তখন ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। পড়াশোনার বালাই নেই। টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মোবাইল ফোন নামক বস্তুটির আবির্ভাব তখনও ঢের দেরি। আমাদের জাগতিক অস্তিত্ব তখনও অদৃশ্য জালে বাঁধা পড়ে নি। গল্পের বইয়ের পোকা ছিলাম। গোগ্রাসে গিলতাম। আর বিকেল হলেই গ্রামের ধান-কাটা মাঠে ব্যাট-বল। প্লাস্টিকের বল, আঁকাবাঁকা কাঠের তক্তার ব্যাট। ছ-আট ওভারের খেলা। সে এক অদ্ভুত নেশা! শয়নে-স্বপনে তখন ওই এক জিনিস- প্লাস্টিকের বল পেটানোর ঠকাস! অবচেতনে তখন নিজেরাই সচিন-সৌরভ-দ্রাবিড়-কুম্বলে।
এরকমই একদিন সকালে মামাবাড়ির নেমতন্ন খেয়ে বিকেল গড়াতেই দুমদাম সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খেলা শুরু হয়ে যাবে যে! নাভিশ্বাস ফেলে সাইকেলে প্যাডেল করছি। উঁচুনিচু মোরাম রাস্তায় সাইকেল ঠোক্কর খেয়ে লাফাচ্ছে- খড়ড় খড়াৎ! বেলের নাটবল্টুটা ঢিলে। অনবরত টুং টুং করে বাজছে! কোনোরকমে সাইকেলটা ঠেকিয়ে রেখেই একদৌড়ে খেলার মাঠ। ততক্ষণে সবাই এসে গেছে। খেলার এক ওভার হয়েও গেছে। তার মানে পুরো এক ম্যাচ সাইডলাইনে বসে বসে তেঁতুলগাছের পাতা গোনা ছাড়া উপায় নেই। অনেক ঝোলাঝুলির পর ক্ষমাঘেন্না করে খেলতে নিল। ওই ম্যাচেই। দু’জন রান আউট হওয়ার পরে আমি মাঠে নামার সুযোগ পেলাম। নন-স্ট্রাইকার এন্ডে। ব্যাট হাতে বাবুল। ইচ্ছে করেই নামটা বদলে দিলাম। কেন জানিনা সত্যিকারের নামগুলো লিখতে আমার অস্বস্তি হয়। বাবুল খুব ভালো খেলতো। প্রথম বলটাই সপাটে আমার মুখের দিকে। সরে আসার সুযোগ পাওয়ার আগেই ঝমঝমিয়ে উঠলো গোটা শরীর! চোখে অন্ধকার.. থরথরিয়ে কাঁপছি! দু’হাতে রক্ত! উপরের চোয়ালের সামনের দিকের তিনটে দাঁত ভেঙে মাটিতে! নিচের ঠোঁট দিয়ে রক্তের বন্যা! কোনোরকমে মুখ চেপে বাড়ি ফিরে ভয়ে ভয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। ফোকলা মাড়িতে জিভ বোলাতে বোলাতে দরদরিয়ে ঘামছি। বাবাকে বাঘের মতো ভয় পেতাম। যদি বাবা জানতে পারে খেলতে গিয়ে এই অবস্থা তাহলে পিঠে ক’খানা ছড়ি ভাঙবে তার ইয়ত্তা নেই। অগত্যা মিথ্যে বললাম। বাড়ির সামনের চানপাথরে আছাড় খেয়েছি। আমার রক্তাক্ত চেহারা দেখে বাবা হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো। কী হবে এবার? কোথায়, কীভাবে চিকিৎসা হবে?
পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত করি। গ্রামের হাতুড়ে, সদরের দাঁতের ডাক্তার হয়ে কোলকাতা। ধারদেনা করে কিছু নগদ টাকাপয়সা জোগাড় করতে হ’ল। কাকভোরে উঠে চোখ ডলতে ডলতে বাস, লোকাল ট্রেন তারপর আবার বাসে চেপে ধর্মতলা। তখন শীত পড়তে শুরু করেছে। কিছুদিন ছাড়া ছাড়া ডাক্তার দেখানোর ডেট পড়তো। পরনে একটিই লাল-হলুদ ডোরাকাটা সোয়েটার আর স্কুলে বহুদিন আগে কেনা নীল ফুলপ্যান্ট। ওই একটাই ফুলপ্যান্ট। সেটাও লম্বায় কুলোচ্ছে না। তখন তরতরিয়ে বাড়ছি। গোড়ালি অব্দি নামাতে গিয়ে প্যান্টের কোমর প্রায় বিপদসীমা ছুঁয়ে যায়। প্রতিবার অসহ্য যন্ত্রণা.. ছুঁচ, ইঞ্জেকশন, মাড়ির ভেতর ধাতব রড। চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে তবু চিৎকার করি না। ডাক্তার অবাক হয়ে বলেছিলেন- “এই বয়েসের ছেলে এতসবের পরেও চিৎকার করে না- প্রথম দেখলাম।”
সব সহ্য মুখ বুজে করতে পারতাম। শুধু একটা বিষয় ছাড়া। ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে আসার সময় মা গোছা গোছা খুচরো নোট তুলে দিতো রিসেপশনে। এতগুলো টাকা! রক্তজল করা পয়সা.. বুকটা হু হু করে উঠতো। ফেরার সময় বাসে জানলার ধারে সিট পেয়ে কাঁদতাম। মামা চেনানোর চেষ্টা করতো.. ওই দ্যাখ আকাশবাণী! ওই দ্যাখ ইডেন গার্ডেন্স! আমার ঝাপসা চোখে ফুটে উঠতো মায়ের হাত.. তাতে ধরা টাকার গোছা.. দিনের শেষে ফিরে এলে বাবা জড়িয়ে ধরে বলতো- “দেখি.. দেখি.. আজ কতটা কী হ’ল..” ছেলে চিকিৎসা পাচ্ছে দেখে বাবা আনন্দে হাসতো। আমি জানতাম সে হাসির পেছনে কতটা ঘাম, কতটা যুদ্ধ।
তারপর একসময় পুরো কাজ শেষ হ’ল। আমার মিথ্যে বলাটা বাবা পরে জানতেও পেরেছিল কিন্তু কেন জানিনা পিঠে ছড়ি ভাঙা তো দূর সেরকম কিছু বকাঝকাও করে নি। যদিও দাঁতের কাজ ভালো হয়নি একেবারেই। পরে সেসব বদলে আবার কেঁচেগণ্ডূষ করতে হয়েছিল। এ গল্পের আরও একটা বাঁক আছে। বাবুল মাধ্যমিকের পর পড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে লেগে যায়। ছানা তৈরির কাজ। পড়াশোনার চাপ আর হাজারো ব্যস্ততা মিলিয়ে বাবুলের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে যায়। বছর পাঁচ-ছয়েক আগে হঠাৎ একদিন দুঃসংবাদটা পাই। বাইক অ্যাক্সিডেন্টে বাবুল মারা গেছে!
*****
ডাক্তারি পড়তে এসে অনেকদিন আগের সেসব কথার ওপর মরচে পড়তে শুরু করেছিল। তারপর একদিন.. তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ার। জায়গাটা মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের রি-ইউনিয়ন নাকি চেঙ্গাইলের শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঠিক মনে নেই। শুনেছিলাম কলেজের এক সিনিয়র দাদা ডা. পুণ্যব্রত গুণ ও অন্যান্য অনেকে মিলে কম খরচে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তখন সেসব খায় না মাথায় দেয় জানিনা। দেখলাম এক দাড়িওয়ালা, ভারিক্কি চেহারার লোক আমাদের সাথে পরিচয় করলেন। শুনলাম ইনিই নাকি পুণ্যদা! বয়েসে প্রায় আমার বাবার কাছাকাছি একটা লোক ‘দাদা’! পরে জেনেছিলাম এখানে সবই দাদা-ভাই-দিদি-বোনের ব্যাপার। পুণ্যদা নিজের ডাক্তার-জীবন আর স্বাস্থ্য-আন্দোলনের কথা বলতে শুরু করলো। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে শুনছি.. পুণ্যদা বলছে-
– ডাক্তারি মানে শুধু রোগ সারানো নয়। বোঝার চেষ্টা করো.. এই লোকগুলো তাদের একদিনের রোজগার ফেলে, ট্রেনে-বাসে টাকা খরচ করে এসে, সারাদিন না খেয়ে তোমার কাছে এসেছে। খসখসিয়ে প্রেসক্রিপশন লেখার সময় যদি এইগুলো মাথায় না থাকে তাহলে তুমি শালা ডাক্তারই নও!!
কেঁপে উঠেছিলাম। আমার চোখের সামনে আবার ভেসে উঠেছিল আমার মায়ের হাত। তাতে ধরা একগোছা টাকা। আমার নীল ফুলপ্যান্ট। বাঁশের দরজা ঠেলে নিচু হয়ে ঢোকা। আমার আদর্শ চিকিৎসককে খুঁজে পেয়েছিলাম সেদিন..
আজও যখন হাসপাতালে ঢুকি দেখতে পাই কত লোক কত দূরদূরান্ত থেকে এসে হাসপাতাল চত্ত্বরে মাদুর কিংবা খবরের কাগজের ওপর রাত কাটাচ্ছে। দুপুরে সস্তার হোটেলের সব্জিভাত। প্রিয়জন হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। বাইরের লড়াইটাও কম নয়। তবু তারা হারতে চায় না। ঝড়ে ঘর ভেঙে যায়.. সব্জির ক্ষেত হাতিতে মাড়িয়ে যায়.. নদী এসে গিলে খায় তিনফসলী জমি.. তবু তারা লড়ে। পড়ে। তবু লড়ে। লড়ে যায়..
আমার অবস্থা সচ্ছল হয়েছে। তবু মায়ের হাত আর তাতে ধরা একগোছা টাকা আমার সামনে ফুটে ওঠে বারবার। ওতে আমার বেড়ে ওঠার গল্প আছে, আমাদের ঘামের গন্ধ আছে। এরকম আরও অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে আনাচেকানাচে। চোখ খোলা রাখলেই তাদের দেখা যায়। অনেক নিশ্চিন্দিপুরে আজও অনেক অপুর বাস। ঘামে ভেজা পাঞ্জাবী কখন যেন ক্যনভাস হয়ে যায়.. ফুটে ওঠে প্রিয় নায়কের সংলাপ..
“..কিন্তু সেইটিই শেষ কথা নয়। সেটি ট্র্যাজেডিও নয়। সে মহৎ কিছু করছে না, তার দারিদ্র্য যাচ্ছে না, তার অভাব মিটছে না.. কিন্তু তা সত্ত্বেও সে জীবন বিমুখ হচ্ছে না। সে পালাচ্ছে না। এসকেপ করছে না। সে বাঁচতে চাইছে। সে বলছে বাঁচার মধ্যেই সার্থকতা। তার মধ্যেই আনন্দ। হি ওয়ান্টস টু লিভ..”
মারীর দেশ শুনিয়ে যাচ্ছে বাঁচার মন্ত্র..
হি ওয়ান্টস টু লিভ..
হি ওয়ান্টস টু লিভ..