দক্ষিণের এই বারান্দাটা অনিমেষের খুব প্রিয়।সামনে দিয়ে এন এইচ সিক্স সরীসৃপের মতো চলে গেছে। ওপরে অনন্ত আকাশ, আবার বাঁদিকে তাকালেই হাসপাতালের এমার্জেন্সীটা চোখে পড়ে।
দোতলার এই বারান্দা অনিমেষের কতো ওঠা-পড়ার সাক্ষী। স্ত্রী মালবিকার সাথে নানা মনোমালিন্যের সমাধানেও যেমন এই বারান্দা আবার লোডশেডিং এর সন্ধ্যেয় ছেলে মেয়ের সাথে সপরিবারে আড্ডাতেও এই প্রশস্ত খোলা জায়গাটাই আশ্রয়।
আজ অবশ্য একাই বসে আছে ডা:অনিমেষ চ্যাটার্জী। দীর্ঘ বত্রিশ বছরের চাকরী জীবনের আজকেই সমাপ্তি। সকালবেলাই রিলিজ অর্ডার নিয়ে শেষবারের মতো এই বারান্দায় বসে।কাল সকালেই মফস্বলের এই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাবে। কত স্মৃতি কত কথা ভিড় করে আসে।
“ডাক্তারদা”—-অনিমেষ তাকিয়ে দেখে ইসমাইল সেই পরিচিত ভঙ্গিতে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই অনিমেষের স্মৃতির কোষগুলো পেছন দিকে ছুটে চলল——
সবেমাত্র সেদিন সকালে চা-এর টেবিলে বসেছে অনিমেষ। সকালের চা-টা ওর বরাবরই বিলাসিতা।যত ব্যস্তই থাক, নিজের হাতে চা-টা বানিয়ে ছেলে মেয়ে আর মালবিকার সাথে পনের মিনিট ওর একান্তই নিজস্ব। সেই একান্ত আপন সময়েই ওর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠেছিল,”স্যার, মেটার্নিটি ওয়ার্ড থেকে সিস্টার বলছি, আপনি এখুনি একবার আসুন, হাসপাতালে খুব গণ্ডগোল হচ্ছে।”
“আমি একবার বেরোচ্ছি—” মালবিকার উদ্দেশ্যে কথাটা ছুড়ে দিয়েই অনিমেষ বেরিয়ে পড়ল।
মফস্বলের এই হাসপাতালে প্রথম জয়েন করতে এসেছিল জুনিয়র গায়নোকোলজিস্ট হয়ে। তারপর ইউনিট-ইন-চার্জ হিসাবে বহু দিন কাজ করার সুবাদে মেটার্নিটি ওয়ার্ড প্রায় ওর হাতে গড়া। কয়েক বছরের ব্যাবধানে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ওকে এই হাসপাতালেরই সুপারিনটেনডেন্ট করে নিয়ে এসেছে। আর তখন থেকেই এই হাসপাতাল ওর ধ্যান-জ্ঞান।
“স্যার, কাল রাতে একটা সিজার বেবি মারা গেছে, পেশেন্ট পার্টি খুব গন্ডগোল করছে।”
সম্বিত ফিরল অনিমেষের। কাল রাতে তো ডা: মজুমদারের ডিউটি ছিল, তরুণ ও দক্ষ গাইনোকোলজিস্ট।
“যাই হোক ,তুমি সুপারের রুম খোলো, আমি ওদের সাথে কথা বলছি।”
হাসপাতালে ও এখানকার পেশেন্টদের ওপর অনিমেষের অগাধ আস্থা। এটা সে অর্জন করেছে। এ বিষয়ে আত্মশ্লাঘাও আছে ওর। হসপিটালে সবাই জানে ডা: চ্যাটার্জী এলেই সব গোলমাল পলকেই মিটে যায়। কিন্তু আজকের স্টাফটি ঘর খোলার নির্দেশ পেয়েও দাঁড়িয়ে রইল।
“স্যার,আপনার ঘর খোলা কি ঠিক হবে? ওরা কিন্তু ভীষণ ফিউরিয়াস স্যার, পুলিশে–
হাত তুলে থামালো অনিমেষ। হাসপাতালে পুলিশ ডাকার ঘোর বিরোধী সে। পুলিশ প্রোটেকশনে আর যাই হোক ডাক্তারি হয় না। এখনো সে বিশ্বাস করে রুগী আর তার বাড়ির লোকেরাই চিকিৎসকের বড় ভরসা। অনিমেষ এগিয়ে গেল সুপারের নির্দিষ্ট ঘরের দিকে।
“আরে শালা এসে গেছে”—বলতে বলতে একদল লোক ঢুকে পড়ল সুপারের ঘরে। অনিমেষ চেয়ারে বসার সাথে সাথেই টেবিলের ওপর একটি মৃত নবজাতককে রেখে চলল অশ্লীল গালি-গালাজ।
ডা:মজুমদারের থেকে জানা গেল শিশুটির গলায় নাড়ী জড়িয়ে যাওয়ায় অন্তিম মুহূর্তে সিজার করেও বাঁচানো যায় নি তাকে। ডা:মজুমদার সবকিছু বুঝিয়ে বলার পর বাড়ির লোক মাঝরাতেই মৃত শিশুটিকে সৎকারের জন্য নিয়ে যায়। হঠাৎই সকালবেলায় প্রায় শ’খানেক লোক হাসপাতালে চড়াও হয়।
“চল্, বাচ্ছাটাকে সুপারের বৌ-এর কোলে দিয়ে আসি, দুধ খাওয়াবে”—বছর কুড়ির একটা ছেলে বলে উঠলো। ওদিকে তখন কিছু মহিলা ডা: মজুমদারকে মারতে উদ্যত। উঠে দাঁড়াল অনিমেষ,”শুনুন, রুগীকে আমিও বিকেলে দেখেছিলাম, তখনও বাচ্ছাটার কোনো অসুবিধে বোঝা যায় নি।”
“তারপর তুমি বৌ-এর কোলে শুতে চলে গেলে”—সেই বছর কুড়ির কর্কশ কন্ঠ।
এই হট্টগোলের মাঝে হঠাৎই দুজন মানুষের প্রবেশ।উপস্থিত সকলের সমীহ আদায় করেই অনিমেষের উল্টোদিকের চেয়ার টেনে বসলেন, “আপনি সুপার স্যার! ইস্, এই ফুলের মতো বাচ্ছাটাকে মেরে ফেললেন?” সবাই হৈ চৈ করে কিছু বলতে গেলে হাত তুলে ওঁরা থামালেন। “আমি মাইকেল আর এ লিন্টন। ভালো নাম একটা করে আছে তবে এ নামেই এখানে সবাই চেনে।”
অনিমেষ চুপচাপই বসেছিল। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় জানে এরা বলতেই ভালোবাসে,শুনতে নয়।
“তারপর সুপার-সাহেব কি ভাবছেন? পার্টি থেকে এই হাসপাতালটা দেখভালের দায়িত্ব আমাদের ওপর, এখানে যা খুশি তো হতে পারে না।”
“আপাতত শিশুটির আশু সৎকার প্রয়োজন আর ওর মা যাতে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে সেটা দেখা দরকার”—অনিমেষ না বলে পারল না।
“সে সোব তো হবে, কিন্তু কমপেনসেশনটা?”
“কমপেনসেশন?” শিরদাঁড়া সোজা করল অনিমেষ।
“হ্যা,ডা:চ্যাটার্জী, ওরা পাঁচ লাখ বলেছিল, কিন্তু আমরা বললাম বাচ্চাটা তো লেড়কা নেই, লেড়কি আছে তিন লাখে রাজী হয়ে যা।”
মুখের চোয়াল শক্ত হলো অনিমেষের,”আর যদি কমপেনসেশন না দেওয়া হয়?”
“তবে তো ডাক্তার সাব আমাদেরও ভাবতে হবে, আপনি এখানে আর ডাক্তারি করবেন কি না! আপনি তো আবার এখানেও থাকেন, নতুন জায়গাও তো খুঁজতে হবে। তার চেয়ে ডাক্তার সাব, এতো বছর চাকরিতে অনেক কামিয়েছেন, এটুকু টাকা আপনি চটপট নিয়ে চলে আসুন। আমরা বিকাল পর্যন্ত বাচ্ছটার সৎকার আটকে রাখছি।”
“মাইকেলদা,বাচ্ছাটাকে শুয়ারের বাচ্ছার কোয়ার্টারের দরজায় রেখে আসব?”
অনিমেষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মনস্থির করে ফেলেছে, আর নয়–কোয়ার্টারে গিয়ে রেজিগনেশন লেটারটা লিখে এনে জমা দিয়ে দেবে, আজই, এখুনি।
হাঁটা পথে হাসপাতালে থেকে কোয়ার্টার মিনিট দু-তিনের পথ। কোয়ার্টারে ঢোকার মুখে দেখে ছোট একটা জটলা। তবে কি ওরা কোয়ার্টারেও ধাওয়া করেছে!
“ডাক্তারদা, আমার নাম ইসমাইল”—-ঢ্যাঙামতন কাঁচা-পাকা চুলের লোকটা অনিমেষের সামনে এসে দাঁড়াল। “কাল যে মেয়েটির মরা বাচ্ছা হয়েছে, সে আমার মেয়ে।”
হুমকিবিহীন বলার ভঙ্গিতে অনিমেষ দাঁড়ালো,”কিন্তু ভাই,আমি তো তোমাদের দাবি মতো টাকা দিতে পারবো না।”
হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো লোকটা, “টাকা নিয়ে আমি কি করবো ডাক্তারদা, আমার মেয়ের তো বাচ্ছা চাই, আর তা তো দিতে পারেন আপনারাই।আজ থেকে একুশ বছর আগে এরকমই এক রাতে আমার বিবিকে নিয়ে এসেছিলাম এই হাসপাতালে।ঘরে দাই-এর হাতে বাচ্ছা হতে বৌ-এর বাচ্ছার ঘরটাই ফেটে গিয়েছিল স্যার। সারারাত্তির ধরে অপারেশন করে মা ও মেয়েকে বাঁচিয়েছিলেন আপনিই। সেই মেয়েই আজ মা হতে এসেছিল এই হাসপাতালে।”
অনিমেষের মনে পড়ছিল চাকরির প্রথম পর্বে এক ‘রাপচার্ড ইউটেরাস’ পেসেন্টকে নিয়ে সফল যুদ্ধের কথা।
হুঁশ ফিরলো ইসমাইলের কথায়,”এই বাচ্ছার এ অবস্থা ডাক্তারদা আমাদের নসীব। মজুমদার স্যার বাচ্ছার অবস্থা জানিয়ে সিজার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু জামাইবাপ কিছুতেই রাজী হয় নি। শেষে যখন রাজি হলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, তখন সব শেষ।”
“কি আর করা যাবে, আমরা তোমাদের বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারি নি এটাই সত্যি”–বলে অনিমেষ কোয়ার্টারে ঢুকতে ব্যাস্ত হল। আবার সেই,”ডাক্তারদা”। এবার যে কাহিনী শোনালো ইসমাইল তা বেশ চমকপ্রদ।
ভোরবেলাই ওরা হাসপাতাল থেকে মৃত শিশুটিকে সৎকারের জন্যে নিয়ে যাচ্ছিল। পথে কিছু ছেলে ওদের থেকে শিশুটিকে নিয়ে নেয় এক লাখ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতিতে। ইসমাইলের ভাষায়,”স্যার, আমরা কিছু বোঝার আগেই শিশুটি হাতছাড়া হয়ে যায়। তা সত্যি বলতে লোভ যে হয় নি তা নয়।ভাবলাম সরকার তো মেয়ে সন্তানের জন্যে কতো কিছু করছে হয়তো বা—-” কিন্তু হাসপাতালে এসে সবকিছু দেখে ওরা হতবাক।
“স্যার, একটা পয়সাও দেবেন না, আমরা ওদের থেকে আমাদের বাচ্ছাটাকে নিয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করছি।”
ইসমাইলের চারপাশের জটলাটা বড় হচ্ছে আর কি আশ্চর্য ইমারজেন্সির কাছে ওই মারমুখী ভিড়টা ক্রমশ পাতলা হচ্ছে।
“ডাক্তারদা, আমার মেয়ের টাকা নিয়ে কি হবে?পোয়াতি হলে তো আপনাদের কাছেই আসতে হবে।ক্লাবের ছেলেরা কী চিকিৎসা করবে, না আমার মেয়েকে বাঁচাবে?”
অনিমেষের চোখ-মুখ আবার স্বাভাবিক হচ্ছে, শক্ত চোয়াল নরম হচ্ছে। ইসমাইলের পিঠে হাত দিয়ে বলল, কিন্তু ভাই, আমি তো আজ চাকরি ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি।”
হঠাৎ জটলার লোকজন চঞ্চল হল,”আমরা আপনার শাস্তি চাই।”
“কী শাস্তি?”
“ইসমাইলের মেয়ের একটা সুস্থ বাচ্ছার জন্মের ব্যবস্থা না করে আপনার কোথাও ছুটি নেই। কোথাও যাওয়া চলবে না।”
ওদিকে তখন মাইকেল লিন্টনদের জমায়েত ফাঁকা শুনশান।
ডাঃ চ্যাটার্জি কোয়ার্টারে ঢুকলেন স্টেথো আর আ্যপ্রনটা নিতে, আজকের ওয়ার্ড রাউন্ড এখনো বাকি।
“ডাক্তারদা, কাল সকালে ক’টায় বেরোবেন?”
ইসমাইলের কথায় হুঁশ ফিরলো অনিমেষের, “ভোর পাঁচটায়।”
“আমার মেয়ের ইচ্ছে আমার ট্রলিভানে আপনার ব্যাগ-পত্তর নিয়ে আপনাকে ট্রেনে তুলে দেবে, না করবেন না, ডাক্তারদা। আর কমলিও কি ছাড়বে?”
হ্যাঁ, ওই ঘটনার দেড় বছর বাদে ইসমাইলের একটা ফুটফুটে নাতনী হয়েছে অনিমেষদেরই হাসপাতালে।বাচ্চা কোলে ইসমাইল সটান চলে এসেছিল অনিমেষের কোয়ার্টারে,”এ বাচ্ছার নাম আপনিই রাখুন স্যার।”
অনিমেষ নাম দিয়েছিল কমল, আজকের কমলি।
পরদিন ভোরের আলো তখনও ভালো করে ফোটে নি, তিনটে ছায়ামূর্তি চলেছে স্টেশনের মুখে। তারও সামনে বেনীদোলানো ছোট্ট একটা মেয়ে নাচতে নাচতে চলেছে ওর নতুন শেখা ছড়াটা বলে—-
‘ডাক্তার বাবু নমস্কার, আমরা বড় পরিষ্কার।
কোরো নাকো তিরস্কার।।
স্টেশনে ট্রেন ঢুকে পড়েছে। ষাটোর্ধ্ব অনিমেষ লাফিয়ে উঠে পড়ল। ও কে যেতে হবে আরও আরও—। আজ যে সে নব-জাতক।।
অসাধারণ