জুনিয়র ডাক্তাররা যে আন্দোলন করছেন তার দাবিগুলো যে ন্যায্য এবং তাতে এই ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্য্যবস্থার কিছু উন্নতি হতে পারে, তাতে উপকৃত হবেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। রোগী ভর্তির জন্য সেন্ট্রাল রেফারেল সিস্টেম আর কোন হাসপাতালে কত বেড খালি আছে সেটা ডিজিটাল প্লাটফর্মে দেখতে পাওয়া কিংবা হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের যে বিপুল পদ খালি আছে সেগুলো পূরণ করা, এই সকল দাবিগুলো তো সরাসরি জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত।
অভয়া খুনের তদন্ত দ্রুত শেষ করে তার ন্যায় বিচারের দাবিটি নিয়ে অনেকেই বলছেন যে এটা এখন রাজ্য সরকারের হাতে নেই তাই এই দাবিটি অযৌক্তিক। কিন্তু ন্যায় বিচার মানে অপরাধ যারা করেছে তাদের শাস্তি দেওয়া নয় শুধু, যে কারণে এই ঘটনা ঘটেছে সেই কারণগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত দ্রুত শেষ করে নির্মূল করার চেষ্টাও অভয়ার ন্যায় বিচার। পাশাপাশি প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা যারা করেছে তাদের চিহ্নিত করা ও শাস্তি সেও ন্যায় বিচারেরই অঙ্গ। এই ঘটনায় দেখা গেছে প্রশাসনিকভাবে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা হয়েছে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ভয়ঙ্কর দুর্নীতির চক্র গড়ে তুলেছে প্রশাসনিক যে সকল কেষ্ট-বিষ্টুরা তাদের অনেকেই আবার এই প্রমাণ লোপাটের সঙ্গে জড়িয়ে। তারা এখনও নানান পদ আলোকিত করে আছেন, রাজ্য সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন তদন্ত বা প্রশাসনিক পদক্ষেপ করেনি। অতীতে যখন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল তখনও যেমন করেনি কিছুই এখন প্রমাণ লোপাটের পরেও চোখ বুজে বসে। একটা সাধারণ উদাহরণ দিই। সামাজিক মাধ্যমে ঘুরতে থাকা ছবিতে দেখা গেল খুনের ঘর অর্থাৎ সেমিনার রুমে নির্যাতিতার দেহ ঘিরে অজস্র অবাঞ্ছিত লোকজনের ভীড়, যারা শাসকদলের এবং থ্রেট কালচার আর দুর্নীতি চক্রের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের মুখে প্রেস কনফারেন্স ডেকে পুলিশের ডিসি নর্থ থ্রেট কালচারের অন্যতম মুখ অভীক দে-কে সেমিনার রুমের ভীড়ের ছবিতে দেখিয়ে পুলিশের ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ বলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন, ছবি ক্রপ করে আরেকজন থ্রেটারকে বাদ দিয়েছেন। এরকম জঘন্য মিথ্যাচার করে দিব্যি পার পেয়ে গেলেন তিনি (সম্প্রতি অনশনমঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর অন্যতম দূত হিসেবেও দেখা গেল তাঁকে)। কিন্তু এও তো আসলে একটা প্রমাণ লোপাটেরই চেষ্টা! সুতরাং ঘটনাবলী একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় অভয়া ঘটনায় রাজ্য প্রশাসন তার দায় এড়াতে পারে না। অভয়ার ন্যায় বিচারের তদন্ত নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রথম দাবিটি তাই যথাযথ। তাদের পরবর্তী দাবিগুলোর ভেতরে স্বাস্থ্যসচিবের অপসারণসহ প্রতিটি মেডিকেল কলেজে তদন্ত কমিটি বসিয়ে এই থ্রেট কালচারের নায়কদের শাস্তি দেওয়া, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নীতি নির্ধারক কমিটিগুলো পার্টির সিলেকশান নয় ইলেকশানের মাধ্যমে নির্বাচন এবং ছাত্র ও জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিত্ব, মেডিকেল কাউন্সিল ও মেডিকেল রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের ব্যাপক দুর্নীতির তদন্ত, ডাক্তার ও সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রকৃত নিরাপত্তার ব্যবস্থা, তাদের বিশ্রামাগার ইত্যাদির দাবি আসলে প্রথম দাবিটিরই পরিপূরক।
এখন কথা হল এই প্রবল দুর্নীতিগ্রস্ত যে ব্যবস্থা, জাল ওষুধের কারবার, হাসপাতালের বর্জ্য বিক্রি, টাকা নিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করানো, ডাক্তারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রি, হাসপাতালের টেন্ডারে সিন্ডিকেট রাজ, শাসক পার্টির নামে রন্ধ্রে রন্ধ্রে থ্রেট কালচার ইত্যাদি ইত্যাদি অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়া স্বাস্থব্যবস্থা, যার শিকার আমাদের ডাক্তার মেয়েটি তার দায় কার? অবশ্যই স্বাস্থ্যসচিবের এবং তাঁর মাথার ওপরে যিনি বসে আছেন সেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর! এই যে প্রশাসনিকভাবে অভয়া মৃত্যুর প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা হল এর দায় কি স্বাস্থ্যসচিব এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নয়? টালা থানার ওসি প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু একজন ডাক্তার হাসপাতালের ভেতর কর্মরত অবস্থায় নৃশংসভাবে খুন ও ধর্ষিত হয়েছেন। এই জঘণ্য অপরাধ আড়াল করে তাঁর লাভ কী? তার কাছে কি তাহলে ওপর মহলের নির্দেশ এসেছিল? আবার দুর্নীতি কর্মকান্ডের যিনি মাস্টার মাইন্ড সেই সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ বারবার স্বাস্থ্য দফতর এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে এলেও তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করা যায়নি। অভয়া কান্ডের পর প্রবল চাপের মুখে তিনি যখন পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তদন্ত শুরু না করে উল্টে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ করে দেন। তাহলে বিষয়টা দাঁড়ালো এই যে এই সকল কারণে যদি স্বাস্থ্য সচিবের অপসারণ চাইতে হয় তাহলে একই কারণে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিটাও অনিবার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু জুনিয়র এবং সিনিয়র ডাক্তাররা প্রথমদিন থেকে আজও বিস্ময়করভাবে এই দাবিটি তোলেননি। কেন?
প্রথম থেকে জুনিয়র ডাক্তাররা এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক দলগুলোর পতাকা-বৃত্তের বাইরে রাখতে চেয়েছেন, বলেছেন এটা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলন অর্থাৎ অদলীয় আন্দোলন। তাদের এই সিদ্ধান্ত দুর্দান্ত সফল। এর ফলে আপামর সাধারন মানুষের সমর্থন এসেছে অভূতপূর্বভাবে। দলীয় পতাকাবিহীন নাগরিক আন্দোলনের একটা নতুন চেহারা আমরা পেয়েছি, জনজোয়ার দেখেছি যা অতীতে কখনও ঘটেনি। রাজনীতির খেলায় ধুরন্ধর মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনের শুরুতেই বলে রেখেছিলেন, ‘ওরা আসলে বিচার নয় চেয়ার চাইছে।’ হতে পারে মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে যেহেতু আলাদা করা যাচ্ছে না জুনিয়র ডাক্তাররা তাই স্বাস্থ্যসচিবের অপসারণ অবধি তাদের দাবিটাকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন পাছে ওই চেয়ারের গল্পটি এসে পড়ে এবং এই আন্দোলনটিকে ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক আন্দোলন বলে দাগিয়ে দিয়ে জনবিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা না হয়। এটা যুদ্ধের একটি কৌশলগত দিক বলেই আমার মনে হয়। এই আন্দোলনের প্রতি জুনিয়র ডাক্তারদের সততা, নিষ্ঠা ও ত্যাগ দেখার পর এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা বের করা মুশকিল।
জুনিয়র ডাক্তাররা স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে খানিকটা কলুষমুক্ত করার জন্য তাঁদের জীবন বাজি রেখেছেন। তাঁরা জয়ী হলে জনগণেরই ভালো হবে। আর জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের এই আমরণ অনশনকেও কদর্যভাবে কটাক্ষ করছেন। যখন মৃত্যুর প্রান্তসীমায় তাঁদের কাউকে কাউকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে তখন তাকে উপহাস করছেন। যখন অনশনকারীর ডাক্তার সঙ্গীরা বুঝতে পারছেন আর অপেক্ষা করলে অনশনকারী বন্ধুকে বাঁচানো যাবে না, সে সজ্ঞা হারিয়েছে বা হারাতে চলেছে, তখন তাঁরা কী করবেন? চোখের সামনে সঙ্গীকে মরে যেতে দেবেন? আর ডান্ডিয়া নাচবেন নীরো থুড়ি রাণী?
জুনিয়র ডাক্তাররা দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন। কিন্তু তাদের একার দায় নয় এই স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলার এবং অভয়ার ন্যায় বিচার ছিনিয়ে আনার। এখানে দায় আমাদেরও।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বছরের পর বছর ধরে চলা স্বাস্থ্য-দুর্নীতির কিছু জানতেন না, হাসপাতালে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা জানতেন না, অভয়াকান্ডের প্রমাণ লোপাটের কিছু জানতেন না এযুক্তি অবিশ্বাস্য। আর সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে এই যুক্তিতেইতো চরম অপদার্থতার জন্য তাঁর এইমুহূর্তে সরে যাওয়া উচিত! জুনিয়র ডাক্তাররা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি নাও তোলে যদি নাগরিক সমাজের ভেতর থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ ও তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তের দাবিটি প্রবল আকারে তোলা উচিত। জনগর্জনের মত তোলা উচিত। না হলে যাই হোক না কেন অভয়ার ন্যায় বিচার কিছুতেই সম্পূর্ণ হবে না।