মালগাড়িটা স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে। একত্রিশ … বত্রিশ … যাঃ শেষ হয়ে গেল। ছোটবেলা থেকে বিজনের এই এক মজার খেলা। মালগাড়ির কামরা গোনা।
এমনি ট্রেনের কামরাও গোনা যায়। কিন্তু সেগুলো ছোট। সবই আট নইলে বারো। গোনার কোনও মজা নেই। মালগাড়িতে অনেক কামরা। আবার তার রকমফেরও অনেক। কতকগুলো চার চাকার। ছোট। আবার কতকগুলো কামরার আটটা করে চাকা। সেগুলোকে দুটো কামরা ধরলে হয়। বিজন কিন্তু তা ধরেনা। যে মালগাড়ির কপালে যেমন জুটেছে। এ অবধি সবচেয়ে বেশি যা পেয়েছে বাষট্টি কামরার মালগাড়ি। বাষট্টি না তেষট্টি? বাষট্টিই হবে। ইঞ্জিন আর গার্ডের কেবিন ধরে। ওই বাষট্টিটা পেরোনো যাচ্ছেনা। তাই বিজন আজও এত বড় হয়েও মালগাড়ি দেখলেই গোনে। গুনলও।
মালগাড়ি নাকি অনেক অনেক কামরারও হতে পারে, একশ দেড়শ দু’শ। গণপতিকাকু বলেছিল।
পুরো নাম গণপতি বাস্কে। বাবা মা কিন্তু গণপতিকাকুকে চিনতো না। লেভেল ক্রসিংএ দাঁড়িয়ে, হেঁটে স্কুলে যাবার পথে, মালগাড়ির কামরা গোনা প্রথম যখন শুরু করে, গণপতিকাকু ছিল রেলের গেটম্যান।
মা শিখিয়েছিল, বড়দের কাকু বলে ডাকতে। কি করে গণপতিকাকুর ভাব হয়েছিল ছোট্ট বিজনের সাথে, আজ আর মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, বিজনের রেলগাড়ি নিয়ে যে কোনও প্রশ্নের এনসাইক্লোপিডিয়া ছিল গণপতিকাকু। এখন বোঝে বিজন অনেক প্রশ্নেরই কোনও মানে ছিলনা। অনেক উত্তরও তাই হত লাগামছাড়া। বেশি লেখাপড়া ছিল না কাকুর। যা ছিল, বুকভরা অনন্ত সাহস। ইয়া ইয়া চেহারার বাস ট্রাক ড্রাইভার, কেউ কেউ মাতালও বোধহয়, গেট বন্ধ থাকলে, নেমে এসে ঝামেলা করত।
– অ্যাই গেটওয়ালা, আভি গেট খুল। নেহি তো মার ডালুঙ্গা।
খুব তাড়া থাকত কারওর। কীসের তাড়া কে জানে। হয় তো তাড়াতাড়ি পৌঁছুতে হবে। কিম্বা পেছনে তাড়া করেছে কেউ।
গেট খুলে দেবার জন্য টাকা দেবার লোভ দেখাত। চেঁচামেচি করে গালাগালি দিত। মারবে বলে ভয় দেখাত। সেই নির্জন বন্ধ রেলগেটে একলা মানুষ গণপতি অটল হয়ে বসে থাকত শুধু।
কোনও কোনও দিন বিজন অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করত, -ও কাকু, তুমি কেন ইঞ্জিন চালাতে পার না? তুমি কবে মালগাড়ি চালাবে গো?
-চালাব চালাব। দাঁড়া, আগে ড্রাইভার হবার পরীক্ষাটা দিই, তবে না!
-আমকে নিতে হবে কিন্তু। আমি লাইন দেখে তোমাকে বেছে দেব, কোন লাইনে যেতে হবে।
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠত কাকু, -আরে বোকা, কোন লাইনে গাড়ি যাবে সেটা ড্রাইভার ঠিক করে নাকি? সেটা ঠিক করে স্টেশনে থাকা মাস্টারবাবু আর কেবিনম্যান।
-তবে তুমি মাস্টারবাবুই হও, নইলে কেবিনম্যান।
-দ্যুৎ! আমি ড্রাইভার না হলে তুই ইঞ্জিনে বসে দেশ দেখবি কেমন করে?
স্রেফ তাকে নানান দেশ দেখাবার জন্য গণপতির এই আত্মত্যাগ, বিজনকে মুগ্ধ করে দিত।
-কটা বগি থাকবে তোমার মালগাড়িতে কাকু?
-দেড়শ দু’শ, তোর যেদিন যেমন ইচ্ছে হবে। চার পাঁচটা আলগা ইঞ্জিন লাগিয়ে নেব, খুব লম্বা হয়ে যাবে যেদিন।
কাকু কোনওদিন বলেই নি, তার নিজেরও সারা জীবনের স্বপ্ন ওই ড্রাইভার হওয়া।
হায়ার সেকেন্ডারির পর গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় পড়তে চলে এল বিজন। কাকু তার আগেই রেলগেট ছেড়েছে। ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা দিয়ে, তদ্বির করে সে নাকি গাড়ি চালাবার অনুমতি পেয়েছে। গেটম্যান থেকে ড্রাইভার হওয়া … রেলের চাকরিতে এ এক অসাধ্যসাধন। গণপতিকাকুর কথা শুনে বলেছিলেন রঞ্জন মেসোমশাই। তিনি ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হওয়া বন্ধু সলিলের বাবা, নিজে স্টেশনমাস্টার।
গণপতিকাকু দেশ দেখাবে বলেছিল। ইঞ্জিনে পাশে বসিয়ে। সেই ভাবে দেখা হয়নি দেশ।
তা দেশ দেখেছে বই কি বিজন। অনেক দেশ দেখা হল। প্রথমে মাস্টারস আর পিএইচডি পোস্ট ডক করতে আমেরিকা। তারপর চাকরি করতে করতে এখন এই ইউরোপ। মা বাবা গত হয়েছেন দু’জনেই। দেশের সাথে যোগাযোগ বলতে কিছু আত্মীয়বন্ধুর সাথে ইমেইল চালাচালি।
সেই ক্লাস ইলেভেনের বন্ধু সলিলের ছেলে আবীর ওর সেই রকম অসমবয়সী এক ইমেইল বন্ধু। দেশের খবরাখবর জানায়।
রেলগাড়ি, বিশেষ করে মালগাড়ি এখনও ওকে টানে খুব। গণপতিকাকুর সাথে ঘুরে দেশ আর দেখা হয়নি। কিন্তু মালগাড়ি দেখলেই আজও বিজন বগি গোনে। হোকনা বিদেশ, তবু পুরোনো অভ্যাসে খেয়াল করতে চেষ্টা করে মালগাড়ির ড্রাইভারের মুখটা। যদি চেনা চেনা লাগে!
ওর এই শহরের বাসাটা রেললাইনের খুব কাছে। আল্পসের কোলে, এখানে বরফ পড়ে খুব। দিগন্তে বরফঢাকা পাহাড়ের দিকে ছুটে গেছে অসীমে মিলিত হওয়া সমান্তরাল রেখা।
পৃথিবীর এই উত্তরবারান্দায় শীতের ঋতুতে সন্ধ্যে নামে খুব তাড়াতাড়ি। আগের মালগাড়িটার পর আবার একটা মালগাড়ি যাবে। স্টেশন থেকে বাসায় ফিরতে গিয়ে ফেরা গেল না। এটাও দেখে তবে যাওয়া যাক।
এই মালগাড়িটাকে দেখে বিজনের অবাক হবার পালা। একমনে কামরা গুনতে গুনতে, একি রে দু’শও পেরিয়ে গেল যে। ঠিক যে রকম বলেছিল গণপতিকাকু, অবিকল সেরকম অনেকগুলো ইঞ্জিন লম্বা ট্রেনটার মাঝে মাঝেই গুঁজে দেওয়া।
আর কী আশ্চর্য, প্রত্যেকটা ইঞ্জিনেই বসে গণপতিকাকু। এমনকি শেষের গার্ডের কামরাতেও রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে। বিজনকে হাত নাড়তে নাড়তে সবকটা গণপতিকাকু বরফ ঢাকা দিগন্তের দিকে চলে গেল।
বিজন জানে অসম্ভব। এই দূর বিদেশের মনখারাপের আবছা আলোয় এই দেখা চোখের ভুল ছাড়া আর কিচ্ছু না।
বিজন যেটা জানে না, আজই বাড়ি ফিরে মেইলবক্সে আসা আবীরের চিঠিতে খবর পাবে, রিটায়ার করার তিনমাস আগে, মাত্র গতকাল, জঙ্গলের মধ্যে ওই মালগাড়ি নিয়েই গণপতিকাকু যাচ্ছিল নাশকতার মাইনপাতা রেলরাস্তা দিয়ে।
আজ দেশের সবকটা কাগজে বিস্তারিত বেরিয়েছে, ইঞ্জিনটার দিগন্তে মিশে যাবার খবর।