জীবকেশ উঠে দাঁড়ালেন। সাদা ফিনফিনে ধুতি এবং সাদা চাদরটা ঠিকঠাক করে পেয়ারা কাঠের খড়ম দুটো পায়ে গলিয়ে নিলেন তিনি। তারপর হাতের কব্জি বন্ধনীর ছোট্ট হলুদ বোতামটা টিপে দিতেই আকাশে ফরফর আওয়াজ উঠলো। আওয়াজটা বাড়তে বাড়তে বেদান্ত আয়ুর্বেদালয়ের উঠোনে উড়ন্ত রথটা নেমে এল। পুস্পক রথ।
এটা ২১২১ সাল। বিমান ও মহাকাশ বিজ্ঞানীরা তিরিশ বছর আগেই পুরাণে বর্ণিত পুষ্পক রথ পুনরাবিষ্কার করেছেন। তারপর থেকে এটাই এখন ব্যক্তিগত পরিবহণের মাধ্যম। এতে সুবিধা হয়েছে এই,একবিংশ শতকের প্রবল ট্রাফিক জ্যাম এখন অতীত। পুস্পক রথ হাওয়ায় চলে। অন্য কোনো জ্বালানীর প্রয়োজন হয় না। কার্বন নিঃসরণ শূন্য।
কি একটা মনে হতে আবার আয়ুর্বেদালয়ের মূলগৃহে প্রবেশ করলেন জীবকেশ। শল্য চিকিৎসা করার পরে ব্যাক্টেরিয়া মারার লেজার বন্দুকটা ফেলে এসেছিলেন তিনি। এই লেজার বন্দুক এবং অজ্ঞান করার ‘কঙ্কাশন’ যন্ত্র ছাড়া আয়ুর্বেদিক শল্যচিকিৎসা সম্ভবই নয়। প্রাচীন কালে একটা সময়ে আয়ুর্বেদিক শল্যচিকিৎসার বিস্তার ঘটলেও তখন ব্যক্টেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবী ছত্রাক ইত্যাদি আণুবীক্ষনীক কীটাণুর পরিচয় জানা ছিল না। তাই শল্যচিকিৎসার পরবর্তী সময়ে প্রদাহে অসংখ্য রোগীর মৃত্যু হত। তাই কালক্রমে সেই শল্যের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।
মানুষ ধীরে ধীরে ভুলে যায় সেসব কথা। তারপর শ’পাঁচেক বছর আগে ইউরোপীয় এক ধরণের শল্যচিকিৎসার প্রচলন হয়। তাতে শিরায় ইঞ্জেকশন দিয়ে রাসায়নিক ওষুধ প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হত। ছুরি-কাঁচি-চিমটা এবং অন্যান্য অনেক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অস্ত্রোপচার করা হত। সে সবও এখন অতীত। একশ’ বছর আগে একটি ডিক্রি জারি করে ইউরোপীয় চিকিৎসা পদ্ধতি বাতিল করে সকল রোগের চিকিৎসায় প্রাচীন আয়ুর্বেদিক পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। তাতে দেশের জনসংখ্যা কালক্রমে প্রায় চল্লিশ শতাংশ কমে গেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই। কত সুবিধা!
সদ্য অস্ত্রোপচার করা রোগীকে মাটিতে শুইয়ে রাখা আছে। ডান পায়ে অস্ত্রোপচারের স্থানে হলুদ পুলটিস বাঁধা। রোগীর ডান পায়ের উরুর হাড় ভেঙ্গে যাওয়াতে, অস্ত্রোপচার করে হাড়ের মধ্যে তিন্তিড়ী কাষ্ঠের শলাকা প্রবেশ করানো হয়েছে। এককালে শল্যচিকিৎসকরা ধাতুর শলাকা প্রবেশ করাতেন। ডিক্রি জারি করে মানুষের শরীরে সমস্ত কৃত্রিম বস্তুর ব্যবহার বন্ধ করা হয়। তারপর থেকে হাতির দাঁতের তৈরী শলাকা ব্যবহার করা হত। কিন্তু এখন তাও পাওয়া যায় না। কারণ, পৃথিবী থেকে হাতি লুপ্ত হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে।
পুষ্পক রথ মাঝ আকাশে। জীবকেশ তাঁর কানের ভেতরে বসানো ইলেকট্রনিক বার্তা বাহকে একটি বার্তা পেলেন। ‘সদ্য অস্ত্রোপচার করা রোগীটি মৃত।’ এরকম প্রায়ই ঘটে থাকে। কারণ, অস্ত্রোপচার পরবর্তী আপৎকালীন গৃহগুলি (সার্জিক্যাল ইনটেনশিভ কেয়ার ইউনিট) ডিক্রি জারি করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রাচীন আয়ুর্বেদ পদ্ধতির সাথে তা খাপ খায় না।
জীবকেশ নির্মোহ হাতে তাঁর পুষ্পক রথ পরবর্তী আয়ুর্বেদালয়ের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন।