপনাকে আমি ডাক্তার হিসেবে ভীষণ ভাবে মান্য করি। আপনি প্রফেশানাল আমি মানি না। আপনার এই লেখা খুব ভালো লাগলো।
আলোচনাটি ভালো লাগল। দুটি কথা যোগ করতে চাইলে আশাকরি অপরাধ নেবেন না। সংসদের অভিধান বলে জীবন ধারণের জন্য যে কাজই করি তাই জীবিকা। ‘পেশা’ এই শব্দটিও বাংলা ভাষায় প্রায় একই অর্থ বহন করে। বরং কিঞ্চিত হীন অর্থে। অর্থাৎ কেবল মাত্র ব্যবসার জন্য যে কাজ করা হয় তা ই পেশা। (সংসদ)
বিষয়খানি ইংরেজি ভাবধারায় ব্যাখ্যা করলে আসল অর্থটি ধরা পড়ে বলে মনে হয়। আর তাতে অসুবিধা কিছু নেই, কারণ আমরা বহু আধুনিক মত বা দর্শনের ব্যাখ্যায় ইউরোপীয় তত্বের আশ্রয় নিয়ে থাকি।
Livelihood শব্দটির বাংলা অভিধানগত ও ব্যবহারিক অর্থ জীবিকা। ইংরেজিতে means of earning money in order to live. (Oxford) বেঁচে থাকতে যে অর্থের প্রয়োজন সে বিষয়ে কোন অস্পষ্টতা নেই।
Profession হল সেই কাজ যাতে জীবিকা অর্জিত হয় অবশ্যই তার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয় উচ্চ মানের শিক্ষা ও দক্ষতা। A type of job that needs special training or skill, especially one that needs a high level of education. (Oxford)
তাই একজন Professional ব্যবসায়ী নন। দক্ষ ও নিজ বৃত্তিতে বিশেষ শিক্ষিত একজন মানুষ। আর Professional মানুষটি চিকিৎসক হলে সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত যথাযথ মানবিকতা। যথাযথ শব্দটির পরিধি নির্দেশ করে চিকিৎসক, রাষ্ট্র ও সমাজের পারস্পরিক দায়। এবং তা mutually non-exclusive.
Excellent write up dada..that too in such a lucid language..you have a commendable resource on Bengali vocabulary as well..greatly enriched by your presentation.. Waiting for many more of these type of eye opening messages to the society..
খুউব সুন্দর আর সঠিক কথা। ভালো লাগল।