আপনার বাড়িতে লাগানাে দামি মার্বেলে আমাদের রক্ত লেগে আছে।
আপনাদের এখানে আমার কথা বলতে পেরে আমার খুব ভালাে লাগছে। আমি একজন সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিক। পাথর ভাঙ্গার কারখানাতে কাজ করতে গিয়ে সিলিকোসিস রােগ বুকে নিয়ে ফিরে এসেছি আমরা। আর এখন প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছি। আইলার পর চাষের জমিতে নােনা লেগে জমি নিষ্ফলা হয়ে যায়। পেটের তাগিদে আমার গ্রামের অন্য সব কৃষকদের মতাে আমিও কাজের খোঁজে যাই বর্ধমান, আসানসােল, রানীগঞ্জ, জামুরিয়ার মতো অঞ্চলগুলির বিভিন্ন পাথর খাদানে কাজ করতে।
এই সব পাথর খাদানগুলােয় ৪০ ডিগ্রিরও বেশী গরমে দিনের পর দিন বহু শ্রমিকেরা ন্যূনতম মজুরির বিনিময়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে পাথর ভাঙে। কিন্তু পাথর ভাঙার সময় কোনও রকম সুরক্ষা বা মাস্কের ব্যবস্থাতাে দূর কারখানায় ধুলাে যাতে না ওড়ে তার জন্য পাইপ দিয়ে জল ছেটানাের মতাে সাধারণ ব্যবস্থাও থাকে না। আমরা একটা গামছায় মুখ ঢেকে কোনওরকম ধুলাে আটকানাের চেষ্টা করি। এই ভাবে পাথর ভাঙ্গার কারখানায় কাজ করতে করতে ওই সব পাথরের ধুলাে নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে কোন সময় ফুসফুস নষ্ট করে দিয়েছে বুঝতে পারিনি । এই ভাবেই পাথর খাদানে কাজ করা অন্যান্য অনেক শ্রমিক ভাইয়ের মত আমিও সিলিকোসিস নামে এক মারণ রােগে আক্রান্ত হই। আমার গােয়ালদহ গ্রামের আরাে ২৭ জন যুবক খুন হয়েছে। এই সিলিকোসিস রােগেই। আমাদের গােটা গ্রামের ৪০ জন এই রােগে আক্রান্ত। কাজের আশায় আমাদের মতই গােলদহ থেকে প্রায় ২০০ জন গিয়েছিলাে পাথর খাদানে কাজ করতে। আমাদের পাশের গ্রামেও অনেক সিলিকোসিস রােগী আছে বা ছিল। ছিল বলছি , কারণ এদের মধ্যে অনেকেই এখন বেঁচে নেই। জোয়ানমদ্দ এই সব মানুষেরা কোনও চিকিৎসা না পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে গেল একদিন। কেউ তাদের কোনও খবর নিল না। ভােটের সময় গ্রামে গ্রামে এসে নেতারা কত প্রতিশ্রুতি দেয়, অথচ এতগুলাে মানুষকে বেমালুম ভুলে গেল আমাদের সরকার। এমন ভাবেই শুধুমাত্র রাষ্ট্রশক্তির উদাসীনতায় খুন হয়ে যায় হাজার হাজার শ্রমিক। যদি বলেন খুন কেন বলছি?? আসলে জেনে বুঝেই বলছি। কেউ যদি নিজের ইচ্ছায় পাহাড় থেকে লাফ দেয় সেটাকে আত্মহত্যা বলে। কিন্তু কাউকে যদি পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া হয় তবে সেটা খুন। আমাদেরকেও আসলে কাজের নামে বাধ্য করা হয়েছে এইসব মৃত্যু ফাঁদে পা দেওয়াতে। পেটে ভাত নেই হাতে কাজ নেই , অথচ রাষ্ট্র না পেটের ভাতের দায় নেয়, না কাজের দায়িত্ব নেয়। আমার বড় ভাইও খুন হয়েছে এই রােগে, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনটে বাচ্চা রেখে মারা গেছে। আমার রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন কি হবে ওই বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ?? আমার গ্রামের যে কয়েক শ’ বাচ্চা ছােট বয়সে অনাথ হয়ে গেছে কি হবে তাদের ভবিষ্যতের??? তারাও কি একদিন এই রাষ্ট্রের যাঁতাকলে পড়ে সস্তার শ্রমিকে পরিণত হবে না? তাদেরও ভবিতব্যও কি আমাদের মত অকালে ঝরে যাওয়া? কেন একজন শ্রমিক বা কৃষকের সন্তান সম্মানীয় জীবনযাপন পাবে না? কেন এমন ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু তাদের ললাট লিখন হবে?? আমরা সংসারের অভাবের জন্য কাজ করতে গিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির ছােট ছােট বাচ্চা, বুড়াে বাবা-মার মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতেই বাড়ি ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলাম অচেনা জায়গায়। সেটা কি আমাদের অপরাধ? এখন তাে আবার এই রাষ্ট্র উন্নয়নে ভাসছে। লাখাে মানুষ কোটিপতি হচ্ছে অথচ শ্রমিকের কোন উন্নতি নেই। একজন মালিক সবসময় চেষ্টা করে কিভাবে শ্রমিকদের মজুরি কম দেওয়া যায় । আমরা যেখানে কাজ করতাম, সেখানেও মালিক আমাদের কথা ভাবেনি। খাদানের বিপদের কথা জেনেও ধুলাে আটকাতে কোনও ব্যবস্থা। রাখেনি। কারখানায় পাইপ দিয়ে জল ছেটানাের কথা, সেটাও করা হত না। আসলে মজুরী ছাড়া কোনও অর্থই খরচ করত না মালিক। শুধু কাজের সময়েই নয়, খাওয়ারের মধ্যেও মিশে থাকত ধুলাে, ক্ষিদের মুখে তাই চালান দিতাম পেটে। পেটের তাগিদে খাদানে যারা একবার কাজ ধরে, তারা সব না-মানুষ হয়ে বেঁচে থাকে। ওটা একটা আস্ত নরক। খাদানে আমরা যারা কাজ করেছি কারােই কোনও পরিচয়পত্র ছিল না, শুধু নম্বর ছিল। খাদানে কাজ করতে করতে কেউ যদি মারাও যায়, তবে মালিকের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনও দায় থাকে না এই ব্যবস্থায়। আমাদের লড়াইটা তাদের এই মনােভাবের বিরুদ্ধে। কেন শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-মাথার উপরে ছাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে আমাদের মত মানুষেরা ? এই লড়াইটা আমাদের বেঁচে থাকার অধিকারের। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার নাগরিকের দায়িত্ব নেওয়া। অথচ প্রতিদিন এদেশের এমন অসংখ্য গরিব মানুষ কৃষক থেকে শ্রমিকে পরিণত হয়, তার হিসেব কেউ রাখে না। এরকম কত শ্রমিকই রাষ্ট্রের হাতে খুন হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আমাদের জীবনের কি কোন মূল্যই নেই??? আপনার বাড়িতে লাগানাে দামি মার্বেলে আমাদের রক্ত লেগে আছে। এ সমাজে আমরা যেন থেকেও নেই। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেলে বলে, তােমরা গভর্নমেন্টের নামে কেস করেছ, উপর থেকে নির্দেশ আছে তােমাদের প্রেসক্রিপশনে সিলিকোসিস লেখা যাবে না। কেন সিলিকোসিস লিখছে না ডাক্তারবাবুরা?? কারণ সিলিকোসিস লিখলে শ্রমিকদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারকে। আজ পর্যন্ত সরকারের হাতে খুন হওয়া কাউকে কি কোনদিনও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সরকার? আমাদের মত যারা গুরুতর অসুস্থ কেন তারা ক্ষতিপূরণ পাবে না? আমরা যদি ক্ষতিপূরণ পেতাম তবে তাে প্রয়ােজনীয় চিকিৎসাটা করাতেপারতাম । আজকে কত লােক মদ খেয়ে মারা গেল, ২৪ ঘণ্টা পার হতে না হতে বাড়িতে ক্ষতিপূরণ পৌঁছে যাচ্ছে। অথচ বছরের পর বছর হাজার হাজার শ্রমিক সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়েও কোন ন্যায় বিচার পাচ্ছে না। কেন এরকম হাজার হাজার শ্রমিক সিলিকোসিসে মারা গেলেও রাষ্ট্র কোন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে না? কেন এই মরণাপন্ন রােগীদেরকেও অধিকারের জন্য পথে নামতে হয়? কেন এত আন্দোলনের পরেও হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টের কাছে বারবার বিচার চেয়েও সুবিচার পাইনা আমরা??? সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সত্বেও, বহু বছর ঘুরে গেলে্ এখনাে দোষী সাব্যস্ত মালিকেরা তাদের কারখানাগুলাে বন্ধ করেনি। কেন আমাদের ডেথ সার্টিফিকেটগুলােতে অন্তত সিলিকোসিস রােগের উল্লেখ থাকবে না? আমাদের মত এই কৃষক থেকে শ্রমিক হয়ে যাওয়া সিলিকোসিস রােগীদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য সরকার। কারণ নাগরিকের দায় রাষ্ট্রের। আমরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনাে দয়া চাই না, আমাদের অধিকার চাইছি।
লিখেছেন সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিক নাসির মোল্লা। তিনি সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি-র সদস্য।