রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের ৩।১।২৫ তারিখের অবৈজ্ঞানিক কল্পনাবিলাসী সার্কুলার, অন্তর্নিহিত প্রতিশোধ-স্পৃহা ও প্রচ্ছন্ন হুমকির নেপথ্য ভাষ্য এবং জয়েন্ট প্লাটফর্ম অফ ডক্টরস, পঃবঙ্গের কিছু কথা
বন্ধু,
এটা সত্যিই এক কঠিন রূঢ় বাস্তব যে রাজ্যের সরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো পরিষেবার প্রশ্নে এক সামগ্রিক দুর্বিষহ শূন্যতাকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের উপরতলার প্রভুরা (!) এবং প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ স্তর দ্বিধাহীন ভাবে নিদারুণ অকর্মণ্যতা এবং চূড়ান্ত ব্যর্থতার স্মারক প্রতিষ্ঠা করেছেন এই সাম্প্রতিক সময়ে, যার করুণ পরিণতি আজকের এই প্রায় পচে যাওয়া সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। স্থায়ী নিয়োগ নেই, সাপোর্ট স্টাফ তলানিতে, জীবনদায়ী ওষুধের আকাল, দালালদের রমরমা, দিনের পর দিন পদোন্নতি আটকে রাখা, ‘মাল্টি সুপারের’ নামে প্রতারণা – তালিকা শুরু করলে শেষ করা প্রায় অসম্ভব। একমাত্র উপজীব্য বিষয়, বিরামহীন দুর্নীতি, বিভিন্ন স্ট্যাটিউটরি প্রতিষ্ঠানে বাঁধভাঙা অনাচার (স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কাউন্সিল, রিক্রুটমেন্ট বোর্ড), নগ্ন স্বজনপোষণ, নিয়মে না-তোয়াক্কা, নৈতিকতার ধর্ষণ – চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিজাড্যে। মহামহিমদের অদ্ভুত হিরণ্ময় নীরবতা। ‘নেই’-এর আর্ত হাহাকার, কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহারে। ঠাণ্ডা ঘরে বসে কড়া নিদানে অসুখ সারতে পারে না, উপশমও দূর অস্ত । সত্যকে স্বীকার করতে অনাগ্রহ, আসল দুর্বলতা সরিয়ে রেখে চিকিৎসকদের বলির পাঁঠা বানানো – ইত্যাদি পদক্ষেপ, আর যাই হোক, পরিষেবার প্রশ্নে কোনো গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে না, মানুষের সাথে একরাশ প্রতারণাকে কয়েক কদম এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তা নিশ্চিত।
কিছু প্রাক-কথন, যা বলা উচিত
১] গত ২০/১০/২৪ তারিখে জয়েন্ট প্লাটফর্ম অফ ডক্টরস এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট পৃথক ভাবে, বাংলার তামাম চিকিৎসক ও জনতা জনার্দনের মনের কথা নিয়ে, অসংখ্য গুরুতর তথ্য সংযোজিত চার্জশিট পেশ করে রাজ্যের বর্তমান প্রধান স্বাস্থ্য সচিবের বিরুদ্ধে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।(প্রতিলিপি সংযোজিত করা থাকল)। উত্থাপিত বিষয়ের জুতসই উত্তর আজও অধরা। আসলে নেই। থাকা সম্ভব নয়। আসল সত্য বড় নির্মম। তাই কি এই প্রতিশোধস্পৃহা? প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সুপ্ত উদগ্র বাসনা? ৩/০১।২৫-এর সার্কুলারের নেপথ্য ভাষণ কি সেই কথাই বলছে, কিছু আলঙ্কারিক আভরণের আবডালে??
২] রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত চিকিৎসকদের সম্মান পুনরুদ্ধারের নির্দেশক এবং জ্বলন্ত দাবী নিরসনে (প্রতিটি ক্যাডার এর জন্য পৃথক ভাবে) যে সুচিন্তিত মতামত বিগত দুবছর আগে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সমীপে পাঠানো হয় এবং রাজ্য স্বাস্থ্য প্রশাসন কাজ শুরু করে বলে জানা যায়, কার বা কাদের অঙ্গুলিহেলনে, তা আজও দিনের আলো দেখতে পেল না? কোথাও কি পেশাজীবীর ন্যায্য পাওনা ও সম্মান প্রতিষ্ঠিত হলে, কারো বা বিশেষ কোনো কায়েমি গোষ্ঠীর বিশেষ অসুবিধা? অতএব স্বর নামাতে, প্রতিহিংসার চোরা সুর-ধ্বনি, ৩-রা জানুয়ারির কালা সার্কুলারে?
৩] যে কাজগুলো দপ্তরের সর্বোচ্চ মহল থেকে করা দরকার ছিল, এতদিন ধরে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে, মানুষের স্বার্থে, সেগুলো কেন হলো না? জবাব কে দেবে? শৃঙ্খলার সব সূত্র ভেঙে পড়েছে। মান্যবর সর্বোচ্চ আধিকারিক মুখ টিপে হেসেছেন, হয়তো বা মৌন সম্মতিতে ইন্ধন যুগিয়ে চলেছেন। সর্বব্যাপী হাহাকার, পচে যাওয়া ব্যবস্থার দায় কি স্বাস্থ্য সচিব এড়িয়ে যেতে পারেন? অগ্রাধিকার কিসে? সম্ভাব্য সমস্ত নীতি-পঙ্গুত্বের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় সর্বনিম্ন বেতনভোগী চিকিৎসকদের নিরলস প্রচেষ্টায় মুমূর্ষু রোগীর যথাসাধ্য পরিষেবা দেওয়া নাকি শুধু ঘণ্টার মারপ্যাঁচে, অন্য একাধিক বৈজ্ঞানিক সত্যকে অন্তরালে রেখে তাদের নিরুৎসাহিত করা?বোঝা দুষ্কর। অবিলম্বে স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রধান সচিবের পদে নতুন কেউ হাল না ধরলে, আঁধার আরো গাঢ় হওয়া সময়ের অপেক্ষা। নৈরাজ্য ঠেকাতে মূলোৎপাটন জরুরি, স্বাস্থ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে।
৪] যে হুমকি সংস্কৃতি (থ্রেট কালচার) আজ সমস্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অভয়া-উত্তর সময়ে বেআব্রু হয়ে পড়েছে, তার প্রশাসনিক দায়, কার উপর বর্তায়? সেই থ্রেট সংস্কৃতির অন্যতম কিং-পিনের বিরুদ্ধে সরকার-গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির বিশদ রিপোর্ট জমা পড়েছে প্রায় চার মাস আগে। আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনাগ্রহী ও অক্ষম, স্বাস্থ্য দপ্তর আজও। কেন? কোথায় কোন গোপন অভিসন্ধি? প্রশাসনের সর্বোচ্চ আধিকারিকদের দায় নয়? নাকি চাইছেন, আরো ভয়ঙ্কর অরাজকতা। আরও প্রসারমান ভয়, হুমকির কাছে প্রশ্নহীন আনুগত্য, নষ্ট কাজের পরিবেশ, দুর্নীতি হোক আরো বেলাগাম – এই চাওয়াগুলোকে সফল করতেই কি নিত্যনতুন তুঘলকি ফরমান? উত্তর পাওয়া সম্ভব?
কল্পনাবিলাসী সার্কুলারের কয়েকটা ভাষ্য ও আমাদের জিজ্ঞাসা
প্রথমেই এটা স্পষ্ট করা জরুরি যে জয়েন্ট প্লাটফর্ম অফ ডক্টরস, তার সীমায়িত সাধ্যে, সরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রান্তবাসীর সর্বোচ্চ সম্ভব সুচিকিৎসার প্রশ্নে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু তা বাস্তব বোধ বিবর্জিত বিলাসী ভাবনা নিয়ে নয়।
তবে এই সাম্প্রতিক আদেশনামার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সবিনয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে অনুরোধ রাখছি–
কলকাতার মধ্যে ২টি ও জেলার নতুন গড়ে ওঠা সরকারী মেডিকেল কলেজের ২টি তে সমস্ত বিভাগে কতজন চিকিৎসক এবং অচিকিৎসক কর্মী রয়েছেন এবং এন এম সি র নিয়ম অনুযায়ী কতজন থাকার কথা, সেইসঙ্গে কতজন রোগী চিকিৎসার জন্য আসে, তার একটা পূর্ণাঙ্গ হিসেব দিয়ে আপনারা বলুন কিভাবে এই আদেশনামা কার্যকরী করা সম্ভব। আপনারা যদি অসমর্থ বা অপারগ হন বা অস্বীকার করেন, তাহলে বলতেই হয়, এই আদেশনামা সরকারী চিকিৎসকদের রাজ্যের সাধারণ মানুষের শত্রু হিসেবে তুলে ধরার অপকৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
তারপরেও কয়েকটা আশু জিজ্ঞাসা
▪︎ সপ্তাহে বিয়াল্লিশ ঘণ্টা – শিক্ষক চিকিৎসক দের জন্য। ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশনের নির্দেশের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ তো? চিকিৎসকের ডিউটির গুণগত ধরন/পরিসর – ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা নিদান হাঁকানো বাবুমশাইদের মত নয় – জানা আছে তো?
▪︎ এত যখন ডিউটির ঘণ্টার ঘনঘটা, তার বিন্যাস নিয়ে সূত্র নির্ধারণে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিনিদ্র রজনী যাপন, তখন টানা ৩৬ ঘন্টার ডিউটিতে নৃশংস প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের বলি কেন অভয়া? উত্তর দিতে কুণ্ঠা কেন?
▪︎ কল্পনাবিলাসী আইডিয়াল বিন্যাস তো কাগজে খচখচ করে লিখে দেওয়া সম্ভব। আরো চিনি-ঘি ঢালা সম্ভব। কিন্তু চাল যে বাড়ন্ত, এ খবর গুণীজন রাখেন তো? আইপিএইচএস/ এনএমসি প্রস্তাবনা অনুযায়ী তো প্রায় চল্লিশ শতাংশ পদ খালি। নীতি মেনে বদলি, সময়ে পদোন্নতির ভাবনা তো অতিভীষণ কষ্টকল্পনা। ইউনিট চালানোর মত প্রকৃত লোকশক্তি আছে তো? প্রমাণ দেওয়া সম্ভব? বাস্তব না বুঝে আদেশনামা বার করা, রোগী না দেখে নিদানপত্র দেওয়ার সমতুল। বৈজ্ঞানিক বোধশক্তির এত অভাব তো ভয়ঙ্কর লজ্জার!
▪︎ হঠাৎ চলে এসেছে ১২ ঘণ্টার ডিউটির নিদান। চিকিৎসকরা কি শ্রম আইনের বাইরে? অন কল ডিউটির অর্থ জানা আছে তো নিদানকারীদের? টানা বারো ঘন্টার বেশি ডিউটি নয়, আবার হাসপাতাল ক্যাম্পাসেই থাকতে হবে সর্বক্ষণ। আসলে চাইছেন টা কি?
▪︎ সহকারী অধ্যাপকদের ফ্লোর ডিউটি কেন? হঠাৎ তাদের প্রাকটিসিং অপশন হরণ করা কেন? সমস্ত হাসপাতালে গ্রূপ ‘এ’ পদমর্যাদার কর্মীর সমতুল বিশ্রামকক্ষ, ওয়াশরুম, আছে তো? সমস্ত স্তরে বাসযোগ্য, ‘সমতুল’ লেভেলের কোয়ার্টার আছে তো? আরএমও নিয়োগে বাধা দিল কে? প্রয়োজনীয় বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে নীতি নির্ধারণ করা উচিৎ – এটা যদি অজানা হয়, তাহলে তো বলতেই হয়….
▪︎ যেখানে এসআর দিয়ে ঠেকনা দেওয়ার প্রবল প্রচেষ্টা, সেখানে তাদের পাওনাগণ্ডা, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সম্প্রসারণ – এ বিষয়ে নীরবতা কেন?
▪︎ ঠিকঠাক ডেথ সারভেইল্যান্স, এমারজেন্সি ট্রায়াজ এরিয়া ক্রিয়াশীল করা, চব্বিশ ঘণ্টা পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা – সত্যিই আজকের দিনে করা উচিত। করবে কে? সাপোর্ট স্টাফ, প্যারামেডিক্যাল কর্মীবন্ধু – তলানিতে। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবকিছু ডাক্তারদের উপর চাপিয়ে দিয়ে, আর যাই হোক, মানুষের উন্নতি হতে পারে না। বুঝে না বোঝার ভান করাটা আর এক ধরনের বড় তঞ্চকতা, প্রতারণা।
▪︎ আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও – এ তো এক অকৃত্রিম শাশ্বত সত্য। সর্বোচ্চ প্রশাসন তাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব আগে পালন করে দেখান। একবার ভেবে দেখতে অনুরোধ রইল– পদোন্নতির ইন্টারভিউ একবছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তা দিনের আলো দেখল না।কেন? মেডিকেল শিক্ষার ডাইরেক্টর এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ মাসের পর মাস খালি। চলছে জোড়াতালি ব্যবস্থা। কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। শূন্য পদের স্হায়ী নিয়োগে তো তালা বহু দিন ধরে। দায় অস্বীকার করতে পারে প্রশাসন?
চিকিৎসকদের পেশ করা চার্জশিটের গ্রহণযোগ্য উত্তর দিন আগে। জরুরী প্রাথমিক কাজগুলোতে মনোনিবেশ করূন। চেষ্টা করুন, কোমায় চলে যাওয়া, ম্যাগট-ভর্তি ব্যবস্থাকে ভেন্টিলেটর থেকে বার করতে। প্রশাসনিক আত্মসমীক্ষা করে আয়নার সামনে দাঁড়ান।
শেষের আগের কথা
তবু যদি শুভবুদ্ধির উদয় না হয়, প্রতিহিংসার হারমোনিয়ামে সুর তোলাই যদি একমাত্র বিবেচ্য কর্মসূচি হয়, তাহলে সামগ্রিক গভীর নৈরাজ্যের পাল্টা বাঁশির প্রতিধ্বনি বেজে ওঠা কিন্তু সময়ের অপেক্ষা। দায় কিন্তু স্বাস্থ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের। মরমী মানুষ এবং চিকিৎসকদের মাঝের অচ্ছেদ্য বন্ধন ভেঙে ফেলা– আপনাদের সাধ্যের অতীত, সাধ যতই তীব্র হোক না কেন। আসছে বাংলার চিকিৎসককূল এবং বঙ্গ জনসমাজ, স্বাস্থ্য প্রশাসনের আরো আরো অজস্র অনাচারের নথি নিয়ে, অদূর ভবিষ্যতে। লড়াই শেষতক। নো পাসারন। আমরা প্রস্তুত। প্রশাসন??
শেষ কথা তোলা থাক ভবিষ্যতের গর্ভে।
ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ
ডাঃ হীরালাল কোনার
যুগ্ম আহ্বায়ক
জয়েন্ট প্লাটফর্ম অফ ডক্টরস,পঃবঙ্গ।
খুবই সহজবোধ্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে বিবরণ।
এখন প্রয়োজন ব্লক স্তরের স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলির সংলগ্ন গ্রামাঞ্চলে টীম করে জনমত সমীক্ষা করা ও তাঁদের সাথে সম্পর্ক করা। এ বিষয়ে অমরা সাহায্যে প্রস্তুত।✊