~বারো~
গ্রামের লোকের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে পরাগব্রত ওরফে নাড়ুগোপাল উৎকণ্ঠিত থাকে। যত দিন যায় তত উৎকণ্ঠা বাড়ে বই কমে না। শেষে আর থাকতে না পেরে একদিন চলে গেল সোজা মহামায়াতলার গঞ্জে। ওখানকার হিরো-হন্ডা শোরুম থেকে একটা ১২৫ সিসি মোটরসাইকেল কিনে এনে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাড়ির পেছন থেকে গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা চলে গেছে। খানিকটা গিয়েই রাস্তা এতই সরু যে সাইকেল বা মোটর সাইকেল কিছুই চলবে না। তাছাড়া ওই পথে গেলে সাতটা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পৌঁছনো যায়।
রাস্তার ওপারে কাপড়ের দোকানে তারিক হাবিবকে বলল, “দ্যাখলি? কয়েছিলাম কী?”
হাবিব বলল, “জেরক্ করে ভালোই কামাচ্ছে!”
তারিক বলল, “দূর গবেট, তোর চায়ের দোকানীর বুদ্ধি আর বাড়বে না। বলি জেরক্ শুরু করেছে এই ক-মাস হল। এর মধ্যেই একেবারে বাইক কেনার টাকা? তাছাড়া ভুলিস না, এখেনে আসার আগেও কতদিন বাড়িভাড়া দেছে শামিমকে। এসব দেখে কী বোঝলি?”
হাবিব কিছুই বোঝেনি। বলল, “কী বোঝলাম?”
“দূর, তোর সঙ্গে কথা বলা এক ঝকমারি। ব্যাটার অনেক টাকা — বুঝলি না?”
“তাই? তুই কী করে বুঝলি?”
“সে তোর জেনে কাজ নেই। আচ্ছা, এটা বল, যে লোকটা দিনরাত কেবল দোকানে বসে রাস্তা দিয়ে কে এল-গেল নজর করে, কোত্থাও যায় না, সে মোটরসাইকেল কিনল কেন? গড়বড় আছে রে, গড়বড় আছে।”
হাবিব ঠিক বুঝল না। একটা লোক যদি বা বাড়িতে বসেও থাকে, কালেভদ্রে কোথাও যায়, তবু সে বাড়িতে একটা সাইকেল বা মোটরসাইকেল রাখতেই পারে, কিন্তু তারিক পাছে আবার ওকে বোকা-বুদ্ধু বলে, তাই চুপ করে গেল।
তবে তারিকের সন্দেহটাই খেটে গেল। দু-তিন দিন পরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল হাবিবের চায়ের দোকানের সামনে। সামনে ড্রাইভার, পেছনের সিটে একটাই বাবু। বাবুটা কাচ নামিয়ে মাথা বার করে বললেন, “ও ভাই, আকন্দপুর কি এ-পথেই যাব?”
“আগে বাঁয়ে যেতি হবে…” কথাটা বলতে গিয়ে হাবিবের খেয়াল হল, দোকানের ভেতর থেকে মোড়টা দেখা যাচ্ছে না। সস্প্যান মাজায় বিরতি দিয়ে বেরিয়ে এল। “ও-ও-ই যে, এস্টেট ব্যাঙ্কের এ.টি.এম সাইনবোট — তার পাশেই এ.টি.এম। তার গা দে’ রাস্তা গ্যাছে… না, দূর না, সামনেই… না, রাস্তা ভালো, তবে সরু…”
গাড়িটা চলে গেল। খানিক পরে বন্ধ দরজা খুলে বেরোল নাড়ু। ধুতিটা তুলে নিয়ে মালকোঁচা মেরে রাস্তা পেরিয়ে এসে বসল হাবিবের দোকানের বেঞ্চিতে।
“চা আছে?”
সস্প্যানটা মাজা শেষ করেছে হাবিব। বলল, “এই বসাই।”
নাড়ুগোপাল বলল, “সকালের চা নেই, ফেলাক্সে?”
গ্রামে আসার পর পরাগব্রত অনেক শব্দই ক্রমশ গ্রাম্য উচ্চারণ করতে লেগেছে।
দু-হাতে ছাই, মগে সবে জল নিয়েছে হাবিব, বলল, “ওই তো, সবে বাইনেছি।”
“নিয়ে নিই?” বলে একটা কাগজের কাপে ফ্লাস্ক থেকে নিজেই চা ঢেলে নিল নাড়ুগোপাল। বলল, “কী জানতে চাচ্ছিল গাড়ি থেকে?”
একটু থমকাল হাবিব। বলল, “আকন্দপুরের রাস্তা জানতে চাচ্ছিল।”
“কে?”
আবার থমকাল হাবিব। উঠে দাঁড়িয়ে সস্প্যানটা জায়গামতো রাখতে রাখতে বলল, “চিনিনে। একটা বাবু ছেল। বয়স বেশি না। কইল আকন্দপুর কোন পথে, আমি দেইখ্যে দ্যালাম, চলে গেল। কেন?”
নাড়ুও উঠে দাঁড়িয়ে খাওয়া কাগজের কাপটা ময়লার টিনে ফেলতে ফেলতে গা-ছাড়া ভাবে বলল, “এমনি। গাড়ি করে আকন্দপুরে তো লোক আসে না।”
চায়ের দাম হাবিবের সামনে রেখে নাড়ুগোপাল রাস্তা পেরিয়ে নিজের দোকানে চলে গেল। তারিক নিজের দোকান থেকে বেরিয়ে এসে হাবিবকে জিজ্ঞেস করল, “কেন রে আসছিল?”
হাবিব ঠোঁট ওলটাল। “চা খেল।”
“কিছু বলল জানি?”
“জিজ্ঞেস করল গাড়িতে কে আসছিল, কী জানতে চাইল।”
তারিক বলল, “ক্যানো? কে আসছিল, ক্যানো আসছিল, এসবে তার কী কাজ?”
হাবিব নাড়ুর কাছে শোনা উত্তরটাই বলল। “আকন্দপুরে তো গাড়ি করে বায়রের লোক আসে না।”
তারিক চোখ কপালে তুলে বলল, “আরে ও জানল কী করে গাড়ি কই যাবে?”
হাবিব বলল, “আমি কইলাম।”
হাবিবের বুদ্ধিহীনতায় তারিক চোখ কপালে তুলল, হাবিব-ও কপাল চাপড়ে ভাবল, এতে এত ভাবনার কী আছে?
রাস্তার ওপারে ততক্ষণে নাড়ুগোপাল বাইক নিয়ে রাস্তায় এসে পড়েছে। একজন অপরিচিত কেউ এসে আকন্দপুরের খোঁজ নিচ্ছে, সেটা মোটেই স্বস্তিপ্রদ নয়। কিলোমিটার দুয়েক দূরে রাস্তাটা একটা জায়গায় আড়াআড়ি খোঁড়া হচ্ছে কোনও কারণে। সব গাড়িই সেখানে শম্বুক গতিতে যায়। ওখানে অপেক্ষা করলে ফেরার পথে সহজে দেখতে পাবে গাড়ির আরোহীকে। গামছা এনেছে নাড়ুগোপাল। হেলমেটের নিচে যতটা মুখ দেখা যায়, ততটা গামছায় ঢাকা যাবে সহজেই।
কোভিডের পরে এখনও রাস্তায় গাড়ি চলাচল কম। দূর থেকেই ভাড়া করা সাদা গাড়িটা দেখতে পেল নাড়ু। রাস্তায় ভাঙা জায়গাটা পেরোতে প্রায় থেমেই গেছিল। তাই ভেতরে আরোহীকেও দেখা গেল স্পষ্টই। কমবয়সী ছেলেটা উত্তেজিতভাবে কথা বলছে মোবাইলে। ওর দিকে তাকায়ওনি। চেনে না তাকে নাড়ুগোপাল। কিন্তু তা বলে কি নিশ্চিন্ত থাকা যায়? যায় না। বেশ দুশ্চিন্তা নিয়েই ফিরল। রাস্তার ওপারে হাবিবের দোকানে কেউ নেই। পাশের মদিনা ক্লথ স্টোরে হাবিব আর তারিক বসে। ওর ফেরাটা নজর করছে। ওরা ওকে সারাক্ষণই চোখে চোখে রাখে। ওদের সঙ্গেই নাড়ুগোপালের সবচেয়ে বেশি কথাবার্তা হয়, অথচ নাড়ুগোপাল জানে, এ গ্রামে ওকে যারা পছন্দ করে না, তাদের তালিকার শীর্ষে তারিকের নামই লিখতে হবে। হাবিবকে পরে জিজ্ঞেস করবার কথাও মাথায় এল না, তাই জানতে পারল না, যে আকন্দপুর থেকে বিফলমনোরথ হয়ে ফেরার পথে ওর চকচকে, প্রায়-নতুন সাইনবোর্ডে প্রোপ্রাইটরের নাম দেখে চমকে থেমেছিল সত্যজিৎ। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। হতাশা বদলে গেছিল উল্লাসে। গাড়ি থেকেই সাইনবোর্ডের ছবি তুলে দোকানে গেছিল কাগজ জেরক্স করাবার অছিলায়। দোকান বন্ধ দেখে রাস্তা পেরিয়ে আবার গেছিল হাবিবের দোকানে। চা চেয়েছিল। জানতে চেয়েছিল জেরক্সের দোকানদার কোথায়। হাবিব জানে না। একটু আগেই মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেছে — মানে কাছে-ধারে কোথাও নয়। সেই ফাঁকে, কথায় কথায় সত্যজিৎ ওদের কাছে আরও অনেক খবরই পেয়েছে অযাচিতভাবেই। নাড়ুগোপাল চক্কোত্তি কবে ওখানে এসেছে, কবে দোকান দিয়েছে, শামীমের কাছে দোকান ভাড়া করার সময়ে তার এক মাথা ঝাঁকড়া চুল আর গালভরা কোঁকড়া দাড়ি, আর নকডাউন উঠে যাবার পর ওদের অবাক করে দাড়ি কামানো, চাঁছা-মাথা প্রায় নতুন লোকের আবির্ভাব… সব শুনেই উত্তেজিত সত্যজিৎ ওর মামার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ফিরছিল, এ.সি গাড়িতে কাচ-তোলা না থাকলে নাড়ুগোপাল শুনতেও পেত ওর কথা।
মামা তারাশঙ্করও সব শুনে উত্তেজিত। বললেন, “তুই এখনই চলে আয়। ওখানে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিস… শয়তানটা যদি সন্দেহ করে, আবার গা-ঢাকা দেবে।”
শহরে ফিরতে বেশ রাত হয়েছে সত্যজিতের। তারাশঙ্কর জেগে বসে রয়েছেন। দুজনে আলোচনা করে স্থির করলেন যে এখনই সিংজীর কাছে খবর নিয়ে যাবে না ওরা। আর একটু শিওর হওয়া দরকার। নাড়ুগোপাল চক্রবর্তীর ছবিও যদি একটা থাকত…
মামা বললেন, “এই, খবরদার! ছবিটবি তুলতে যাসনি আবার!”
মাথা নাড়ল ভাগ্নে। উকিল মামা কি কোনওভাবে নাড়ুর জেরক্সের দোকানের ট্রেড লাইসেন্স কোত্থেকে বেরিয়েছে খবর যোগাড় করতে পারবে না?
পারবে। পরদিন সকাল থেকে নানা ফোন করে তারাশঙ্কর শেষ পর্যন্ত একজনকে পেলেন যে একদিনের মধ্যেই খবর নিয়ে আমোদপুর গ্রামের জেরক্স দোকানের মালিক নাড়ুগোপাল চক্রবর্তীর সব রকম অ্যাপ্লিকেশন, লাইসেন্স, ইত্যাদি কাগজপত্রের হদিস পাবেন। সত্যজিৎ বলল, “বেশি কিছু দরকার নেই। অ্যাপ্লিকেশনে নিশ্চয়ই আধার কার্ড রয়েছে। ওটার কপি পেলেই চলবে।”
~তেরো~
শহরের বিশাল বারোতলা মার্কেট বিল্ডিংয়ের পেছনে, পার্কিংয়ের ওপাশে সিংজীর বাড়ির সার্ভেন্ট কোয়ার্টার। একসারি একতলা ঘর, তার একধারে বাথরুম ইত্যাদি। বাড়ি না-গেলে লক্ষ্মণ ওখানেই থাকে। একই সঙ্গে থাকে সিংজীর অন্যান্য কাজের লোকজন, যাদের একদল কাজ করে লক্ষ্মণেরই তত্ত্বাবধানে। আজ বেশ ক-দিন হল মুখুজ্জেবাড়ি থেকে লক্ষ্মণ ওদের ফেরত পাঠানোর পর থেকে আর কোনও কাজ নেই। ওরা শুয়ে, বসে, ঘুমিয়ে, আড্ডা মেরে আর গাঁজা খেয়েই দিন কাটাচ্ছে। সত্যজিৎ আর তারাশঙ্কর উকিল যেদিন শেষ পর্যন্ত নাড়ুগোপালের আধার কার্ডের কপি জোগাড় করে তার শশ্রূগুম্ফহীন, ন্যাড়ামাথা ছবিতে কম্পিউটার গ্রাফিকসের সাহায্যে একমাথা ঝাঁকড়া চুল আর এক মুখ চাপদাড়ি লাগাচ্ছে, সেই সন্ধেয় নাথুলাল বিছানাতেই শুয়ে ছিল। নানা চিন্তায় মাথা ভরপুর। নাথুর মাথা চলে খুব। সেজন্যই ও সিংজীর বিরাগভাজন হয়েছিল। সারাক্ষণ ‘এটা-না-করে-ওটা-করলে-ভালো-হত’ বলা কর্মচারী মালিকরা পছন্দ করেন না। সেটা অবশ্য নাথু মানে না। ওর ধারণা লক্ষ্মণই কোনওভাবে সিংজীকে প্রভাবিত করে ওর জায়গাটা দখল করেছে। তাই সাত বছর তিনমাস আগের সেই সময়টা ওর মাথায় সবসময়ই ঘোরে, যখন লক্ষ্মণ ওকে প্রথম হুকুম দিয়ে সিংজীর নির্দেশিত কাজে পাঠিয়েছিল। আর বসে বসে ভাবে কী করে লক্ষ্মণের আধিপত্য শেষ করা যায়।
মিনিকে লক্ষ্মণ নিকেশ করে দিয়েছে। সন্দেহ নেই নাথুর। সেদিন যেভাবে ওদের পাহারার দায়িত্ব শেষ হয়েছিল হঠাৎ, এবং তার পরে আর যেতে হয়নি — তার অর্থ মিনি আর ও বাড়িতে নেই। কিন্তু সেদিন রাতে লক্ষ্মণ বাড়ি ফেরেনি। পরদিন সকালে যখন ভ্যান গাড়িটা নিয়ে গেট দিয়ে ঢুকেছিল, তখন নাথু গেটের কাছেই। লক্ষ্মণ একাই ছিল।
শুধু, নাথু যদি জানত এমনটা হতে চলেছে তাহলে অন্তত একবার মিনিকে ভোগ করত। নিচের ঘরে বসে বসে সে কথাই ভাবত এতদিন নাথু। কল্পনা করত ওর লোমশ বুকের নিচে মিনির ছোট্ট দেহটা পিষছে। আর…
হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসল নাথু। তাই তো! লক্ষ্মণের হাবভাবও তো সেই সেদিন থেকেই একেবারে বদলে গেছে! আর ওদের সঙ্গে সময় কাটায় না, সপ্তাহে দু-তিন দিন ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’ বলে চলে যায়। লক্ষ্মণের পাতানো মায়ের প্রতি এই দুর্বার আকর্ষণ নাথুর হঠাৎ বিকট-রকম অদ্ভুত বলে মনে হতে লাগল।
বিশাল বারোতলা বাড়ির একেবারে ওপরের দু-তলা জুড়ে সিংজীর নিজের বাস। বউ, ছেলে-বউমা, এক ভাই ও তার পরিবার এবং এক স্বামী-পরিত্যক্তা বোন আর এক বিধবা দিদিকে নিয়ে থাকেন তিনি, তার নিচের তলায় রান্নাঘর, খাবার ঘর আর তারও নিচে, ন-তলায় অফিস। দিনের কাজ শেষ হওয়া অবধি লক্ষ্মণকে ওখানেই থাকতে হয়। আজও বসে আছে। সিংজী সাধারণত রাতের খাবার খেতে নামার কিছুক্ষণ আগে ফোন করে বাইরের কর্মচারীদের বিদায় দেন। লক্ষ্মণই সে ফোন ধরে। সিংজীর নির্দেশে লক্ষ্মণের নেতৃত্বে বাকি সবাই চলে যায়, থাকে কেবল রান্নাঘর আর খাবার ঘরের কাজের লোক। ওদের ছুটির সময় নেই। রাতের খাওয়া-বাসন ধুয়ে মুছে সাজিয়ে পরদিন সকালের কাজ অন্ততঃ খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে বেরোতে বেরোতে মাঝরাত পেরিয়ে যায়। আবার ফিরে আসতে হয় সূর্য ওঠার আগেই। সারাদিনে পরিবারের আঠেরো জনের এবং জনা পঁচিশেক কাজের লোকের চারবেলার খাবারদাবার ছাড়াও অজস্র বহিরাগতের অজস্র কাপ চা-কফি-শরবত আর নানান তাৎক্ষণিক খাদ্যের যোগান দিতে হয়। যে কোনও মাঝারি মাপের রেস্তোরাঁর গতি এবং দক্ষতাতেই তাদের কাজ করে চলতে হয়।
লক্ষ্মণের অবশ্য এসবের কথা ভাবার সময়ও নেই, মানসিকতাও নয়। আজ খুব ইচ্ছে বাড়ি ফিরে যাবে মিনির কাছে। আজ সিংজীর বিকেলের পরে কোনও কাজই ছিল না। অনায়াসেই পারতেন সন্ধের আগেই লক্ষ্মণদের ছুটি দিতে। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে তা হয়নি।
ন-তলার জানলা দিয়ে আশপাশের বাড়ির ছাদ টপকে লক্ষ্মণের চোখের সামনে দূরের শহুরে গগনরেখার ওপারে সূর্যটা হলদে থেকে কমলা হয়ে শেষে লাল হয়ে নিভে গেল। এমন সময় বন্ধ দরজার বাইরে গোঁ-গোঁ করে লিফট চালু হবার শব্দ কেন? সিংজী লিফট ডেকেছেন? নামবেন? কর্মচারীদের ছুটি না দিয়েই সিংজী নামছেন কেন? নিচ থেকে ওপরে উঠে আসা লিফট ন-তলায় থামে কেন? আপনা থেকেই ভুরু কুঁচকে গেল লক্ষ্মণের। দরজা খুলে ঘরে ঢুকল ওকিলসাব আর ওই টিকটিকি — সত্যজিৎ। লক্ষ্মণ ওর বসার জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওদের “বৈঠিয়ে,” বলে লক্ষ্মণ বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। লিফটের সামনে। ওকিলসাব এসেছেন সিংজীকে সে খবর দেবার দরকার নেই। সে কাজ সিঁড়ির নিচে দারোয়ান করে দিয়েছে। এখন সিংজী নামলে লক্ষ্মণ ওঁকে সঙ্গে নিয়েই ঘরে ঢুকবে। একটু পরেই আবার গোঁ শব্দে লিফট উঠে গেল আরও ওপরে। লক্ষ্মণ সোজা হয়ে দাঁড়াল। সিংজী এলেন বলে।
ঘরের ভেতরে উত্তেজিত সত্যজিৎ আধার কার্ড থেকে নেওয়া ছবির ব্লো-আপ, আর তাতে ফোটোশপ করে চুলদাড়িগোঁফ লাগানো অবয়ব দুটো পাশাপাশি রেখে বারবার দেখছে। লিফটের শব্দ পেয়ে তারাশঙ্কর চট করে ফাইলের নিচে ছবিগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, “আগেই ছবি দেখাবি না। আগে মুখে বলবি।”
দেখতে দেখতে দরজা খুলে ঢুকলেন সিংজী, পিছনে লক্ষ্মণ। নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে প্রায় গর্জন করে সিংজী বললেন, “কেয়া হুয়া? কেয়া বাত হ্যায়?” সত্যজিৎকে দেখে খুশি হননি উনি। এই সেদিনই এই হতভাগা টিকটিকি কী এক আগড়ম বাগড়ম রিপোর্ট বানিয়ে এনেছিল। সিংজীর ওকে এক পয়সাও দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু কী করা, তারাশঙ্কর ভুজুংভাজুং দিয়ে বাধ্য করেছিল…
তারাশঙ্করের চোখের ইশারায় সত্যজিৎ এক লাইনে সামারি বলল, “পরাগব্রত এখন আমোদপুর বলে একটা ছোটো শহরে একটা জেরক্সের দোকান চালায় ওর আসল নামে — নাড়ুগোপাল চক্রবর্তী।”
সিংজীর চোখদুটো ছোটো হয়ে এল। “কী বললে? তুম সহি জানতে হো?”
সত্যজিৎ একে একে দুটো কাগজ এগিয়ে দিল সিংজীর দিকে। “এটা ওর আধার কার্ডের কপি। আর এটা আধার কার্ডের ছবি — বড়ো করা।”
ছবিটা দেখে সিংজী আপত্তি করে কিছু বলতে গিয়েও চুপসে গেলেন। সত্যজিৎ ওঁর দিকে তৃতীয় ছবি বাড়িয়ে দিয়েছে। আধার কার্ডের ছবির ওপর ফোটোশপ করে কোঁকড়া চুল আর একমুখ দাড়ি। পরাগব্রতকে কখনও কাছ থেকে দেখেননি সিংজী, কিন্তু ক্লোজ আপ ছবি অনেক দেখেছেন। কিছুক্ষণ চুপ করে ছবিটার দিকে চেয়ে রইলেন। এবার সত্যজিৎ শেষ ছবিটা এগিয়ে দিল। পারফেক্ট জেরক্স সেন্টার, প্রপ্রাইটর — নাড়ুগোপাল চক্রবর্তী, আমোদপুর বাসস্টপ। এবার হা-হা করে হেসে উঠলেন সিংজী। “বহুত খুব। বহুত বঢ়িয়া। কেয়াবাত, উমদা,” ইত্যাদি বলে অভিনন্দ জানালেন সত্যজিৎকে। তারপর বললেন, “কাহাঁ হ্যায় ইয়ে জাগাহ? ক্যায়সে জানা হ্যায়?”
ম্যাপ খুলে বুঝিয়ে দিল সত্যজিৎ। মাথা নাড়লেন সিংজী। বললেন, “কাল সোকালেই মিটিং। দশ বাজে। তারপরেই বেরোনো।” লক্ষ্মণের দিকে ফিরে বললেন, “দশ বাজে তক সব রেডি হোনা চাহিয়ে। সব লোগ জানা। কুল মিলাকে দশ আদমি, হ্যায় না? ড্রাইভার লেনা পাণ্ডে ঔর অটল কো। ওহি দো গাড়ি যায়গা। ঔর তুম দশ আদমি — ঔর ইয়ে সত্যজিৎ ভি। দো গাড়ি কাফি। মিটিংকে বাদ বারা বাজে ভি রওয়ানা হো যাওগে, তো আঠ ঘণ্টা মে পহুঁচ যাওগে। ক্যায়সে ভি ভাগনে মত দেনা। ঔর জিন্দা লে আনা।”
ঘাড় কাত করল লক্ষ্মণ। সিংজীর প্ল্যান ওর পছন্দ হয়নি। ওর মন বলছে এখনই রওয়ানা দেওয়া উচিত। এখনই। সারা রাত অপেক্ষা করে পরদিন দুপুর অবধি মিটিং করে চব্বিশ ঘণ্টা পরে অকুস্থলে পৌঁছনোর কোনও মানেই হয় না। কিন্তু এসব কথা লক্ষ্মণ জীবনেও সিংজীকে বলবে না। বরং এখন কত তাড়াতাড়ি উকিল আর ভাগনেকে বিদায় করে বাড়ি যাওয়া যায়, সে দিকে নজর দেওয়া দরকার। আজ যদি মিনির কাছে না পৌঁছতে পারে, তাহলে কাল তো বটেই, হয়ত তার পরের কয়েক দিনও পারবে না। লক্ষ্মণের তলপেট শিরশির করে উঠল।
সিংজী চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ভেতরের ঘরের সিন্দুক থেকে টাকা বের করে এনে একটা বাণ্ডিল সত্যজিতের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “আচ্ছা কাম কিয়া। কাল সুবহে দশ বাজে তক আ যানা। তুমহে ভি যানা হ্যায়। লচমন, ইনকো নিচে তক পহুঁচাকে উপর আনা…”
লক্ষ্মণ আর মামা-ভাগ্নে বেরিয়ে গেলে সিংজী ভালো করে নাড়ুগোপালের আধার কার্ডটা কাছে নিয়ে আবার দেখলেন। তারপরে ফোন তুলে কাকে বললেন, “এক অ্যাড্রেস লিখো জ.রা…” আধার কার্ডে নাড়ুগোপালের ঠিকানা রয়েছে শহরতলীর একটা পাড়ায়। বললেন, ওখানে নাড়ুগোপাল চক্রবর্তী সম্বন্ধে ভালো করে খোঁজ নিতে।
তারাশঙ্কর আর সত্যজিৎকে বিদায় দিয়ে লক্ষ্মণ ফিরে এসে দেখল সিংজী সামনে দুটো নোটের বাণ্ডিল নিয়ে বসে। রাহাখরচের জন্য দুটো বাণ্ডিলই লক্ষ্মণের জিম্মায় দিয়ে সিংজী লক্ষ্মণকে বিদায় দিলেন। লক্ষ্মণ আর দেরি করল না। বাণ্ডিল দুটো পকেটে ভরে সিংজীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা রওয়ানা দিল নিজের বাড়ির দিকে — যেখানে ওর ধারণা ওর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে মিনি।
এখন অবশ্য শুধু মিনি নয়, আর একটা উদ্দেশ্যও আছে। পকেটের অতগুলো টাকা কোনও ভাবেই কাল লাগবে না। অন্তত একটা বাণ্ডিল না নিয়ে গেলেও চলবে। তা থেকেও উদ্বৃত্ত থাকবে। সে-ও লক্ষ্মণেরই ভোগে লাগবে। এত বছরের চাকরিতে কম উপরি হয়নি। খানিকটা জমলেই জমি-বাড়ি কিনে তার সদ্ব্যবহার করে। বাড়িতে ওর লুকোনো টাকার বাণ্ডিল আবার অনেকটাই বেড়েছে। সময় আগতপ্রায়। কিছুদিনের মধ্যেই আরও কিছু জমিজমার মালিক হবে লক্ষ্মণ।
মিনির চিন্তায় বিভোর, তা ছাড়া সাবধানে পথ হাঁটার অভ্যেস নেই, তাই জানতে পারল না, কিছু দূর থেকে নাথুলাল-ও ওর ওপর নজর রাখতে রাখতে পেছনে আসছে।
সিংজীর বাড়ি থেকে হাঁটাপথে বাড়িটা খুব দূরে না হলেও লক্ষ্মণ কোনও দিন ওদের নিয়ে যায়নি বলে নাথুলাল এতদিন চিনত না। আজ চিনল। লক্ষ্মণ বাড়িতে ঢুকে ঘরের জানলা খুলে দেবার পরে ভেতরের মহিলাকেও চিনতে পারল।
নাথুলাল সৌখিন লোক। চুলদাড়ি কাটতেও সমগোত্রীয়দের মতো ফুটপাথের নাপিতের কাছে যায় না। যে সেলুনে যায়, সেখানে ও এককালে সিংজীর ছেলেকে হাত ধরে নিয়ে যেত। ওর হাতের মোবাইলও দামী এবং সৌখিন। সে মোবাইলে মিনি আর লক্ষ্মণের অজান্তে যে ছবি উঠল, তাকে চিত্রকলা না বলা গেলেও, দু-জনকেই চেনা যাচ্ছে। সিংজী সে ছবি থেকে কুশীলবকে চিনতে পারবেন, সেই বিশ্বাস নিয়েই ফিরল নাথুলাল।
~চোদ্দো~
আমোদপুরে রাতের খাওয়া শেষ করে নাড়ুগোপাল ওরফে পরাগব্রত বেশ দুশ্চিন্তা নিয়েই শুতে গেল, কিন্তু ঘুম আসে না। ভুল করল? এখনও আমোদপুর ছেড়ে না গিয়ে আরও ভুল করছে? মনস্থির করতে পারছে না, তাই আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে।
শহরেও রাত গভীর। ঘুম নেই মিনির চোখেও। পাশে লক্ষ্মণ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মিনির মনে উত্তেজনা। এতদিনে পরাগব্রতর হদিস পাওয়া গিয়েছে। সিংজীর লোকজন লক্ষ্মণের নেতৃত্বে তাকে নিয়ে আসতে যাবে। তার পরে কী হবে জানা-ই আছে। যে ভবিষ্যৎ লক্ষ্মণের বদান্যতায় মিনি এড়াতে পেরেছে, সেটা এড়ানোর সৌভাগ্য পরাগব্রতর হবে না। পরাগব্রতকে বাঁচানোর জন্য মিনিকেই এগিয়ে যেতে হবে। মিনি যদি পরাগব্রতর প্রাণ বাঁচায়, ও কি মিনিকে সাহায্য করবে না? আবার ফেলে চলে যাবে? নানা চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মিনি জানে না।
অভ্যাসমতো ঘুম ভাঙল অনেক ভোরে। লক্ষ্মণ উঠে খুটখাট করছে। সকালে সিংজীর বাড়ি পৌঁছে অনেক কাজ। দেরি করলে চলবে না। লক্ষ্মণ তৈরি হয়ে বেরোনো অবধি চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে অপেক্ষা করে রইল। মিনির কপাল ভালো, লক্ষ্মণের মধ্যে কোনও রোম্যান্টিকতা নেই। জৈবিক তাগিদ মিটে গেলেই শেষ। তারপর ভালোবাসা উথলে ওঠে না।
অন্ধকার থাকতেই বেরিয়ে গেল লক্ষ্মণ, নিয়মমাফিক বাইরে থেকে দরজার হুড়কো টেনে দিয়ে। মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে মিনি উঠল। প্রথমেই দু-পায়ের ফাঁকে একটা অস্বস্তি বোধ… তারপর বুঝতে পারা, মাসিকের রক্তপ্রবাহ শুরু হয়েছে। আজই হতে হল? এক লহমা ভয় পেলেও মিনি থমকালো না। দেরি করলে চলবে না। কোনটার পরে কোনটা করবে সেটা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। লক্ষ্মণের দেওয়াল আলমারি থেকে সুটকেসটা বের করে এনে একটা শাড়ি আর ব্লাউজ তাতে ভরে আবার ঢুকিয়ে রাখল আলমারিতে। তারপর রোজ যেমন জানলার পাশের দড়ি ধরে টানে, তেমনই টানল। নিচে তুলসী-বুড়ির ঘরে দড়ির অন্যপ্রান্তে ঘণ্টা বাঁধা, মিনির দরকারে ওভাবেই যোগাযোগ করতে হয়।
গজগজ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল তুলসী। লক্ষ্মণ থাকতেই কেন মিনি সকালের সব কাজ সেরে রাখেনি, কেন বুড়োমানুষকে অনর্থক সিঁড়ি ওঠানামা করাচ্ছে — ইত্যাদি নালিশ করতে করতে কারাগারের দরজা খুলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অন্য দিনের মতো মিনি নিচে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে, আর ওয়াক তুলছে।
মিনি জানে তুলসী ওকে পছন্দ করে না। আর সারাক্ষণই ওকে চোখে চোখে রাখে — যাতে কোনও ভাবে ওর নজর এড়িয়ে মিনি সন্তানসম্ভবা না হয়। বুড়ি নাকি আগে দাই ছিল। ফলে এসব অনেক জানে। লক্ষ্মণ বাড়ি থেকে কাজে ফিরে গেলেই বুড়ি ওকে চা বানিয়ে খাওয়ায়। ওকে বলেছে, এই চা রক্ষা করবে। সত্যি মিথ্যে জানে না মিনি, ভাবে, মন্দ কী? ও তো চায় না লক্ষ্মণের সন্তানের মা হতে।
“কেয়া হুয়া?”
কথা বলতে পারছে না, হাত নেড়ে মিনি বোঝাল, বমি হচ্ছে, বা পাচ্ছে। চেষ্টা করেছিল বমি করতেও, কিন্তু সকালে পেট খালি বলে কিছু বেরোয়নি। অনেকটা জল খেয়ে তা-ই বমি করে রেখেছে খাটের পাশে। সেদিকে একবার তাকিয়ে নাক কুঁচকে এগিয়ে আসছে তুলসী, মিনি বলল, “রক্তও বেরোচ্ছে…”
আবার থমকাল তুলসী। ওর সন্দিহান মন বমি শুনে যে সন্দেহ করেছিল, এখন সেটা টলমল করছে। মিনি হাত বাড়িয়ে একটা রক্তমাখা ভিজে কাপড়ের টুকরো বের করে বিছানার পাশে ফেলল। তুলসী এবার ঘুরে খাটের পায়ের দিকে ফেরা মাত্র মিনি চিত হয়ে শুয়ে হাত দিয়ে শাড়ি গোটাতে শুরু করল, যেন ও চাইছে তুলসী ওকে পরীক্ষা করে।
বহুদিনের অভ্যাসের দাস তুলসী মিনির বাঁ হাঁটুতে হাত রেখে মুখটা সবে নামিয়েছে, মিনির ডান পায়ের লাথি এসে সজোরে পড়ল ওর গালে। লাথির চোটে বুড়ির মাথাটা সপাটে ঘুরে গেল, তুলসী ছিটকে পড়ল, মাথাটা ঠুকে গেল দেওয়ালে, আর তারপর একটা চাদরের মতো গুটিয়ে পড়ে গেল মেঝের ওপর।
মরে গেল? মনে মনে হিসেব করেছিল মিনি — কত জোরে মারবে? দুর্বল একজন বৃদ্ধাকে বেশি জোরে মারা উচিত নয়, আবার, তুলসী বুড়ি হলেও খুব শক্তপোক্ত। বহু পরিস্থিতিতে মিনি নজর করেছে, বেশ ভারি জিনিস তোলা, বা হাতুড়ি দিয়ে কয়লা ভাঙা জাতীয় কাজ সহজেই করে ওর বেঁকে ভাঁজ হয়ে যাওয়া শরীর নিয়েই।
কিন্তু মেরে ফেলতে চায়নি মিনি। তাড়াতাড়ি উঠে বুড়ির নাকের নিচে হাত রাখল। বুঝতে পারছে না। দু হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে বিছানায় শোয়াল। তখনই তুলসী মুখ খুলে একটা আঁ-আঁ শব্দ করল।
যাক, মরেনি। তবে আর সময় নেই। মিনির হাত কাঁপছে। এতক্ষণ, কিছু করার আগে অবধি, উত্তেজনায় বুঝতে পারেনি, কিন্তু এখন ঘটনার সিরিয়াসনেসটা পুরো উপলব্ধি করছে। সবচেয়ে বেশি ভয় হল হঠাৎ যদি লক্ষ্মণ ফিরে আসে… আজ অবধি কখনও আসেনি, এবং আজ ওর অনেক কাজ, কিন্তু বলা যায় না…
যা হবার হয়েছে, এখন দ্রুত পালানো ছাড়া আর উপায় নেই।
দ্বিতীয় বিপদ তুলসীর জ্ঞান ফেরা। তার আগেই… নার্ভ শক্ত করে একটা বিছানার চাদর ছিঁড়ে ফালি ফালি করে তুলসীর হাত-পা বেঁধে ফেলল। তারপর একইভাবে, সিনেমায় দেখা স্টাইলে মুখে ছেঁড়া কাপড় গুঁজে আর একটা কাপড়ের ফালি দিয়ে বেঁধে ফেলল যাতে জ্ঞান ফিরলেও চেঁচামেচি করতে না পারে। তারপর দেওয়াল-আলমারি খুলে দু-নম্বর তাকের পেছনের দেওয়ালের সঙ্গে লেগে থাকা ক্যালেন্ডারটা সরিয়ে সাবধানে আঙুল বুলিয়ে একটা ইঁট টেনে বের করল। তার পেছনের ফাঁকটাতেই লক্ষ্মণের গোপন অর্থভাণ্ডার। মাঝে মাঝেই রাত্তিরে, মিনি ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা করে চোরের মতো উঠে গিয়ে ওখান থেকে ইঁট সরিয়ে টাকা রাখে লক্ষ্মণ। মিনি এ ক-মাসে বেশ কয়েকবার দেখেছে। এর আগে ইঁট সরিয়ে সেখানে কী আছে দেখেও নিয়েছে। মুঠো মুঠো নোট। সবই বেশি টাকার। সুটকেস প্রায় ভরে গেল। এত টাকা! কতটা নেবে? চিন্তাটা মাথায় আসামাত্র তাকে বিদায় দিতে দেরি করল না মিনি। এরা কেউ ওর শুভাকাঙ্ক্ষী নয়। ওকে এতদিনে মেরে না-ফেলার একমাত্র কারণ ওর শরীর। এদের জন্য কষ্ট পাওয়ার, বা দয়াপরবশ হওয়ার কোনও দরকারই নেই।
কিছু নোট শাড়ির আঁচলে বেঁধে নিল। তাৎক্ষণিক খরচাপাতির জন্য বার বার সুটকেস খোলা যাবে না। পাঁচটা সাতান্ন মিনিটে মিনি লক্ষ্মণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা অন্য রাস্তা ধরে বড়ো রাস্তার দিকে রওয়ানা দিল। ওর সঙ্গে তুলসীবুড়ির ফোনটাও রয়েছে। লক্ষ্মণের বিছানায় হাত-পা বাঁধা তুলসী তখনও অজ্ঞান। সবার আগে দূরে কোথাও যেতে হবে। কাছে একটা মল রয়েছে। মিনি পা চালাল সেইদিকেই। পালাবার তাগিদ থাকা সত্ত্বেও বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখতে ভোলেনি, কিন্তু নাথুলাল সাবধান ছিল। ওকে দেখতে পায়নি মিনি।
রাতে লক্ষ্মণ আর ফেরেনি। তবে ভোরে পাণ্ডে গাড়ি বের করতে উঠেছিল বলে নাথুর ঘুম ভেঙে গেছিল। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল এত সকালে কী ব্যাপার? পাণ্ডে অত জানে না। বলেছিল, লক্ষ্মণ তৈরি থাকতে বলেছে। দশটার মধ্যে গাড়ি বেরোবে। কোথায় যাবে লক্ষ্মণ? রাতে তো ফেরেইনি। কৌতূহলে আর ঘুম ধরেনি নাথুর। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে দাঁতন করতে লেগেছিল। সূর্য ওঠার আগেই ফিরে এল লক্ষ্মণ। এত সকালে নাথুকে বাইরে দেখে একটু অবাক হয়েই ভুরু তুলল, কিন্তু কিছু না বলে ঢুকে গেল ভেতরে। একটু পরে আবার দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বলল, “ইধার আ।” ঘরে ঢুকে নাথু দেখল লক্ষ্মণ বিছানায় বসে। বলল, সকাল দশটায় বাবুদের মিটিং। তারপরই বেরোনো। সবাই যেন হাজির থাকে। এর পরই লক্ষ্মণ আবার শুল। নাথু সকলের নজর এড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। দিনের আলোয় যদি ভালো ছবি পাওয়া যায় মিনির…
এত সকালে কোনও দোকানপাট খোলেনি। তবে মিনি যেখানে যাচ্ছে সেখানে মল বাদ দিয়েও অনেক দোকান আছে, অনেকেই বেশ সকাল সকাল খোলে।
রাস্তার ধারে ট্যাক্সি রয়েছে। ট্যাক্সিওয়ালাদের ডাক অগ্রাহ্য করে মিনি সুটকেস হাতে হনহনিয়ে চলছে। পরনের শাড়িটা উগ্র গোলাপি রঙের। ওর সঙ্গে থাকতে আরম্ভ করার কয়েকদিনের মধ্যেই লক্ষ্মণ ওকে নিজের পছন্দমতো শাড়ি এনে দিয়েছিল। যে শাড়িগুলো মিনি সঙ্গে এনেছিল সেগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ন্যাকড়া বানিয়েছিল তুলসী। মিনির পায়ে হাওয়াই চটি। এগুলো ছেড়ে মিনি নিজের পছন্দমতো পোশাক পরতে উদগ্রীব হয়ে রয়েছে, কিন্তু কাপড়ের বা জুতোর দোকান খুলতে এখনও অনেক দেরি। অতক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। তাহলে লক্ষ্মণদের আগে পরাগের কাছে পৌঁছনো যাবে না।
খেতে হবে। নিজের ফোনে টাকা ভরতে হবে। তা নাহলে ওলা আউটস্টেশন বা উবার ইন্টারসিটি বুক করা যাবে না। তুলসীর সিম কার্ডের ডেটা প্ল্যান কী জানে না মিনি, কিন্তু ইন্টারনেটভিত্তিক কিছুই করতে পারছে না মিনি। ফেসবুক বা ইমেইল তো দেখতে পাচ্ছেই না, ম্যাপটাও কাজ করছে না। সুইচ অফ করে দিল ফোনটা।
মলের উলটোদিকের কফিশপ-টা সকাল সকাল খোলে। আজও একটা কালো টি-শার্ট পরা ছেলে সামনের শাটারটা টেনে তুলছে। তারপর চাবি ঘুরিয়ে কাচের দরজার নিচের আর ওপরের তালা খুলতে না খুলতে মিনি দরজা ঠেলে ঢুকল। ছেলেটা এমন একজন খদ্দের আশা করেনি নিশ্চয়ই। এরকম পোশাক পরা মেয়েরা এ দোকানের সামনে দিয়ে যায়, ঢুকতে সাহস করে না। হাত তুলে কিছু একটা বলতে গেছিল, কিন্তু তার আগেই মিনি ওকে একটা ক্যাফে ল্যাটে আর গতকালকের সবচেয়ে কম বাসী স্যান্ডুইচ দিতে বলে ভেতরের একটা টেবিলে বসল।
চোস্ত ইংরেজিতে কফি, আর পরিষ্কার বাংলায় স্যান্ডউইচের অর্ডার পেয়ে ছেলেটা প্রথমে অবাক হলেও পরে কফি নিয়ে হাসিমুখে এসে বলল, “ওয়েলকাম ম্যাম। অনেক দিন পরে এলেন। আজ শুট আছে?”
সিংজীর কাছে পালিয়ে যাবার আগে এই ক্যাফেতে কয়েকটা শুট করেছে বটে মিনি। ওয়েটার ওকে চিনেছে, কিন্তু মিনি চিনতে পারেনি। তবু, সুযোগটা নিয়ে বলল, “আপনাদের ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড বদলে গেছে?”
ছেলেটা কাঁচুমাচু মুখে বলল, “ম্যাম পাসওয়ার্ড তো দেওয়া হয় না…”
মিনি বলল, “ও, কী করি বলুন তো… আমাকে রিচার্জ করতে হবে, একেবারেই ভুলে গেছিলাম… জাস্ট ওইটুকু সময়ের জন্য…”
ছেলেটা দয়াপরবশ হয়ে মিনিকে পাসওয়ার্ডটা বলে দিল। মিনি-ও ফোন রিচার্জ করে প্রথমেই খুঁজে দেখল, আমোদপুর কোথায়। ছ-ঘণ্টার রাস্তা।
একই সঙ্গে ওলা আর উবারের অ্যাপে সার্চ দিল। আছে আউটস্টেশন ক্যাব। আমোদপুর যাবার ভাড়া দশহাজার টাকার বেশি! তা বটে। অতটাই দূর যে। তবে চিন্তা নেই, টাকা আছে। ঘড়ি দেখল মিনি। আটটা কুড়ি। গাড়ি আসতে আধ ঘণ্টা। চট করে বুক করে দিয়ে মিনি গলা তুলে ছেলেটাকে বলল, “স্যান্ডুইচটা খুব ভালো। আর কটা আছে?” আরও অনেক আছে শুনে বলল, “আপনি চারটে করে আমাকে দুটো প্যাক করে দিন।”
ছেলেটা প্যাক করে এনে দিল, মিনি তখন দেওয়ালে রাখা নানা ফেমিনিন অ্যাকসেসরি দেখছে। একটা হ্যান্ডব্যাগ রয়েছে। বেত বা সেরকম কিছু দিয়ে বোনা একটা বাটির ওপর কাপড়ের আস্তরণ, তার মুখে পাজামার মতো বাঁধার দড়ি। মা-র ছিল এমন। বলত বটুয়া।
“এটা কত?”
বটুয়া আর তার মধ্যে রাখার একটা শান্তিনিকেতনী স্টাইলের মানি-পার্স কিনল মিনি। ছেলেটাকে বলল বিলটা তৈরি রাখতে। তারপর, সুটকেস থেকে ট্যাক্সিভাড়া আর কিছু রাহাখরচের টাকা বের করে পার্সে ভরে বটুয়াতে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতেই ফোন বাজতে শুরু করল। ক্যাব ড্রাইভার। কোথায় আসতে হবে বলে দিয়ে মিনি বিল মিটিয়ে যা যা কিনেছে সে সব নিয়ে বেরোতে যাবে, ওয়েটার ছেলেটা বলল, “চলে যাচ্ছেন, ম্যাম? শুটিং হবে না?”
শুটিং! এই রে! ভুলেই গেছিল কী কথা হয়েছিল। চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু এখানে না তো। এখন লোকেশনে যাব।”
একহাতে টাকা ভর্তি সুটকেস, আর এক হাতে পার্স-সহ বটুয়া আর স্যান্ডউইচের ব্যাগ নিয়ে বেরোল মিনি। অদূরে অপেক্ষমান নাথু চট করে একটা ফুটপাথের গাছের আড়ালে লুকিয়ে মোবাইলের ক্যামেরা তাক করল।
এই সকালেই রোদের তেজ খুব। এরকম রোদ্দুরে মিনি কখনও মাথাঢাকা স্কার্ফ আর রোদচশমা ছাড়া বেরোত না। শাড়ির আঁচলটা মাথায় দিল। রাস্তার ওপারে একটা চশমার দোকান আছে, কিন্তু খুলতে অনেক দেরি। একটা ওলা-ক্যাব এসে দাঁড়াল ফুটপাথের ধারে। ড্রাইভার ঝুঁকে পড়ে কাউকে খুঁজছে। এটাই। মিনি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে জিজ্ঞেস করল, “ববি পাত্র?”
কমবয়সী ছেলেটা একটু অবাক চোখে তাকাল। মিনি বলল, “আমি মৃণালিনী।” কত বছর পরে নামটা বলল? বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল একটু?
“লাগেজ আছে, ম্…” অভ্যাসমতো ম্যাম বলতে গিয়ে থমকে ড্রাইভার বলল, “দিদি?”
হাতের সুটকেসটা পায়ের কাছে রাখতে রাখতে মিনি বলল, “এই, ব্যাস।” তারপর সিটে বসে দরজা বন্ধ করে বলল, “চলো।”
ফোন ক্যামেরায় ছবি তোলা বন্ধ করে নাথু একবার ভাবল সামনে দাঁড়ানো হলদে ট্যাক্সিটা নিয়ে ধাওয়া করবে কি না। তারপর ঠিক করল, না। এখন ফেরা ভালো।
ক্যাব-টা ইউ-টার্ন নিয়ে বাইপাসের দিকে বেরিয়ে গেল।
ক্রমশঃ