কাল মাঝরাতে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল।ইমার্জেন্সি পেসেন্ট দেখে ফিরতে ফিরতে রাত গড়িয়ে যায় অনেকটাই।বরাবর দেখেছি ফিরে আসার সময় আমার মেজাজ টা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়।ফাঁকা রাস্তায় একটু জোরেই চালিয়ে দি গাড়ির মিউজিক সিস্টেম টা। ট্রাফিক সিগনাল আর ইতস্তত কিছু মাঝরাতে জেগে থাকা দোকানের আলো ছাড়া আর কিছুই সাক্ষী থাকে না আমার এই যাতায়াতের।
এই কোভিড টাইমসে যেন আরোই বেড়ে গিয়েছে রাতের রাস্তার এই নির্জনতা। যদিও লক ডাউনের তুলনায় লোক বেড়েছে বেশ কিছুটা ,তবু্ও তা স্বাভাবিকের তুলনায় এখনো কম।
প্রায়শই রাত্রে এই আপৎকালীন পরিষেবা শেষ করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যায় আমার।
আর এই পুরো সময়টাতে এই গভীর রাত্তিরে
না ঘুমিয়ে জেগে থাকেন আমার স্ত্রী। বরাবর দেখেছি আমি মাঝরাতে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লে একই সঙ্গে ঘুম উড়ে যায় সহধর্মিনীরও। আমি বাড়ি পৌঁছালে তবেই উনি ঘুমোতে যাবেন। লক্ষ্য করছি এই মহামারীর সময় ওর কাজের পরিধি যেন আরও বেড়ে গিয়েছে। আমি রাতে বাড়িতে ফিরলে আমাকে সম্পূর্ণরূপে স্যানিটাইজ করানো ওর বাড়তি কাজের মধ্যে পড়ে গিয়েছে এখন।
মাঝরাতে বাথরুমে গায়ে হাতে পায়ে সাবান মাখতে মাখতে ভাবি করোনা কি ভাবে আমাদের চিকিৎসকদের স্বাভাবিক জীবনটাকেও বদলে দিল! ইমারজেন্সি তো সারা জীবন ছিল আর থাকবেও, কিন্তু রোজকেরে এই স্যানিটাইজেশন আর যখন তখন স্নান করার চাপ! উফ,কবে যে এর থেকে মুক্তি ঘটবে সকলের!
একজন ডাক্তারের জীবনের সাথে সবসময়ই জড়িয়ে যায় তাদের পরিবারের ওঠাবসা। আমাদের ছোটবেলার যাবতীয় চলন গমন যেমন বাবার চিকিৎসক পেশার সাথেই ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। আমার পরিবারের জীবনটাও ঠিক তেমনই জুড়ে গিয়েছে আমার সাথে। স্নান করে উঠতেই অনুরোধ মতো গিন্নি এক কাপ কফি আর এক টুকরো কেক টেবিলে রেখে ঘুমাতে চলে গেলেন। আমি ফিরলেই উনার নাকি ঘুমে দু চোখ ভেঙে পড়ে! আর কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না আমার।
কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে ফেসবুক দেখি অথবা ঢুকে পড়ি ইন্টারনেটের যাবতীয় খবরের জগতে। আর এই মহামারীর সময় দেশের এবং রাজ্যের করোনার খবর রাখা তো অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
দেখতে দেখতে আমাদের শহরের এই আজকের করোনা গ্রাফটির দিকে নজর আটকে গেল আমার। এটা বিগত কয়েক মাসের কলকাতার অ্যাক্টিভ করোনা রোগীর সংখ্যার কথা বলছে। লেখচিত্রের চেহারাটি অনেকটা কচ্ছপের খোলসের মত। ধীরে ধীরে বেড়ে আবার কমে বেসলাইনে এসেছিল সে রেখা। তারপরে হঠাৎ বেড়ে চলেছে আবার।
গ্রাফটি বলছে সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে কলকাতা শহরে করোনাকে অনেকটাই বাগে আনা গিয়েছিল। কিন্তু সেই মাসের শেষ দিক থেকে শুরু করে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সংক্রামিত রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। যেখানে সারাদেশে করোনার সংখ্যা নিম্নমুখী। তাই খোলস থেকে বেরিয়ে মাথা তুলছে এবার কচ্ছপ নয় বিষধর সাপ, কোভিড। এই মাসের গ্রাফে সেই ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট।
কারণটা খুঁজতে গিয়ে আচমকাই মহালয়ার ছবিটা মনে পড়ে গেল আমার। কাতারে কাতারে লোক নদীবক্ষে এসে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করছেন। গায়ে গা লেগে রয়েছে সবার। কারোর মুখে মাস্ক বালাই নেই। সোশ্যাল ডিসটেন্সিংকে গঙ্গার জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পূর্বজদের উদ্ধারে ব্যস্ত সবাই।
রাস্তাঘাটে মাস্ক পড়া মানুষ এখন সংখ্যায় নগণ্য।শপিং মল আর বাজারে থিকথিকে ভীড়, উপচে পড়ছে মদের দোকান। সবারই ধারণা আমার কিছু হবে না। বিশেষত যারা বয়সে তরুণ। অনেকে রাখঢাক না রেখে প্রকাশও করে ফেলছেন সে কথা। দু একজন তো আমাকেও বলে দিলেন মুখের উপরে।
আমাদের দেশের পরিসংখ্যানে এটা পরিষ্কার যে কোভিডে মরণহার ২ শতাংশ আর আই সি ইউ-তে ভর্তির সংখ্যা শতকরা ৫ ভাগ। কিন্তু মনে রাখতে হবে আমাদের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি।
এবার চট করে হিসেব করে ফেলুন ক্যালকুলেটর টিপে। ঠিকই ধরেছেন শিউরে ওঠার মতো সংখ্যা। শ্মশানে কিংবা কবরস্থানে জায়গা দেওয়া যাবে না অনেককে।
তবে এটাও ঠিক সব মানুষের সংক্রমণ হবে না, বা হলেও তার শারীরিক প্রকাশ ঘটবে না। কিন্ত তারা রোগ বাহক বা ক্যারিয়ার হয়ে যেতেই পারেন।নিজে অসুস্থ না হয়ে ছড়িয়ে দিতে পারেন রোগ। আমার নিজের দীর্ঘ দিনের পেসেন্ট এক বৃদ্ধ দম্পতি, আশি এবং নব্বইয়ের কোঠায় যাদের বয়স ঠিক এই ভাবেই সংক্রামিত হয়ে এখনো আই সি ইউ-তে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। অপেক্ষাকৃত বয়সে ছোট কেউ রোগ বয়ে নিয়ে এসেছে বাড়িতে। নিজে অসুস্থ না হয়ে একেবারেই ঘরবন্দী বয়স্ক মানুষ দুটিকে করে দিয়েছে সংক্রামিত।
হিসেবে দেখাচ্ছে কলকাতার কেসের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বিগত দিনকয়েক ধরে।দৈনিক ৪০০ কেসের জায়গায় শেষ দুই সপ্তাহে কেসের সংখ্যা প্রায় ৬০০-র আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে।
হিসেবেই পরিষ্কার ডাক্তার, প্রশাসন সবার বলা কওয়ার তোয়াক্কা করছে না জনগণ। তার ফল কিন্তু সবার আগে ভোগ করতে হবে তাদের বাড়িতে থাকা বয়স্ক মানুষদের। আপনি বয়সে তরুণ, স্বাস্থ্যবান মানুষ। আপনি করোনাকে পাত্তা না’ই দিতে পারেন, অগ্রাহ্য করতে পারেন যাবতীয় বাধা নিষেধ। কিন্তু মনে রাখতে হবে করোনা আপনার মাধ্যমে ঠিক খুঁজে নেবে আপনার বাড়ির বয়স্ক প্রিয়জনকে।
সামান্য জ্বর থেকে যা প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ মানুষদের ক্ষেত্রে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ফুসফুসের মধ্যে কোভিড নিউমোনিয়া হয়ে। আই সি ইউ, ভেন্টিলেটর দিয়েও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
হাই ফ্লো অক্সিজেন দিলেও ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুস নিতে পারছে না সেই জীবনদায়ী গ্যাস।
ডাঙায় মাছ তোলার মতো অবস্থা হচ্ছে মানুষের।
ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীরা চেষ্টা করছেন মানুষকে বাঁচানোর। কিন্তু কেসের সংখ্যা বাড়লে বেড এবং ডাক্তার দুই ই হয়ে উঠবে অপ্রতুল। তখন আর চিকিৎসাও করা যাবে না। আর যে ভাবে প্রাণহানি হচ্ছে চিকিৎসক আর নার্সদের, বেশিদিন এই মহামারী র দৌরাত্ম্য চললে লোক পাওয়া যাবে না চিকিৎসা করার।
তাই জনগণকেই ঠিক করতে হবে সামনের দিনে তারা কি করতে চলেছেন। দুর্গাপুজো, ঈদ আর ক্রিসমাসে বাঁধনছাড়া উল্লাসে মত্ত হয়ে নিজের পরিবারের বয়স্ক এবং তুলনায় অসুস্থ মানুষদের ডেথ সার্টিফিকেট নিজেরাই লিখবেন নাকি একটু বিধিনিষেধ মেনে সংযত হয়ে কাটাবেন মহামারীর বাকি দিনগুলো!!
দিনের শেষে সিদ্ধান্ত কিন্তু আপনাদের।
পরিশেষে বলে রাখি বিগত প্রায় দুই সপ্তাহ ডাক্তারদের লড়াইয়ের পরে এখন ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছেন আমার ৯২ এবং ৮৬ বছরের দুই করোনা রোগী। হাসপাতাল থেকে ছুটি মিলেছে আমার কোভিড আক্রান্ত শ্বশুরমশাইয়ের। শ্বাশুড়ি মা ছুটির অপেক্ষায়।
সাবধানে থাকুন। বিধিনিষেধ মেনে চলুন সবাই।
বাড়ির বয়স্কদের কথা ভেবে পদক্ষেপ নিন।
দারুন লেখা।