‘ফোন, চেম্বার বন্ধ করে বাড়িতে লুকিয়ে থাকা ডাক্তারদের বাধ্য করা হোক রুগী দেখা শুরু করতে নইলে তাঁদের লাইসেন্স বাতিল করা হোক’। ফেসবুকে কাপুরুষদের উদ্দেশ্যে এক মহাপুরুষের উক্তি। সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে যে যা খুশি লিখতেই পারে। কিন্তু যা অবাক করে তাহল ওই লেখার ১৭০০ শেয়ার, মানে এটা অনেকেরই মনের কথা।
কেউ লিখেছেন, ‘ডাক্তাররা মৃত্যুভয় থেকে ঘরে ঢুকে বসে আছেন, পাড়ায় একটাও ডাক্তার নেই। এর উত্তরে আর এক মহাপুরুষের উক্তি ‘পাড়ার ওই ডাক্তারগুলো শুধু টাকা রোজগার করতে রয়েছে। এগুলো হারামজাদা… ওঁদের আর চেম্বার করতে দেব না’।
এদিকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা লেখা ঘুরে বেড়াচ্ছে- এখন লোকের রোগ কমে গেছে যেহেতু ডাক্তারদের চেম্বার বন্ধ। তাঁরা জোর করে টাকার লোভে রুগীদের হাসপাতালে ভর্তি করে টাকা রোজগারের জন্য। তাই এখন তাঁরা বসছেন না, লোকে অনেক সুস্থ। এখন ভেবে দেখা উচিত, আমাদের ডাক্তারদের কাছে যাওয়া উচিত কিনা।
ইঁটের জবাব পাটকেলে দিতে গেলে শুধু হিংসাই বাড়বে। এই মহামারীর সময়ে কী আছে, কী নেই, কেন কী হল না, এসব বলে মারামারির কোনও দরকার নেই। তা পরেও করা যাবে। ডাক্তারদের পিঠ আর আপনার হাত তো থাকলোই। তবু জানিয়ে রাখি সরকারি, বড় বেসরকারি হাসপাতালের এমার্জেন্সি সার্ভিসে কিন্তু ডাক্তাররাই আপনাদের জন্য বসে আছেন।
আমরা ঠান্ডা মাথায় দেখি বেশিরভাগ ছোট ক্লিনিক বা প্রাইভেট চেম্বার বা পাড়ার ছোট নার্সিং হোম বন্ধ কেন?
লকডাউনের জন্য যানবাহন বন্ধ। লোকে যাতায়াত করতে পারছে না। ক্লিনিকের স্টাফরাও আসতে পারছেন না।
অনেকেরই চেম্বার বা ক্লিনিকে রুগীর বসার জায়গা অপ্রতুল। ৬ ফুটের সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মানা যাবে না। এর ফলে সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়বে।
ভাবুন তো, একজন ডাক্তারবাবুর চেম্বারে কত রুগী আসে? তাঁদের কোনও একজনের এই অসুখ নিঃশব্দে শরীরে থাকলেও তার থেকে কতজন সংক্রমিত হতে পারে?
নন এমার্জেন্সির অনেক সমস্যার ফোনেই সমাধান করছেন ডাক্তারবাবুরা। এর জন্য তাঁরা কোনও ফিজও নিচ্ছেন না।
রুগী দেখার সময় যে পারসোনাল প্রোটেকশন বা যেভাবে স্যানিটাইজেশন করা দরকার তা ছোট চেম্বারে নেওয়া সম্ভব নয়। আর চিকিৎসক যদি নিজে আক্রান্ত হন তাহলে তাঁর থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা অনেক বেশি।
নন এমার্জেন্সি মেডিক্যাল প্রবলেমের জন্য সরকার হেল্প লাইন চালু করুক।
আর তাও যদি প্রশ্ন করেন, ডাক্তাররা কি ভয় পেয়েছে? তাহলে তার উত্তরে বলি,
দেখুন, মৃত্যুভয় সকলেরই আছে, ডাক্তাররাও ব্যতিক্রম নন। আর এই ভয় নিয়েও তাঁরা কিন্তু এমার্জেন্সি সার্ভিস দিয়ে চলেছেন। ডাক্তাররা যদি শুধু নিজেরা আক্রান্ত হোত তাহলে এত ভয় পেত না। কিন্তু তাঁরা আক্রান্ত হলে এই রোগ পরিবারের লোকজন, বৃদ্ধ বাবা, মা, ছোট সন্তান, স্ত্রী-র মধ্যে ছড়িয়ে দেবেন… আর পরিবারকে কে না ভালোবাসে! এই ভয় সাধারণের মধ্যেও আছে বলেই তো স্বাস্থ্যকর্মী, নার্সদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করছেন। পাড়াছাড়া করছেন। তাছাড়া লক ডাউনের সময়ে বাড়িতে থাকাটা নিয়ম মানা, লুকিয়ে থাকা নয়।
এছাড়া চিকিৎসকের যদি কোভিড পজিটিভ হয় তখন আপনাদের মধ্যেই কেউ কেউ বলবে হারামজাদাগুলোর এত পয়সার লোভ দুদিন চেম্বার বন্ধ রাখতে পারল না! সারা পাড়ায় ইনফেকশন ছড়িয়ে মারল।
এই দুঃসময় অহেতুক ভেদাভেদ তৈরি না করে আমরা এক সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলি। ক্লিনিক বন্ধ থাকলে রুগী এবং স্বাস্থ্যকর্মী – দুজনেরই অসুবিধে, কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবেই অনেকে তা বন্ধ রেখেছেন। এই সময়ে এমন কিছু হয় তো না বলাই ভালো যা স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেয়, না হলে ঘণ্টা, থালা বাটি বাজানো টা সহমর্মিতার প্রকাশ বলে মনে হবে না, মনে হবে শুধুই হুজুগ।