পেটের ভেতরে এক পর্দা আছে যার নাম পেরিটোনিয়াম। পেরিটোনিয়ামের দুটো স্তর—একটা স্তর পেটের ভেতরের দেওয়ালে লেগে থাকে, অন্য স্তরটা পেটের ভেতরকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে ঢেকে রাখে। পেরিটোনিয়াম থেকে এক তরল বেরোয় যার কাজ পেরিটোনিয়ামকে পিচ্ছিল রাখা যাতে এক অঙ্গ অন্য অঙ্গের ওপর দিয়ে সহজেই পিছলে যেতে পারে। পেরিটোনিয়ামের এই দুই স্তরের মধ্যে যখন বেশি তরল জমে, সেই অবস্থাই হলো অ্যাসাইটিস।
মাঝারি গড়নের কোনও রোগির অ্যাসাইটিস ডাক্তারি পরীক্ষায় বুঝতে গেলে অন্তত ১৫০০ মিলিলিটার তরল জমা চাই। রোগা, ছোটো গড়নের কারুর অবশ্য একটু কম জমলেও বোঝা যায়। আবার মোটা কোনও রোগির ১৫০০ মিলিলিটারের চেয়েও অনেকটা বেশি তরল না জমলে ডাক্তার পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন না। আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষায় অবশ্য মোটামুটি ৫০০ মিলিলিটার তরল জমলেই বোঝা যায়।
অ্যাসাইটিসে যদি জীবাণু-সংক্রমণ হয়ে না থাকে এবং হেপাটো-রেনাল সিন্ড্রোম যদি না থেকে থাকে তাহলে অ্যাসাইটিসকে তিনটে ধাপ (grade)-এ ভাগ করা হয়ঃ—
১) অল্প অ্যাসাইটিসঃ ধরা পড়ে কেবল আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষায়।
২) মাঝারি অ্যাসাইটিসঃ এতে পেটে দুইদিকে সমান ভাবে কিছুটা ফুলে থাকে।
৩) বেশি অ্যাসাইটিসঃ পেট খুব ফুলে থাকে।
চিকিৎসায় ফল পাওয়া যায় না (Refractory) এমন অ্যাসাইটিস আবার দুরকমেরঃ
১) অন্তত এক সপ্তাহ খাদ্যে সোডিয়াম অর্থাৎ লবণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং বেশি মাত্রায় ডাইয়ুরেটিক বা মূত্রবর্ধক দিয়েও যদি অ্যাসাইটিস না কমে, তাকে বলে ডাইয়ুরেটিক-প্রতিরোধী অ্যাসাইটিস (diuretic-resistant ascites)।
২) আবার মূত্রবর্ধক ব্যবহার-জনিত জটিলতার জন্য যদি কার্যকরী মাত্রায় মূত্রবর্ধক দিয়ে চিকিৎসা না করা যায় তাহলে তাকে বলে ডাইয়ুরেটিক-ইনট্র্যাক্টেবল অ্যাসাইটিস (diuretic-intractable ascites)।
অ্যাসাইটিসের কারণ
১। সিরোসিসঃ লিভারের সিরোসিসের রোগীরা সবচেয়ে বেশি যে লক্ষণ নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসেন তাহল অ্যাসাইটিস। অ্যাসাইটিস রোগীদের মোটামুটি ৭৫%-এর সিরোসিস থাকে। আবার সিরোসিস রোগীদের প্রায় ৫০%-এর বছর দশেকের মধ্যে অ্যাসাইটিস দেখা দেয়। লিভারের সিরোসিসে অন্তিমস্তরে পায়ে জলা জমা, ফুসফুসের আবরণীতে জমা জমা (প্লুরাল এফিউশন)ও দেখা যায়। সিরোসিসের রোগী অনেকদিন ধরে ভালো ছিলেন, হঠাৎ করে তাঁর অ্যাসাইটিস দেখা দিল, এমনটা হলে তাঁর লিভারের কোষের ক্যানসার (hepatocellular carcinoma) হয়েছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
২। অ্যাসাইটিস-এর ১৫% রোগীর ক্যানসার পেটে জল জমার কারণ। ক্যানসার হতে পারে পরিপাকতন্ত্রের, যেমন—পাকস্থলী, বৃহদন্ত্র, অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার, লিভার কোষের ক্যানসার বা অন্য অঙ্গের ক্যানসার যা লিভারে বাসা বেঁধেছে। এছাড়া মহিলাদের ডিম্বাশয়ের ক্যানসার, লসিকাগ্রন্থির ক্যানসার, অন্যত্র থেকে পেটের গহ্বরে বাসা বাঁধা ক্যানসারও অ্যাসাইটিসের কারণ হতে পারে।
৩। হৃদযন্ত্রের বিকলতা বা হার্ট ফেলিওর
৪। নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম
৫। যক্ষ্মা
৬। প্যাঙ্ক্রিয়াটাইটিস বা অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ
৭। অন্যান্য দুর্লভ কারণগুলির মধ্যে আছে হাইপোথাইরয়েডিজম।
রোগী কি সমস্যা নিয়ে আসেন?
- পেট ফোলা
- জল জমার ফলে ওজন বাড়া
- পেটে জল যতো বেশি জমে ততো অস্বস্তি বাড়ে। ক্যানসারের কারণে অ্যাসাইটিস হলে ব্যথা থাকতে পারে।
- গা-বমি ভাব ও ক্ষিদে কমে যাওয়া—পাকস্থলী ও অন্ত্রের ওপর অ্যাসাইটিসের চাপের কারণে।
- শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকাঃ এমনটা হয় দুটি কারণে—পা থেকে শিরায় রক্ত-চলাচল কমে যায় নিম্ন মহাশিরায় অ্যাসাইটিসের চাপ পড়ায়, এবং মধ্যচ্ছদায় অ্যাসাইটিসের চাপের কারণে ফুসফুস ঠিকমতো ফুলতে পারে না।
- যে রোগের কারণে অ্যাসাইটিস হয়েছে, তার উপসর্গ থাকতে পারে।
- রোগীর যে ঝুঁকিগুলির কথা জানতে হয়, সেগুলি হলঃ মদ্যপান, আগে জন্ডিস হয়েছে কিনা, দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি বা সি সংক্রমণ, স্থূলতা, রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, টাইপ ২ ডায়াবেটিস।
রোগ-লক্ষণ অর্থাৎ রোগীকে পরীক্ষা করে কি পাওয়া যায়?
- শোয়া অবস্থায় পেটের দুপাশ ফোলা লাগে, দাঁড়ানো অবস্থায় তলপেট ফোলা লাগে।
- পেটের ভেতরকার চাপ বেড়ে যাওয়ার জন্য নাভিতে বা কুঁচকিতে হার্নিয়া হতে পারে।
- সিরোসিসের জন্য জন্ডিস, মাংসপেশির ওয়েস্টিং, পুরুষের স্তন-বৃদ্ধি, স্পাইডার নেভি, হাতের তালুতে লালভাব (palmar erythema)।
- পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয় বা লিভারের ক্যানসারের কারণে পেরিটোনিয়াল পর্দায় ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে থাকলে অনেক সময় নাভিতে একটা শক্ত গুটি দেখা যায়। পেটের উপরিভাগে ক্যানসার হয়ে থাকলে অনেক সময় বাম দিকের কন্ঠার হাড়ের উপরে গ্ল্যান্ড ফোলে।
- ডাক্তার কিভাবে পেট ঠুকে বোঝেন পেটে জল জমেছে কিনা তার আলোচনা এই প্রবন্ধের আওতার বাইরে। তবে আগেই বলেছি অন্তত ১৫০০ মিলিলিটার জল না জমলে ডাক্তারী পরীক্ষায় অ্যাসাইটিস বোঝা যায় না, তখন আল্ট্রাসোনোগ্রাফিই ভরসা।
অ্যাসাইটিস বাড়ছে কিনা বোঝার জন্যঃ
- পেটের মাপ নেওয়া হতে থাকে
- ওজন নেওয়া হতে থাকে।
অ্যাসাইটিসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্দেশ্য হলঃ
- অ্যাসাইটিস আছে কিনা নিশ্চিত হওয়া
- অ্যাসাইটিসের কারণ খোঁজা
- অ্যাসাইটিসের কারণে কোন জটিলতা হচ্ছে কিনা দেখা।
যে পরীক্ষা করা হয় সেগুলি এইরকম—
রক্তপরীক্ষা
- রক্তকোষগুলির সংখ্যা মাপা (full blood count)
- কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে কিনা দেখার জন্য পরীক্ষা—রক্তরসে ইউরিয়া, ক্রিয়াটিনিন, ইত্যাদি মাপা
- লিভারের কার্যক্ষমতা মাপা (liver function tests)
- রক্ত-জমাট বাঁধার পরীক্ষা (clotting screen)
- থাইরয়েডের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা (thyroid function tests)
- সিরোসিসের কারণে অ্যাসাইটিস হয়েছে নিশ্চিত হওয়া গেলে সিরোসিসের কারণ খুঁজতে হেপাটাইটিস বি ও সি-র অ্যান্টিবডি পরীক্ষা।
ছবি তোলা
- আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে অ্যাসাইটিস বোঝা যায় তো বটেই তাছাড়া অ্যাসাইটিসের কারণ ডিম্বাশয়ের ক্যানসার বা অন্য জায়গা থেকে লিভারে বাসা-বাঁধা ক্যানসারের মতো কিছু হলে তাও জানা যায়।
- বুকের এক্স-রে-তে প্লুরাল এফিউশন, ফুসফুসে অন্য জায়গা থেকে এসে ক্যানসারের বাসা-বাঁধা, হার্ট ফেলিওর ইত্যাদি বোঝা যায়।
- আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে অ্যাসাইটিসের কারণ বোঝা না গেলে অনেক সময় এম আর আই করা হয়।
অ্যাসাইটিসের তরল পরীক্ষা
সূঁচ দিয়ে পেট ফুটো করে সিরিঞ্জ দিয়ে তরল টেনে পরীক্ষা করলে অনেক সময় অ্যাসাইটিসের কারণ বোঝা যায়।
অ্যাসাইটিসের চিকিৎসা
- অ্যাসাইটিসের কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে তার চিকিৎসা করতে হয়।
- দিনে ৫.২ গ্রামের বেশি নুন না খেলে সিরোসিসের কারণে অ্যাসাইটিস হলে ফল পাওয়া যায়।
- ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয় স্পাইরোনোল্যাক্টোন, ফ্রুসেমাইডের মতো মূত্রবর্ধকগুলিকে।
- পেটে অ্যাসাইটিসের তরলে চাপ খুব বেড়ে শ্বাসকষ্ট হলে সূঁচ ফুটিয়ে তরল বার করে দেওয়াও চিকিৎসার অঙ্গ।
- কখনও কখনও অপারেশন করে অ্যাসাইটিসের তরল রক্ত-প্রবাহে নিয়ে যাওয়ার রাস্তা বা শান্ট করা হয়।
অ্যাসাইটিসের জটিলতা
- মূত্রবর্ধক দিয়ে অ্যাসাইটিসের চিকিৎসা চলাকালীন রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা কমে যেতে পারে।
- আপনা থেকে পেরিটোনিয়াল গহ্বরের ব্যাক্টেরয়া-ঘটিত প্রদাহ হতে পারে অনেকের।
অ্যাসাইটিস রোগীর ভবিষ্যত
- যে সব সিরোসিস রোগীর অ্যাসাইটিস হয়, তাঁদের মধ্যে প্রায় ১৫% এক বছরের মধ্যে মারা যান, পাঁচ বছর বেঁচে থাকেন ৪৪%।
- ক্যানসারের কারণে অ্যাসাইটিস হওয়ার মানে রোগ বেশ ছড়িয়েছে, এঁদের ভবিষ্যৎ ভালো নয়।
ভালো লেখা।