মাঝেমাঝেই বন্ধুমহল থেকে ফোন আসে পরিবারের বা ঘনিষ্ট কারো মৃত্যু হয়েছে, কোন মেডিকেল কলেজে দেহদান করতে চান, কিন্তু সেখানে নিতে চাইছে না ইত্যাদি।
মরণোত্তর দেহদান (Posthumous Body Donation or Body Donation After Death or Body Donation) এক মহান দান যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি মানুষের মৃতদেহের (Cadaver) ব্যবচ্ছেদ (Dissection) করে হাতে কলমে মানব দেহের গঠনতন্ত্র (Anatomy) শিক্ষা লাভ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও অস্ত্রোপচার (Surgery) প্রশিক্ষণ, গবেষণা (Research) প্রভৃতি কাজেও এর ব্যবহার।
বিশিষ্ট সমাজসেবী শ্রী ব্রজ রায় প্রমুখের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গে মরণোত্তর দেহদান আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ১৯৭৭ এ ‘গণদর্পণ’ সংস্থা গড়ে ওঠে। সেই থেকে বহু মানুষ ‘গণদর্পণ’ এর মাধ্যমে অথবা সরাসরি রাজ্যের মেডিকেল কলেজ গুলির এনাটমি বিভাগে দেহদান করে আসছেন।
এর সঙ্গে ‘গণদর্পণ’ কলকাতার Regional Institute of Opthalmology (RIO) এবং অন্যান্য Eye Bank এর সাহায্যে মরণোত্তর চক্ষু দানের (Eye Donation After Death) গুরুত্বপুর্ণ কাজটিও করে থাকে। মৃত্যুর চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে চক্ষু সংগ্রহ করে তার কর্নিয়া ও স্ক্লেরা অংশ প্রতিস্থাপিত করে (Transplantation) বহু অন্ধজনে আলো দেওয়া যায়। চোখের বাকি অংশটিও নানানরকম গবেষণার কাজে লাগে।
এই দেহ ও চক্ষুদানের বিষয়টি মৃত্যুর আগে থেকেও করে রাখা (Pledge and Consent) যায়, মৃত্যুর পরেও মৃত ব্যক্তির ইচ্ছা মেনে তার পরিবার করতে পারে। তবে আগে থেকে করে রাখাই সুবিধাজনক।
এবার আসা যাক শুরুতে বলা অসুবিধা কোথায়? ঘটনা হল অল্প সংখ্যক সচেতন মানুষ দান করলেও যে পরিমাণ মৃতদেহ আমাদের রাজ্যে পাওয়া যায়, রাজ্যের মেডিকেল কলেজগুলির সীমিত পরিকাঠামোয় সেগুলি সংরক্ষণ ও ব্যবচ্ছেদের জন্য প্রস্তুত (Refrigeration, Embalming, Moisting etc.) করা সম্ভবপর হয়না। তাই সব মৃতদেহ গ্রহণ করা যায় না। অতীতে আমাদের রাজ্য থেকে সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারত এবং অন্য জায়গায় মৃতদেহ পাঠানো হত। এখন নানারকম অনভিপ্রেত ঘটনায় ও জটিলতায় সেগুলি ব্যাহত হয়েছে।
মরণোত্তর দেহদান এর বিষয়টি তো আছেই আমাদের উন্নত দেশগুলির মত ‘মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরেই অঙ্গদান (Organs Donation After Brain Death)’ এর উপর জোর দেওয়া উচিত যার ফলে অসংখ্য অসুস্থ এবং দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। হৃদপিণ্ড (Heart), দুটি ফুসফুস (Lungs), যকৃৎ (Liver), অগ্ন্যাশয় (Pancreas), ক্ষুদ্রান্ত্র (Small Intestines) এবং দুটি বৃক্ক (Kidneys) যেমন অন্যদেহে প্রতিস্থাপিত করা যায়, সেরকমই চোখের কর্নিয়া (Cornea), শিরা (Veins), কোষগুচ্ছ (Tissues), হাড় (Bones), হাত (Hands), চামড়া (Skin), হৃদপিণ্ডের কপাট (Heart Valves) ইত্যাদিও প্রতিস্থাপিত করা যায়। সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রতিস্থাপনের নির্দিষ্ট নিয়মাবলী আছে। একেকটি অঙ্গ মস্তিষ্কের মৃত্যুর পর সর্বাধিক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিতে হয়। যেমন, হার্ট ও লাং চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে, লিভার আট থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে … । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংগ্রহ করা যায় তত ভাল এবং একসঙ্গে করে নিতে পারলে আরও ভাল।
মস্তিষ্কের মৃত্যু বা ব্রেন ডেথ হল এমন এক না ফিরে আসা (Irreversible) অবস্থা যখন কোন ব্যক্তির মস্তিষ্ক ও মস্তিষ্ক কাণ্ড (Brainstem) অকস্মাৎ কোন গুরতর রোগে অথবা দীর্ঘ রোগভোগের পরে অথবা বয়:জনিত কারণে অথবা কোন দুর্ঘটনার কারণে তাদের কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় (Complete Loss of Function)। এমতাবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ventilator ইত্যাদিতে রেখে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস দের সচল রাখা গেলেও আর প্রাণ ফিরে আসতে পারে না। উন্নত দেশগুলিতে এই অবস্থাকেই মৃত্যু হিসাবে গ্রহণ করা হয়। Transplantation of Human Organs and Tissue Act 1994 (THOTA 1994) অনুযায়ী এবং নিয়ামক সংস্থার নির্দেশিকা মেনে চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত চারজনের একটি বোর্ড এই অবস্থায় নির্দিষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ব্রেন ডেথ ঘোষণা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত।
আরও মহৎ দান ‘মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরেই অঙ্গ দানে’ ইচ্ছুক ব্যক্তিরা রাজ্যের নিয়ামক সংস্থা কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতালে অবস্থিত Regional Organ and Tissue Transplant Organisation (ROTTO) এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। On line এও সম্মতিপত্র পাওয়া যায়। ROTTO জাতীয় সংস্থা NOTTO এর অধীনে কাজ করে। মানব অঙ্গ ও মানুষের মৃতদেহ নিয়ে নানাবিধ বেআইনি ও চোরা কারবারের কারণে সতর্ক হয়ে সঠিক স্থানে অঙ্গ ও দেহদান করা উচিত। দালাল, অবৈধ ব্যাবসায়ী, চোরাচালানী দের খপ্পরে যাতে পরতে না হয়।
‘মরণোত্তর দেহদানে’ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা ও নির্দিষ্ট কিছু গবেষণা উপকৃত হলেও ‘মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরেই অঙ্গদানে’ অনেক বেশি বেশি সংখ্যক জীবিত মানুষ যাদের কোন জন্মগত ত্রুটির কারণে অথবা পরবর্তী এক বা একাধিক দুরারোগ্য ও গুরুতর রোগের কারণে কিংবা কোন দুর্ঘটনায় একান্ত প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলি (Vital Organs) ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় অঙ্গ, কোষ ইত্যাদি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তারা সকলে উপকৃত হন। ‘মরণোত্তর দেহদান আন্দোলনের’ মত এবং আরও এগিয়ে ‘মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরেই অঙ্গদান’ আন্দোলনকে গুরুত্ব দেওয়া ও জনপ্রিয় করা উচিত। এটিই আজকের দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি। এর সঙ্গেসঙ্গে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ‘স্বেচ্ছামৃত্যু (Euthanasia)’ নিয়েও আন্দোলন ও স্বীকৃতি অর্জন জরুরি, যে বিষয়ে আগে একদিন আলোচনা করা হয়েছিল।











