সেদিন হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ পেলাম। একটা ছবি—সহাস্যবদনে অরবিন্দ কেজরিওয়াল। গলায়, কানে, মাথায়, চিরপরিচিত শেয়ালরঙা মাফলার। নীচে লেখা ‘মুখ্যমন্ত্রী মাফলার পরে ফেলেছেনঃ শীতের আগমনবার্তা সরকারিভাবে ঘোষণা করল আবহাওয়া দপ্তর’।
বাঙালি কিন্তু আসলে থার্মোমিটার দেখে নয়, ক্যালেন্ডার দেখে সোয়েটার পরে। শুধু সোয়েটার কেন, (পৌষ-মাঘ বললে গুলিয়ে যেতে পারে) ডিসেম্বর পড়তে না পড়তেই অবধারিতভাবে মাফলার ( আমাদের জনৈক বাহনচালক বলতেন, মামলার। আবার কখনো কখনো মামলেটও বলতেন), মাঙ্কিটুপি, নানা ধরনের শাল, উলের মোজা আর তার সাথে ইদানীং যোগ হয়েছে কান ঢাকা ইয়ার মাফ।
শুধু দার্জিলিং-সিমলা-গুলমার্গ নয়, আমাদের দত্তপুকুর, শ্যামবাজার বা গগন সরকার লেনেও একই অবস্থা। বিশ্বাস না হয় একবার সকালের দিকে ভিক্টোরিয়ার চত্বরে বা লেকের দিকটায় ঘুরে আসুন। আর মফঃস্বল শহর বা একটু গ্রামের দিকে তো কথাই নেই।
শীত-পোশাকের আড়ম্বর দেখলে মনে হবে বরফ পড়েছে। আমাদের সেই বাহনচালক বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকেই তাঁর ‘মামলার’ পরে ফেলতেন। অথচ এ বঙ্গে পনেরো থেকে পঁচিশের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে শীতের বিস্তার! মানে সেলসিয়াস। কখনো কখনো ভুল করে প্রায় দশের আশপাশে পৌঁছে গেলে তো আর রক্ষে নেই। টিভির পর্দায় স্ক্রোল, ব্রেকিং নিউজ, খবরের কাগজে হেডলাইন, সর্বত্র এক কথা। ফেসবুকেও আদ্যিখেতার চূড়ান্ত। সাড়ে বারো না পোউনে তেরো—তাই নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ সরগরম।
ব্রিটিশদের আর কিছু না পাক, আবহাওয়া নিয়ে ভাবনাহীন কথার বদভ্যাসটা বাঙালির মজ্জাগত। সমস্যাটা অবশ্য মজ্জায় নয়, হয় ত্বকে!
আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের বৃহত্তম অঙ্গ, আমাদের সব্বার প্রাথমিক ঠিকানা, এই ত্বকে।
কী রকম?
বিস্তারে বলি।
শীতের পোশাক থেকে যেটা হয় সেটা হল কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস। আগেই বলেছি, তেলা মাথায় তেল দেবার মতো, স্বল্প শীতে অতিরিক্ত শীতপোষাক পরা বাঙালির বদভ্যাস। তাতে ঘাম জমে ত্বকের ওপর। ফলে সৃষ্টি হয় এই প্রদাহমূলক ত্বকরোগের আদর্শ পরিবেশ।
কাপড়ের ফেব্রিক, পোশাকের ফিনিশিংয়ের গলদ, গরম পোশাকে ব্যবহৃত ‘অ্যাজো’ ডাই বা প্যারাফিনাইল-ডাই অ্যামিন থেকে ত্বকের প্রদাহ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে শিশুদের কোমল ত্বকে।
সুতির কাপড় থেকে সাধারণত সমস্যা হয় না, তবে ব্যবহৃত রঙ থেকে হতে পারে। আর অসমান, নিম্নমানের ফিনিশিং থেকে। মজার কথা হল রেশম বা সিল্ক থেকে কিন্তু ত্বকের সমস্যা হয় না, এটা একটা প্রাকৃতিক তন্তু। তবে পলিয়েস্টার পোশাকের প্রতিটি ধরন থেকে ঝামেলা পাকতে পারে।
অ্যাফ্রাইলিক, ওরিয়ন, পলিভিনাইল রেসিন বা স্পারক্যাপটোবেনজোল, নামের দিক থেকে যেমন, সমস্যা সৃষ্টির দিক থেকেও মারাত্মক।
মোজা, ব্রেসিয়াআর বা অন্যান্য অন্তর্বাসে স্প্যানডেক্স নামে একটি প্রসারণশীল পরিইউরেথেন ফাইবার থাকে। কোমরে, বুকে, পায়ে প্রদাহ তৈরি করতে এর জুড়ি মেলা ভার।
এছাড়া গরম পোশাকে থাকা ফরমাল্ডিহাইড থেকে হতে পারে কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস।
এবার আসি উলের কথায়। ভেড়ার গায়ের পশম যতই প্রাকৃতিক হোক তার থেকে সমস্যা হতে পারে। এই উলে থাকে ল্যানোলিন নামে একটি প্রাকৃতিক তেল। অনেকের এই ল্যানোলিনে অ্যালার্জি থাকে।
শুধু ত্বক নয়, উল অ্যালার্জির থাবা পড়তে পারে চোখ—এমনকী নাকেও। শীতের উলেন পোশাক পরে গা চুলকে চোখের জলে, নাকের জলে হতে হামেশাই দেখা যায়। অনেকে আছেন যারা উলে ঠিক অ্যালার্জিক নন, সেনসিটিভ। উলের পোশাকের নীচে সুতির পোশাকের আস্তরণ থাকলে, তাদের সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় শুধুমাত্র সরাসরি স্কিন কনট্যাক্টএ। আর যাদের উলে অ্যালার্জি, তাদের সমস্যার সমাধান অত সহজে হবার নয়। তৈলাধার পাত্র, না পাত্রাধার তৈল এই চুলচেরা বিশ্লেষণে না গিয়ে, এটা বলা যায়, শীতের পোশাকের ফাইবার, রঙ, ফিনিশিং, উল এইসবগুলির সংস্পর্শে কিছু প্রদাহমূলক ত্বক সমস্যা হতে পারে।
ইরিট্যান্ট ডার্মাটাইটিসঃ ইরিট্যান্ট ডার্মাটাইটিস অর্থাৎ ত্বককে সরাসরি বিরক্ত, উত্যক্ত করে এমন কিছু তীব্র, অম্ল, ক্ষার বা উদ্বায়ী বাহক থেকে হওতয়া সমস্যা। এটা সবার হতে পারে।
অ্যালার্জিক ডার্মাটাইটিসঃ সবার নয়, কারও কারও হয়। পোশাকের কোনো না কোনো উপাদান থেকে অ্যালার্জি।
কীভাবে বোঝা যায়?
প্রাথমিকভাবে লাল হয়ে, দানা দানা র্যাশ বেরিয়ে চুলকাতে শুরু করে। পরে চুলকে ঘা হয়ে, সংক্রমিত হয়ে মারাত্মক আকার নিতে পারে। প্যাচ টেস্ট করা যেতে পারে, পোশাকের ঠিক কোন উপাদান থেকে সমস্যা হচ্ছে সেটা জানার জন্য। তবে এই টেস্টটি সবসময় নির্ভরযোগ্য নয়।
সবচেয়ে ভালো হল রোগীর কাছ থেকে জেনে নেওয়া ঠিক কোন পোশাকে সমস্যা।
যার উল থেকে সমস্যা তার যে সিন্থেটিক অন্তর্বাস থেকে অ্যালার্জি হবেই তার কোনো মানে নেই। আবার উল্টোটাও সত্যি।
কী করতে হবে?
যদি বোঝা যায় কোন গরম পোশাক থেকে হচ্ছে, সেটি পরা চলবে না। ভালো করে ধুয়ে নিয়ে প্রথমবার পরা উচিত শীতের পোশাক। তাতে কিছু রাসায়নিক ডিটারজেন্ট, রঙ ধুয়ে গিয়ে পোশাকটি কিছুটা নিরাপদ হবে।
বাড়িতে ল্যাক্টোক্যালামিন লাগানো যেতে পারে। আর অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ট্যাবলেট খাওয়া। না কমলে ত্বক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তো আছেনই।
কী করবেন না?
১। যে জায়গাটা চুলকাচ্ছে চেষ্টা করুন নখ দিয়ে না চুলকাতে। বরফ লাগাতে পারেন। ঠান্ডা জলে বারবার ধুতে পারেন।
২। সাবান নয়। সমস্যা বাড়বে।
৩। গন্ধহীন কোনো ভেসলিন জাতীয় ক্রিম লাগাতে পারেন।
৪। স্পিরিট বা অ্যান্টিসেপ্টিক লোশন বা ক্রিম একেবারেই নয়।
৫। যদি প্রাথমিকভাবে চিকিৎসক কোনো স্টেরয়েড ক্রিম ( জেনে নিন) লাগাতে দেন, অতি অল্প পরিমাণে লাগান। বেশি লাগালে বিপদ হতে পারে।
আর সবশেষে বলি, ক্যালেন্ডার দেখে নয়, শীতের পোশাক পরুন শীত পড়লে তবেই। নইলে নয়।