চরিত্র:
১) অতীন– আই টি প্রফেশনাল, বছর পঁয়ত্রিশের যুবক
২) সন্দীপ – আই টি ম্যানেজার, বছর চল্লিশ
৩) বিজন – ডাক্তার (রেডিওলজিষ্ট), বছর চল্লিশ
দৃশ্য ১
———
(টেলিফোনের শব্দ)
অতীন: হ্যালো, সন্দীপদা। গুড মর্নিং।
সন্দীপ: গুড মর্নিং। কেমন আছো?
অতীন: বিন্দাস। এই তো ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি।
সন্দীপ: মেনু কি?
অতীন : ফ্রেঞ্চ টোষ্ট, কুকিজ আর কফি।
সন্দীপ: ভালোই তো। চালিয়ে যা। একা মানুষ। চিন্তা কি আছে? আমার মত বাড়ির পাঁচটা লোকের বায়না সামলাতে হলে বুঝতিস!
অতীন: ভালো আর থাকছি কোথায়? সপ্তায় দুদিন অফিস যেতে হচ্ছে। খুব ভয়ে ভয়ে বেরোচ্ছি।
সন্দীপ: বেরোতে হচ্ছে কেন? আমার তো গোটা অফিস ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে। আর ওতো আমরা আগেও করতাম, শরীর খারাপ-টারাপ হলে।
অতীন: আরে একটা বড় মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট কোম্পানি আমাদের ক্লায়েন্ট। ওরা তো এখন এমার্জেন্সি কাজ করছে। তাই আমাদেরও যেতে হচ্ছে।
সন্দীপ: এই দুর্দিনের বাজারে এত বড় অর্ডার জুটিয়েছে রোকন ডিজিপ্লেক্স! তোর তো চাকরি বেঁচে গেল রে!
অতীন : নিজে বাঁচলে তবে তো চাকরি! আমার বসের কোভিড পজেটিভ বেরিয়েছে জানো?
সন্দীপ: তমোজিত?
অতীন: হ্যাঁ। অফিস ট্যুরে হংকং গেছিল মার্চে। ফিরে এসে কোয়ারান্টাইনে ছিল।
সন্দীপ: তারপর?
অতীন : সাতদিন বাদে জ্বর, গলাব্যাথা। টেষ্ট করতেই পজেটিভ। দশদিন হল আই ডি তে ভর্তি।
সন্দীপ: সে কি? অফিসের বাকিরা?
অতীন: চারজন আইসোলেশনে। বাকিরা চালাচ্ছি। তোমাদের কি খবর?
সন্দীপ: লকডাউনে ঘরে বসে বসে হাড়ে বাত ধরে গেল রে ভাই! লোকজন আওয়াজ দিচ্ছে- তোমাদের কাজও নেই, অফিস ট্যুরও নেই, তাই করোনাও নেই। প্রেষ্টিজ পাংচার হয়ে গেল মাইরি!
অতীন: ইয়ার্কি মেরো না। পরিস্থিতি খুব খারাপ। এই মহামারী কোন দিকে গড়াবে কে জানে!
সন্দীপ: অধিকাংশের চাকরি চলে যাবে, এটা সিওর।
অতীন: আচ্ছা তোমার সেই স্কুলের বন্ধু আছে না, ডাক্তার। তোমার ছেলের জন্মদিনের পার্টিতে আলাপ হয়েছিল। ভদ্রলোককে খুব নলেজেবল মনে হয়েছিল। তোমার সাথে ইদানিং যোগাযোগ নেই?
সন্দীপ: আছে তো! রোজ সকাল-বিকেল ওকে ফোন করি। ফার্স্ট হ্যান্ড ইনফরমেশন পাওয়া যায়।
অতীন: সেইজন্যই বলছিলাম, ওনাকে জিজ্ঞাসা কোরো তো ওনার কি মত। এই ঝামেলা কতদিন চলবে? টিভি চ্যানেলের এক্সপার্ট দের কথা আমার বিশ্বাস হয় না।
সন্দীপ: আরে বিজন তো রেডিওলজিষ্ট! ও এ ব্যাপারে এক্সপার্ট নয়। ও কি করে বলবে?
অতীন: আমাদের থেকে তো বেশী জানে! জিজ্ঞেস করেই দেখো না।
সন্দীপ: ঠিক আছে কথা বলে দেখি। ছেড়ে দিচ্ছি। সাবধানে থাকিস।
অতীন: সামাজিক দূরত্ব রজায় রাখবো, তাই তো? হা: হা: হা:
লকডাউন উঠে গেলে জোরদার একটা পার্টি দিতে হবে।
সন্দীপ: হবে হবে। আগে সব ঠিক হতে দে।
অতীন: আমার কাছে দুটো গ্লেনফিডিচ পড়ে আছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিলাম। ভাঙব ওই দিন।
সন্দীপ: গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল! ছাড়ছি।
দৃশ্য-২
——-
(বিজন সোফায় বসে আছে। কোলে ল্যাপটপ। পোষা কুকুর জিমির মাথায় হাত বোলাচ্ছে। জিমি হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ঘেউ ঘেউ করে করতে জানলার দিকে তেড়ে গেল। জানলার পাশে দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে।)
বিজন: (জিমির দিকে তাকিয়ে) খুব মজায় আছিস, তাই না। তোদের তো কিছু হবে না। যত বিপদ মানুষের।
( টেলিফোনের শব্দ)
বিজন: হ্যালো।
সন্দীপ: হ্যালো। কোথায় রে?
বিজন: বাড়িতেই আছি।
সন্দীপ: আজ হাসপাতালে যেতে হবে না?
বিজন: না, আজ যেতে হবে না। সাতদিন ডিউটি করেছি। এখন সাতদিন ছুটি। তোর কি খবর?
সন্দীপ: ছেলে অনলাইনে ক্লাস করছে। আমি বৌ-এর ফ্যাক্টরিতে লেবার খাটছি।
বিজন: কাজ শিখে রাখ। জীবনে কোনো কিছু ফেলা যায় না।
সন্দীপ: জ্ঞান দিস না তো! সামনের মাসে সাতশো ষ্টাফের মাইনে কি করে হবে, সেটা ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমাদের!
বিজন: শুরুতেই মাথা খারাপ করে ফেললে হবে, গুরু? এ জিনিস চলবে এখন অনেক দিন।
সন্দীপ: বলিস কি?
বিজন: ঠিকই বলছি। ভ্যাকসিন দূর অস্ত। এখনো ভালো কোনো ওষুধ নেই।
সন্দীপ: কেন, ক্লোরোকুইন?
বিজন: হাইড্রক্সিক্লোরোকুনমুন?
সন্দীপ: যা বলেছিস! ডাক্তাররা রয়েছে, এক্সপার্টরা রয়েছে। কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে উনি বলে দিলেন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেলে করোনা সেরে যাবে। আর সারা পৃথিবী দৌড়ল সেই ওষুধ কিনতে! ডিসগাষ্টিং।
বিজন: নার্সিসিষ্ট। আমিত্ববাদ। সারা পৃথিবীতেই বেশীরভাগ পলিটিশিয়ানরাই এখন এরকম।
সন্দীপ: যাকগে। আচ্ছা, তোর পাড়ায় কোন ডাক্তারের নাকি কোভিড পজেটিভ বেরিয়েছে? আমি তো প্রথমে শুনেছিলাম তোরই!
বিজন: হাঃ, হাঃ, হাঃ। গুজবের গরু গাছে চড়ে। আমার অবশ্য যে কোন সময় হতেই পারে। হাসপাতালে তো যেতে হচ্ছে! কোন্ পেশেন্ট ভাইরাস বয়ে বেড়াচ্ছে কে জানে!
সন্দীপ: তুই তো রেডিওলজিষ্ট, তোকেও পেশেন্টের কন্ট্যাক্টে আসতে হয়?
বিজন: কম, তবে কোনো কোনো কেসে পেশেন্ট কে টাচ করতে তো হয়ই। তখন স্পেশাল প্রোটেকশন নিই।
সন্দীপ: হয়েছে কোন ডাক্তারের?
বিজন: অর্থোপেডিক সার্জেন। নাম বলা বারণ। আমার থেকে পনেরো বছরের বড়। আমার দুটো বাড়ি পরে থাকে।
সন্দীপ: অর্থোপেডিক সার্জেনের কি করে হল। ওদের কি কোভিড পেশেন্ট দেখতে হয় নাকি?
বিজন : আরে বললাম না সব ডাক্তারেরই কোনো না কোনো সময় হতে পারে এটা।
সন্দীপ: তাই?
বিজন: তবে ওনার সমস্যাটা হচ্ছে ওনার বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। সঙ্গে ডায়াবেটিস। মেয়েও তো ডাক্তার। সে ভীষণ চিন্তিত।
সন্দীপ: খুব দুঃখজনক।
বিজন: দুঃখজনক, কিন্তু ওনার আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
সন্দীপ : একথা বলছিস কেন?
বিজন: ভদ্রলোক মানুষ ভালো। কিন্তু ভীষণ হেড ষ্ট্রং। গোদা বাংলায় তাকে বলে গোঁয়ার।
সন্দীপ: তাতে কি হয়েছে?
বিজন: উনি একটা ছোট নার্সিংহোম তৈরী করেছেন। এবার সেটার উদ্বোধন করলেন ১৫ই মার্চ। আমি অনেকবার বলেছিলাম এখন খুলবেন না। পিছিয়ে দিন। শুনল না।
সন্দীপ: কেন?
বিজন : বলল, সবাইকে বলা হয়ে গেছে। সবাই খুব আশা করে আছে। কিছু হবে না। উদ্বোধনের দিন কি ভীড়!
সন্দীপ: কি করে বুঝলি তে ওখান থেকেই হয়েছে?
বিজন: পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এসেছিল। দুদিন বাদে তো কাউন্সিলারের ধরা পড়ল। তখন থেকেই ডাক্তারবাবু কোয়ারান্টাইনে।
সন্দীপ: কি লাভ হল নার্সিংহোম খুলে? বন্ধই হয়ে গেল তো!
বিজন: শুধু তাই নয়, তখন যারা কবে খুলবেন কবে খুলবেন নার্সিংহোম- একথা বলছিল, এখন তারাই দল বেঁধে গালি দিচ্ছে।
সন্দীপ: তুই দেখতে গিয়েছিলি?
বিজন: চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোভিড ওয়ার্ডে ঢুকতে বারণ করল। শুধু শুধু একটা পি পি ই নষ্ট করাও উচিত নয়। সামাজিক দূরত্ব! জীবনটা বদলে গেল রে!
( বাইরে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন)
বিজন: রাখছি। দেখি আবার অ্যাম্বুলেন্স কেন!
(ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখে অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে গেল ডাঃ সরকারের বাড়ি থেকে। দূরে তাকিয়ে রইল বিজন।)