যেহেতু গল্পের আকারেই বলতে হবে, তাই একটি সত্যি ঘটনাকে গল্পের মতোই বলি।
এ গল্পের নায়িকা আছে। তার নাম মায়ারানী। না, এ মায়ারানী কারো কল্পনার জগতে বাস করার মতো রূপালী পর্দার নায়িকা নয়। বড্ড বাস্তব, রক্ত মাংসের নায়িকা সে। তাকে জানার মতো সময় আমাদের হয় না, হবেও না কোনদিন।
মায়ারানী নাকি ইদানিং ডাইনি হয়েছে! মানে তার আচার আচরণ দেখে নাকি সবাই একশো শতাংশ নিশ্চিত, কোন এক অতৃপ্ত আত্মা তার উপর ভর করেছে! শুধু মায়ারানীর প্রতি সেই আত্মার কি যে মায়ার টান, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না! একবার বুঝতে পারলেই, ওঝা নাকি ঝেঁটিয়ে সে আত্মাকে তৃপ্ত করে দেবেন!!
এ ভাষ্য যারা দিয়েছে, তাঁদের মধ্যেই একজন সহৃদয় প্রতিবেশী তাঁর সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য একবার ‘ডাইকতার’ দেখাতে নিয়ে এসেছেন!
অপয়া সে ‘ডাইকতার’ হলুম আমি! অথচ সে
মায়ারানী সব প্রশ্নে নির্বিকার। মুখে বিড়বিড় করছে বটে, আমি তার ঠোঁট নড়া থেকে কিছুই উদ্ধার করতে পারছি না। সে তার নাম ধাম বয়স শরীরের সমস্যা কিছুই বলতে পারছে না। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছে আর উপরের দিকে তাকিয়ে থাকছে।
আমার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। অজ পাড়াগাঁয়ের মায়ারানী, আমার প্রতি কোন মায়া দেখালো না!
বসনের কাপড় ঠিক করতে ভুলে যাচ্ছে যে, সে কিসের জবাব দেবে?
আমি প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছি। একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে রেফার করে নিজের অক্ষমতা লিখে দেব বলে ভেবেছি।
তখন মাথায় এলো, মায়ারানীর অতীত যদি জানা যেত! ঘর সংসারের কথা যদি জানা যেত!
সহৃদয় ব্যক্তি জানালেন – মাস ছয়েক আগে সোয়ামি মারা গেছে। আর কিছু তেমন জানেন না।
আত্মীয় স্বজন যারা প্রথম দিকে আসছিল, ডাইনি হবার পর তাদের আর কোন মায়া অবশিষ্ট নেই মায়ারানীর উপর!! স্বাভাবিক! আমরা তো এমনই!
– সন্তান?
– আছে। দেখে না।
এই যে সন্তান ‘দেখে না’, এও আমাদের সমাজের নৈমত্তিক ঘটনা। অবাক হলাম না!
আমি আড়চোখে দেখছি মায়ারানীকে। যার কেউ নেই, সেই মহিলার এমন হওয়া কি খুব অস্বাভাবিক?
বললাম – এই যে মায়ারানী, তোমার সব কিছু আমাকে বলো। কে জানে তোমার কথা?
মায়ারানী প্রথম বার মুখ খুললো। তারপর সে ‘ডাইনি’ মায়া রানী, গলায় এক অসম্ভব কাঠিন্য নিয়ে, একদম সুস্থ সবল মানুষের মত যে বাক্যটি বললো- সেটি দিয়েই গল্প শেষ করবো।
কারণ, তারপর আর গল্পটি টেনে লম্বা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। এই লাইনটি লেখার পর হাত থেকে ইউএসজি প্রোব পড়ে যাওয়ার মতই, ফের আমার অক্ষম কলম হাত থেকে খসে পড়বে।বুকের ভেতর জেগে উঠবে এক তীব্র হাহাকার। শূন্যতা। জেগে উঠবে এমন এক বোধ, যার ব্যাখ্যা দিতে পারবো না আমি। আমি ব্যাখ্যা খুঁজবো দু’টো শব্দের। হয়তো বহুদিন ধরে খুঁজে চলবো এই দু’টো শব্দের মানে। বোঝার চেষ্টা করবো, একজন মানুষ, যে একজন আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে পৃথিবীতে কাটিয়ে ফেলেছে পঁয়ত্রিশটা বছর, সে অন্য একজন মানুষের কাছে কিভাবে বিলিয়ে দিতে পারে তার সমগ্র?
কিভাবে সে নির্দ্বিধায় বলতে পারে, আমার সব শুধু সেই অন্যজনই জানে!!!
মানলাম, আমার এই মায়া রানী , এই দেশের অজপাড়াগাঁয়ে র এক অখ্যাত নায়িকা । যাঁর জীবন হয়তো সোয়ামির ঘর আর কালেভদ্রে বাপের ঘর !
যাঁর বেশভূষা আমাদের চোখে নোংরা !
তবু
আমরা কেউ কোনদিন বলতে পারবো কি বছর পঁয়ত্রিশ এর মায়া রানীর মতো ?
ওই যে গলায় অসম্ভব কাঠিন্য এনে (ডাইনির মতো লাগলো কি?) , তাঁর ভেতরে তীব্র হারানোর যন্ত্রনা, আর বহুযুগের জমিয়ে রাখা মায়া মেখে মায়া রানী মৃত প্রেমিক স্বামী কে উদ্দেশ্য করে বলে গেল –
“কেউ জানে না কিচ্ছুটি গো , সব জানে মোর ঘরের মানুষ!”