আজ প্রায় পনের বছরের ওপরে হয়ে গেল ডাক্তারি করছি। ওই তিন ইঞ্চির বস্তুটি নিয়ে মানুষের মনে যে কি আছে আমি আজও তা বুঝে উঠতে পারলাম না। এত সংকোচ, জড়তা, ভয়, অনুশোচনা, বিকার যে মানুষের ওইটুকু যন্ত্রাংশ নিয়ে থাকতে পারে তা সত্যিই কল্পনার অতীত।
বললাম বটে কিন্তু সত্যিই কি কল্পনা করা যায় না? আমি তো উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছি। ক্লাস টুয়েলভ পাশ করেও আমি জানতাম না বাচ্চা কিভাবে হয়। চরম লজ্জাজনক ব্যাপার! কিন্তু সত্যিই আমি জানতাম না। কুনোব্যাঙ আর গিনিপগের জননতন্ত্র পড়ে নিজের জননাঙ্গ উত্তেজিতও হত না, আঠারো বছর অব্দি জানতেও পারি নি “এলেম আমি কোথা থেকে?”
র্যাগিং পিরিয়ডে আমার দুরবস্থা দেখে এক দার্শনিক মনোভাবাপন্ন সহানুভূতিশীল সিনিয়র (পরে জেনেছিলাম সে এক ব্যর্থ প্রেমিক) আকাশে উপবৃত্তাকার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘সত্যি, সেক্স ব্যাপারটা বাঙালিদের কাছে ট্যাবুই রয়ে গেল’।
‘মাস্টারবেশান’ শব্দটা আমি প্রথম শুনি ডাক্তারি পড়তে এসে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন ‘প্রথম শুনি’- বুঝি ও প্রয়োগ করি আরও এক বছর পরে। প্রয়োগ যেদিন প্রথম করেছিলাম সেদিন আমার সামনে স্বর্গের জানালা খুলে গেছিল- সে অন্য কথা। এখন থাক। তবে আজ বুঝতে পারি আমার মত সায়েন্স নিয়ে পড়া ছেলের যদি এই দশা হয় তবে তথাকথিত ‘অশিক্ষিত’ সমাজে ‘যৌনতা’ ও ‘মাস্টারবেশান’ নিয়ে কতটা ট্যাবু থাকতে পারে।
ফাইনাল ইয়ারে সাইকিয়াট্রি ওয়ার্ডে এক হপ্তা রোটেশন চলছে। সাইকিয়াট্রির হেড প্রফেসর সুজিত দাস আমাদের টিউনিং করছেন। আমাদের গ্রুপে চারজন। দুজন ছেলে, দুজন মেয়ে। অন্য ছেলেটি তার স্থায়ী প্রেমিকার সাথে আছে, সঙ্গে প্রেমিকার প্রিয়তমা সখী। আমি সেই বাজারে একা। ময়ূরের দলে কাকের মত।
স্যার প্রশ্ন করলেন, ‘ডু ইউ নো হোয়াট ইজ মাস্টারবেশান?’ কপাল খারাপ। প্রথমেই আমার দিকে তাকালেন। আমি তৎক্ষণাৎ মাথা দুদিকে নাড়ালাম। পরে আমার বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলেন। সে জানাল, জানে। বান্ধবীরাও একই কথা বলল। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এভরি অ্যাডাল্ট পারসন নোজ হাউ টু মাস্টারবেট। দোজ হু টেল ডোন্ট আর পসিবলি লায়ার’।
আমার কান লাল হয়ে গেছে। তিন ইঞ্চিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নিজেকে নপুংসক বলে মনে হচ্ছে। সত্যিই তো জানি। কেন বললাম না? তাও দুজন বান্ধবীর সামনে? ছি, ছি! এই হল ট্যাবু। আমার ক্ষেত্রেই যদি এমন হয় তবে অন্যদের ক্ষেত্রেও যে হতে পারে তাতে আশ্চর্য হবার কি আছে?
এ তো গেল অবোধ বয়সের কথা। সুবোধ বয়সের কথা আরও মারাত্মক। অন্য ডাক্তারদের মতই আমারও বিয়ের ফুল ফুটতে অনেক দেরি হয়েছিল। আমার উনি ফুলশয্যার রাতে আমার নাচন-কোঁদন দেখে হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারছেন না। ‘ডাক্তার’ স্বামীর এ হেন দুর্দশা দেখে তিনি নিজেই পারলে শিখিয়ে দেন আর কি!
পরের দিন সকালে বৌদির ফোন-
– কি গো হলো?
– আর হলো! আর বোলো না!
– সে কি গো ওরও এই অবস্থা? এই বাড়ির সব ছেলেদের কি একই রোগ?
ননভেজ হানিমুন সেরে ফিরে এলাম। কিছুই হল না। ফাঁড়া কাটতে ঝাড়া এক মাস লাগল। আমার মত ‘মেডিকেল গ্রাজুয়েট’-রই যদি এই দশা হয় তবে অন্যদের অবস্থা ভেবে দেখুন। বিয়ের ছয়মাস পরে তাই কেউ আমার কাছে দেখাতে এসে আজেবাজে বকবক করার পর যখন নববধূ তার স্বামীকে কনুই দিয়ে খোঁচায় তখন আমি একটুও অবাক হই না।
বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, ‘যৌনতাকে কখনই সহজাত প্রক্রিয়া বলা চলে না। সত্যিই যদি তা সহজাত ক্রিয়া হত তবে কিছুতেই সংখ্যায় এমন অনেক বিবাহিত দম্পতিদের পাওয়া খুঁজে পাওয়া যেত না যাদের বিয়ের এক বছর পরেও কোনো ইন্টারকোর্স হয় নি’। একদম হক্ কথা। ভিক্টোরিয়ান ট্যাবুই বলুন বা ভারতীয় সংস্কার- যৌনতা কখনই আমাদের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
ইউরোলজিতে পিজি হাসপাতালে হাউসস্টাফশিপ করি। সুপার স্পেশালিটি ডিপার্টমেন্ট। আমার মত আনাড়ি ছোকরার ব্লাড টানা আর রাউন্ডে নোট দেওয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই। আউটডোরে তাই আমার কাজই ছিল তিন ইঞ্চির উত্থান-পতন সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান করা। আমার দায়িত্ব ছিল ভিড়ে ঠাসা আউটডোরে বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি বহু পেশেন্ট যারা এসেই কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে চায় তাদের কাউন্সেলিং করা। কাউন্সেলিং করে সবাইকেই প্রায় অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট লিখে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া।
আমাদের ডাক্তারি শাস্ত্রে বলে লিঙ্গ শিথিলতা বা ইরেক্টাইল ডিসফাংসানের প্রধান কারণটাই মানসিক। সেটা বোঝার জন্য আমরা রুগিদের খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন করিঃ সকালে ঘুম থেকে উঠলে আপনার লিঙ্গ কি শক্ত থাকে? যদি থাকে তবে বুঝতে হবে সমস্যাটা মানসিক।
তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। মেডিসিন ওয়ার্ড চলছে। প্রফেসর আর. এন. সরকার বেডসাইড ক্লিনিক করাচ্ছেন। স্যার খুব ভাল ক্লিনিশিয়ান। পড়াতেনও খুব ভাল। এখন তো কলকাতার নামজাদা রিউম্যাটোলজিস্ট। খুব ঠোঁটকাঁটা লোক ছিলেন। পরীক্ষা নিচ্ছেন। এক ছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বল অ্যাসাইটিস কি’? সে উত্তর দিতে দিতে অকারণে দুপাশে অতিরিক্ত দুলতে শুরু করল। স্যার বললেন, ‘ঠিকই আছে। তবে অতটা না দোলালেও চলত’।
স্যারই আমাদের বেডসাইড ক্লিনিকে প্রথম ‘স্ট্যাম্প টেস্ট’-এর কথা বলেন। যাদের তিন ইঞ্চি দাঁড় করানোয় সমস্যা তারা রাতে শোবার সময় কয়েকটা পোস্টাল স্ট্যাম্প শিথিল তিন ইঞ্চির ওপর পরপর লাগিয়ে রাখবে। সকালে উঠে সে যদি দেখে যে স্ট্যাম্প আর লেগে নেই তবে বুঝতে হবে তার যন্ত্র ঠিকই আছে। সেই জ্ঞান আমি পিজিতে সারা হাউসস্টাফশিপে কাজে লাগিয়েছি। আজও লাগাই। আজ যদিও অনেক ভালো পরীক্ষা প্রচলিত আছে তবু হাতের পাঁচ হিসেবে ‘স্ট্যাম্প টেস্টের’ জুড়ি নেই।
(চলবে)
দারুন দারুন