আমার পরিচিতরা জানেন বোধহয় আমি সম্প্রতি অতি দুর্গতিময় চাকরজীবন শেষ করেছি। বানান ভুল ভাববেন না প্লিজ। চাকরি কথাটার মধ্যেই মস্ত এক চাকর লুকিয়ে আছে। হিন্দিতে নৌকরির মধ্যে যেমন নৌকর। বাঙালি মালিক হলে সাইটের নাম নিশ্চিতই হত চাকর ডট কম।
সেই চাকর ডট কমের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমি আজকাল খুব পড়াশুনোয় মন দিয়েছি। বই পত্তর না। ফেসবুকে পড়ি হরেক বিষয়, হোয়াটসঅ্যাপে পড়ি, গোগ্রাসে গিলি কত না ব্লগ-ব্লগানি। চটজলদি গুগল, উইকির ক্লাস করি। মোটমাট আমি আজকাল কাউকে বিরক্ত না করে কাছের মানুষের উপদেশ মেনে, ঘরের কাজ করি, বাগান করি, সর্বোপরি পড়াশুনো করি।
এই পড়তে গিয়েই, আজ প্রেসক্রিপশন নিয়ে ঐন্দ্রিলএর এক চমৎকার লেখা পড়লাম। সেই লেখায় ডাক্তারদের হাতের লেখা নেহাতই পার্শ্বচরিত্র হিসেবে হাজির। এককথায় বলতে গেলে অসাধারণ রচনাটিতে ডাক্তারদের হাতের লেখা কোনও গুরুত্বই পায়নি। গুরুত্ব পাবার কথাও নয়। একে তো তার নিজের হাতের লেখা বেশ সুন্দর। সুন্দর শুধু নয়, পাঠযোগ্যও বটে। তায় এই ছেলে হয় তো সমব্যবসায়ীদের ভয় পায়। সিনিয়রদের তো বটেই জুনিয়রদেরও। কিন্তু আমি এখন অকুতোভয়। অন্তত এই ব্যাপারে।
ডাক্তারদের বেশ কিছু হাতের লেখা আমি দেখেছি যা অত্যন্ত অর্নামেন্টাল, কিন্তু আধুনিক পোস্ট মডার্ন কবিতা বা ছবির মত, অর্থভেদ করা দুষ্কর। অবশ্য বেশ কয়েকবছর ধরে প্রাতিষ্ঠানিক ডাক্তারেরা তো বটেই, ব্যক্তিগত ক্লিনিকেও অনেক ডাক্তার কম্পিউটারে টাইপ করা প্রেসকৃপশন দিচ্ছেন। এতে ওই হাতের লেখার ঝামেলাটা মেটে।
করোনাযুগে তো বেশ কিছু ডাক্তার ব্যাপারস্যাপার আরও সরল করে ফেলেছে আইনি প্রশ্রয়ে। টেলিমেডিসিন নামের গ্যাঁড়াকলের আড়ালে দেড়হাজার টাকার হাত বদল থুড়ি নেটে অ্যাকাউন্ট বদল হয়ে যাচ্ছে পাঁচ মিনিটের ডিজিটাল দেখাশোনায়। ডিজিটাল অক্ষরের প্রেসক্রিপশন নেমে আসছে ডেটার সরণী বেয়ে। হার্টের রোগী, চেস্টের রোগী, জ্বরের রোগী…সব রকম। এই ডাক্তারেরা খেলাধুলোর লাইনে থাকলে শিয়োর অ্যাদ্দিনে টেলিক্রিকেট, টেলিফুটবল আবিষ্কার করে ফেলত। ব্যাটে বলে হবে না, সেঞ্চুরি হয়ে যাবে অথচ।
শুধু ঐন্দ্রিলের মত কিছু অচতুরেরা মানে বোকারামেরা এখনও সাক্ষাতে রোগী দেখে কাগজে কলমে প্রেসক্রিপশনে গল্প লিখে চলেছে। আহা হোক না চাপের জন্য অণুগল্প, গল্প তো বটে। চাপ কমলে আবার পূর্ণদৈর্ঘ্যের হবে এখন।
যে কথা হচ্ছিল, ডাক্তারদের হাতের লেখার কথা। প্রখ্যাত এক অর্থোপেডিকসের ডাক্তার, অপারেশনে ভারি সুনাম। তাঁর হাতের লেখা, এতই সুমধুর ভাবে জঘন্য যে, আমার পাঠানো এক রোগী কিছুতেই সেখানে দেখানোর পর তাঁর কাছে অপারেশন করাতে রাজি হল না। ফের অন্য কারওর কাছে পাঠানোর জন্য কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান,
ও ডাক্তারবাবু, অন্য ভালো কারওর কাছে পাঠান না!
এক ধমক দিয়ে চোখ পাকিয়ে বললাম, খুব পাকা হয়েছ। কী হলটা কী? সমস্যা কী তোমার?
রোগী হাতজোড় করে বলল, স্যার, বিদ্যেসাগরের আবিষ্কার করা অক্ষরের যে দশা উনি করেছেন, শরিলের ভেতরে স্বয়ং ভগবানের সাজানো অক্ষর ওনার হাতে পড়লে পুরো ভজকট হয়ে যাবে। কাজ করে খেতে হয় স্যার। গরিব মানুষ।
যদিও বিদ্যাসাগর মশাই ইংরেজি কেন এমনকি বাংলা বর্ণমালাও ওই যাকে বলে ‘আবিষ্কার’ করেননি, যুক্তির সারবত্তা কিন্তু অস্বীকার করতে পারিনি।
কিন্তু আজকেই কি ডাক্তারদের হাতের লেখার এই হাল হল? আজ্ঞে না, বহুকাল আগে থেকেই। কেন? কারণ হিসেবে বহুজন বহুরকম ব্যাখ্য দেন।
কেউ বলেন, যে সমস্ত ডাক্তারদের কাছে অনেক রোগীর ভিড় টাইমপ্রেশারে পড়ে তাদের হাতের লেখা ওই রকম। অন্যতর ব্যাখ্যাগুলোও আকর্ষণীয়।
ওষুধের দোকানের সঙ্গে নাকি সাঁট থাকে ডাক্তারের। তাই ওইরকম সাঙ্কেতিক হাতের লেখা। যাতে পার্টিকুলার ফার্মেসি ছাড়া অন্য কেউ কোড ডিসাইফার করে সার্ভ না করতে পারে।
কেউ বলে, এই হাতের লেখা রোগীদের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষার উদ্যোগ, উকিলেরা যেমন অকারণে কালো প্রজাপতি সেজে ওড়াউড়ি করে এজলাসে এজলাসে।
আবার নিয়তিবাদী কেউ মনে করে, খুব অভিজ্ঞ ডাক্তার রোগীর সব ভূত ভবিষ্যৎ প্রেসক্রিপশনে লিখে রাখেন। এমনকি অদূরভবিষ্যতে মৃত্যু দেখতে পেলে সেই নিদানও। তবে এমন হাতের লেখায় তারা সেই সব লেখেন, যাতে যমদূত অবধি পড়তে না পেরে মিসগাইডেড হয়ে তাদের কার্গোভ্যান নিয়ে ফিরে যায়। ডাক্তারের সুনাম বাড়ে।
সে যাই হোক, আমরা জানি এই সবই ডাক্তারদের হেয় করার জন্য কষ্ট কল্পনা।
তবে ফার্মাসিস্ট যে নিয্যস বুঝতে পারে ডাক্তারের লেখা তা সবসময় কিন্তু নয়। একটা বহুশ্রুত গল্প শ্রদ্ধেয় তারাপদ রায়ের লেখা থেকে টুকে বলি।
সে অনেক আগের কথা। তখন এমবি বা এলএমএফ ডাক্তারেরা, নিজস্ব টাট্টুঘোড়ায় চেপে দশ বিশখানা গ্রামে ঘুরে প্রবল প্রতাপে প্র্যাকটিস করেন। সে আমলে ডাক্তারের সঙ্গে সেই দশ বিশ গ্রামের লোকেদের যোগাযোগ প্রায় পারিবারিক ছিল। রোগে তো বটেই রোগ বহির্ভূত ব্যাপারেও চিরন্তন অভিভাবক ডাক্তারের কাছে এসে পড়ত লোকজন। সেই রকম এক ডাক্তারের কাছে এসে এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা মাথাটাথা চুলকে তাঁর সমস্যাটি জ্ঞাপন করল। ডাক্তারবাবু, আপনার তো অনেক চেনাজানা। আমার ছোটোমেয়ে মোক্ষদার জন্য একটা পাত্তর আপনাকে দেখে দিতেই হবে।
ডাক্তার একটু ভেবে বললেন, শোনো, গ্যাড়াপোতার ভবতারিণী মেডিসিন হল তো চেন। ওর মালিক কেষ্টর ছেলে তারক। সরকারি চাকরি করে। তার জন্য কনে খুঁজছে। তোমরা তো বারুজীবী। তা’হলে তোমাদের পাল্টি ঘরই হল। না কি?
বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে প্যাডে খসখস করে কিছু লিখে, যত্নে চার ভাঁজ করে কন্যার পিতার হাতে দিলেন। বলেও দিলেন, কী হল জানিয়ে যেয়ো বাপু।
মেয়ের বাপ পরদিন সকালে হাজির চারক্রোশ দূরের সেই গ্রামে। দোকানের কাউন্টারে তখন স্বয়ং মালিক। দুরুদুরু বক্ষে তাঁর হাতে চিঠি দেওয়া হল।
মালিক গম্ভীর মুখে ভাঁজ খুলে পড়ে ততোধিক গম্ভীর মুখে বললেন, বিকেলে আসুন। হয়ে যাবে।
আনন্দে টইটম্বুর কন্যার পিতা বিকেলে আবার গেলেন। ডাক্তারবাবুর এক চিঠিতে মেয়ের বিয়ে পাকা হয়ে গেছে। এই না হলে দাপুটে ডাক্তার। যম তো বটেই ওষুধের দোকানের মালিক অবধি মেনে চলে। দোকানের কাউন্টারে তাঁর এবার আর কাঁচুমাচু মুখ না। বেশ একটা সমানে সমানে ভাব। সকালে তো বলেই দিয়েছেন, হয়ে যাবে।
ডিসপেন্সারির সেই মালিক কাউন্টারেই রয়েছেন। চিনতে পেরে ভেতরে গিয়ে এক শিশি ওষুধ এনে ঠক করে কাউন্টারের টেবিলে রেখে গম্ভীর ভাবেই বললেন, এই নিন। দাম তিন টাকা দশ আনা।
ঠিক এই রকমের ঘটনা না হলেও কাছাকাছি কিছু ঘটনা হাউসস্টাফশিপের সময়ও ঘটতে দেখেছি। আমার মাসতুতো ভাই ডিপ জন্ডিস নিয়ে ভর্তি। বমি হচ্ছে খুব। ডিরেকশনে রয়েছে বমির ওষুধ এমিডক্সিন বড়ি দিতে হবে। ঘটনার জন্য হাতের লেখা দায়ী না কি নবীনা সিস্টারের অনভিজ্ঞতা দায়ী জানি না। গিয়ে শুনি, দেওয়া হয়েছে এনডক্সান নামে ক্যান্সারের ওষুধ। ভুল ধরা পড়ার পর রোগীকে রাইলস টিউব পড়িয়ে বমি করানোর কী চেষ্টা।
পরে কর্মজীবনে Evionএর বদলে Evon আর এমনি আরও কত মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝি ঘটতে দেখেছি ডাক্তারের লেখা আর ফার্মাসিস্টএর দেওয়া ওষুধের মধ্যে।
মানুন আর নাই মানুন, ইদানিং বিনাশকালে আমাদের বুদ্ধিনাশ হয়েছে সন্দেহ নেই। এই তো সেদিন এক ফেসবুকিয়ান, আইটি সেলের বিশাল ভক্ত চায়ের দোকানে ঝড় তুলছিলেন, হাতে এক খণ্ড কাগজ নেড়ে, শালা কামাল ডাক্তার আরবিতে প্রেসকৃপশন লিখেছে।
ভদ্রলোক নতুন। নইলে পাশের পাড়ার নির্বিরোধী ডাক্তার কমল চৌধুরীকে কামাল চৌধুরী ভেবে নিয়ে আরবি বলে দাগিয়ে দিতেন না। ডাঃ কমল চৌধুরীর হাতের লেখা অবশ্য চিরকালই একটু ইয়ে। ইংরেজি, বাংলা আরবি পুস্তু যা কিছু বলেই চালানো যায়।
হোস্টেলে আমার এক সিনিয়র রুমমেট, অসাধারণ সাহিত্যজ্ঞান ছিল তাঁর। আর সেই রকমেরই সাহিত্যের পড়াশুনো। দেশি বিদেশি সব রকমেরই। সেই দাদার ছেলেবেলার খুব সখ ছিল অ্যাকাডেমিক লেখাপড়াটা সাহিত্যের লাইনে করবেন। তো হায়ার সেকেন্ডারি পড়াকালীন প্রেমের কবিতার পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলেন প্রকাশকের কাছে। কয়েকমাস পর প্রকাশকের ডাক পেয়ে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে গেছিলেন তাঁর কাছে। প্রাজ্ঞ বহুদর্শী প্রকাশক গল্প করে সব কথা জেনে নিয়েছিলেন। মায় সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়ার সখও। একথা সেকথার পর পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়েছিলেন। সঙ্গে ফ্রি উপদেশও, শোনো বাপু, যা হাতের লেখা তোমার তুমি বরং ডাক্তারি পোড়ো।
দীর্ঘশ্বাস আচ্ছন্ন পাঠককে মনে করাই, সেই পঞ্চাশ বছর আগে কিবোর্ড কম্পিউটার কিছুই ছিল না।
দাদার আশাহত মুখ দেখে, পাশ থেকে কম্পোজিটর ভদ্রলোক গলা বাড়িয়ে বলেছিলেন,
আর হ্যাঁ, সখ যদি তারপরও থাকে তবে ডিকটেশন নেবার জন্য লোক রেখো। আমার মত ছাপোষা লোককে জ্বালিয়ে মেরো না। অমুকবাবু যেমন স্কুটারের ড্রাইভার রেখেছে, তুমিও কবিতার জন্য স্টেনো রেখো।
তা, আমার সিনিয়র সেই দাদা ড্রাইভার থুড়ি স্টেনো রেখেছিলেন বই কি! হোস্টেল জীবনে আমায় রেখেছিলেন, ডিকটেশন শুনে লেখার জন্য। আজ্ঞে না, কবিতা নয়। ললিতাদিকে লেখা দাদার চিঠি।
ওঃ বলা হয় নি। সদ্য এসএফআইএ ঢোকা আমাকে তখন হাতের লেখার ট্রেইনিং দেওয়া হয়েছিল পোস্টার লেখার জন্য।
চিঠি লিখে আবার পৌঁছে দিয়ে আসতে হত মেয়েদের হোস্টেলে। স্টেনো কাম মেসেঞ্জার, টু ইন ওয়ান। হাতের লেখার প্রসঙ্গে মনে পড়ল।
ওঃ আর এক দুঃখের কথাও মনে পড়ল। লেখার প্রথমেই গর্ব করে বলেছিলাম না, আমার চাকরগিরি শেষ হয়েছে। আজ্ঞে না, শেষ হয়নি।
এই যে লেখাটা পড়ছেন, সেটা অন্য কারওর লেখা। তিনিও ডাক্তার। হাতের লেখাটি ডাক্তারসুলভ বলাই বাহুল্য। কাজেই তাঁর বাংলায় এই লেখাটি হাতের লেখা কাগজ থেকে(থুড়ি হোয়াটসঅ্যাপের ছবি থেকে) কি-বোর্ডে টাইপ করে দিতে হল আমাকে, স্রেফ ওই যাকে বলে ভালোবাসার খাতিরে। এটিও দাস্য বই কি!
খুব ভাল লাগল।