ঘটনা-১
সরমার মন একদম ভাল নেই। মন আর কী করে ভাল থাকে! কোল খালি। সকাল-বিকেল উঠতে বসতে কথা শুনতে হয়। কলকাতা গিয়ে অনেক চিকিৎসা করিয়েছে। শেষে ডাক্তার বলেছে, টেস্ট টিউবে বাচ্চা নিতে হবে। যা হোক করে বিয়েতে পাওয়া গয়না বিক্রি করে টাকা জোগাড় করছে। ওর বর কেষ্টর তেমন রোজগার নেই। কিন্তু করোনার জন্য এখন সব বন্ধ। কেষ্টও এখন বেঁকে বসেছে। এই বাজারে সে এতগুলো টাকা খরচ করতে রাজি নয়। একে রোজগার নেই। দোকান বন্ধ। খুললেই যে খদ্দের আসবে তারও কথা নেই। তাছাড়া ডাক্তারবাবু বলেছে, ১০ জনের মধ্যে এই চিকিৎসায় ৪ জনের বাচ্চা হবে। ওদের যদি না হয়, তাহলে তো কোলও খালি, হাতও খালি। কেষ্ট তাই বউকে বোঝায়, সামনের বছর চিকিৎসা করলেও তো হবে। এতো আর ক্যানসার নয়, যে চিকিৎসা না করলে সরমা মারা যাবে। কেষ্ট ওকে বুঝলো না, ওর শরীরটা বেঁচে আছে কিন্তু মনটা…
ঘটনা ২
রিয়া এসিটা অন করে দিল। মাঝেমাঝেই ওর হঠাৎ করে বুক ধড়ফড় করে। কেমন একটা প্যানিক অ্যাটাকের মতো। একে তো বাড়ির সব কাজ এখন একাই করতে হচ্ছে। তার ওপর ওয়ার্ক ফ্রম হোম। অনিন্দ্য লকডাউনে ব্যাঙ্গালোরে আটকে গেছে। বাড়িতে একা। বাবা, মা বলেছিল, রিয়ার কাছে থাকবে। কিন্তু ওর এখন একা থাকতেই বেশি ভাল লাগে। তাই কোনভাবে তাঁদের ওখানে আসা আটকে দিয়েছে। কারো সামনে ‘মন ভাল’ র অভিনয় করতে হয় না। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, ওর Ovum এর সংখ্যা কমে গেছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আই ভি এফ করা দরকার। এখন সব চিকিৎসাই বন্ধ। কবে ফের শুরু হবে কেউ জানেনা। ও Google এ দেখেছে Eggএর সংখ্যা কমলে Hot Flashes হ য়। এখন গরম লাগলেই রিয়ার মনে হয় এই বুঝি ওর ডিম কমে গেলো।
ঘটনা- ৩
বাজার থেকে ব্যাগ বয়ে আনতে মালতীর হাত খুব ব্যথা করে, পারেও না ঠিকঠাক। তবুও কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চুপচাপ সব করে। তপন বাড়ি থাকায় এখন অবশ্য ঘরের কাজে কম-বেশি হাত লাগায়। তপনের একটা বড় গুণ হল ও মালতীর সব কথা শোনে। মালতী সবই বোঝে কিন্তু চুপ করে থাকে। যেদিন থেকে ডাক্তারবাবু বলেছেন, তপনের শুক্রাণু কম, সেদিন থেকে ও অন্য মানুষ. মালতী ওকে ঠিক চিনতে পারে না।তপন এখন শুক্রাণু বাড়ানোর ওষুধ খাচ্ছে। তপনের মনে একটাই ভয় বাসা বেঁধেছে- বাইরে বেরলে যদি করোনা হয় তাহলে ওর সব শুক্রাণু খারাপ হয়ে যাবে, ও আর বাবা হতে পারবে না। মালতী অনেক বোঝায়, টিভিতে খবর অবধি শুনতে দেয় না। এই ভয় আর মনখারাপ নিয়ে বাঁচা যায়! এর থেকে করোনা হওয়াই ভাল।
সরমা, রিয়া বা তপনের মতো অনেকেই এখন বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় কী করণীয় তা নিয়ে চিন্তিত। তবে এখনও করোনা ভাইরাস বা COVID 19 সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় নি। এও জানা যায়নি এই ভাইরাস এর ফার্টিলিটির ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা আছে কি না। অথবা সন্তানের ওপর কোনও প্রভাব পড়ে কিনা। যতক্ষণ না এ বিষয়ে পুরো তথ্য পাওয়া যায় ততক্ষণ এ নিয়ে কিছু স্পষ্ট ভাবে বলা সম্ভব নয়। কাজেই আগেভাবে এ নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না।
আমেরিকান সোসাইটি ফর রিপ্রোডাকটিভ মেডিসিন এর অভিমত হল, এই করোনার আবহে খুব জরুরি না হলে নতুন করে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলা যায় এই সময় বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার জন্য যে পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয় যেমন হিস্টেরোস্কোপি বা এইচএসজি অথবা ইন্ট্রাইউটেরাইন ইনসেমিনেশন বা আইভিএফ শুরু না করাই ভাল।
করোনা সংক্রমণ হলে কি সন্তান আসার সম্ভাবনা কমে যাবে?
ডিম্বাণু বা শুক্রাণুর ওপর করোনার কি প্রভাব পড়বে তা এখনি বলা মুশকিল, আপাতত আমরা যেটুকু জেনেছি তাতে মনে হয় না প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা কমবে।
ডিম্বাণু এবং ভ্রূণের নিরাপত্তার দিকেই প্রাধান্য দেওয়া দরকার
যেভাবে এই অসুখ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে সেক্ষেত্রে সাবধান হতেই হবে। কারণ যখন ডিম্বাণু সংরক্ষণ করা হবে সেখানে কোনও সংক্রমণ হতে পারে। কোনও মহিলার কোভিড১৯ পজিটিভ থাকলে তার থেকে প্রয়োজনীয় স্যাম্পল নিলে তার থেকে বিপত্তি দেখা দিতে পারে। যেহেতু করোনা অনেক সময় উপসর্গহীন হয় তাই সমস্যার আশংকাও বেশি। তাই এখন IVF বন্ধ রাখা হয়েছে।
শারীরিক, মানসিক ও আবেগগত সুস্থতার দিকে নজর দিতে হবে
একদিকে অতিমারীর কবলে পড়ার চিন্তা, অন্যদিকে সামাজিক দূরত্ব তৈরি করা তার সঙ্গে সন্তান না আসার চিন্তায় অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এর প্রভাব পড়ে শরীরেও। এতে করে সন্তান আসতে আরও সমস্যা হতে পারে। কাজেই নিজের দিকে খেয়াল রাখতেই হবে। স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে, শরীরচর্চা করতে হবে। বাড়িতে থাকলেও বন্ধু বান্ধব, সহকর্মী ও আত্মীয়পরিজন-দের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখতে হবে। যে কাজ করতে ভালো লাগে সেই কাজ করতে পারেন। সোশ্যাল মাধ্যম বা ফোনে যোগাযোগ রাখতে পারেন আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে। মনে রাখবেন এক – দু মাস চিকিৎসার দেরী হলে সন্তান আসার সম্ভাবনা ভীষণ ভাবে কমে যাবে না।
টেলিমেডিসিন বা টেলিহেলথের সাহায্য নিতে পারেন।
সম্ভব হলে ভিডিও কনফারেন্স বা ফোনে চিকিৎসকের সঙ্গে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা বিষয়ে কথা বলে নিতে পারেন। এতে নিজেও মানসিকভাবে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারেন।
এটা যেহেতু ইমার্জেন্সী চিকিৎসা নয় তাই শারীরিক, মানসিক, আর্থিক – সব দিক বিবেচনা করে সঠিক সময়ে চিকিৎসা করুন। জানবেন ভয় আর মনখারাপ আমাদের যুদ্ধে জেতাবে না, লড়তে হবে।