নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোগীর বয়ান
আমি সোনার কাজ করি। এখানে কাজের অবস্থা ভালো না হওয়ায় বছর পাঁচেক আগে মুম্বাইতে যাই। ওখানে কাজ করি। বছরে মাস-খানেক বাড়িতে থাকি। বাকি সময় মুম্বাইতে।
বছর তিনেক আগে আমি বিয়ে করি। দুবছর আগে আমার একটি কন্যা হয়। স্ত্রী কন্যা খুলনা পল্লী, মধ্যমগ্রামে আমাদের বাড়িতেই থাকে। আমি বছরে দুবার করে বাড়ি আসি।
গত একবছর ধরে আমি বার বার অসুস্থ হচ্ছিলাম। বার বার পাতলা পাইখানা হতো। কিছুই হজম হতো না। মুখেও বার বার ঘা হচ্ছিল। ওজনও খুব দ্রুত কমছিল। আমি মুম্বাইতে বেশ কয়েকবার ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু বিশেষ সুফল পাইনি। ওষুধ খেলে কমে যেতো। আবার কদিন বাদেই হতো।
বাধ্য হয়ে আমি বাড়ি ফিরে আসি। স্থানীয় একজন ডাক্তারবাবুকে দেখাই। তিনি আমাকে ভালো কওরে দেখে কয়েকটি পরীক্ষা করতে দেন। তার মধ্যে একটি পরীক্ষার জন্য তিনি সরকারি হাসপাতালে পাঠান।
সরকারি হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি পরীক্ষাটি এডস রোগের জন্য। পরীক্ষাটি করার আগে হাসপাতালের কর্মীরা আমাকে ভালো ভাবে সব বোঝান। এডস রোগ সম্বন্ধে আগে ভাসা ভাসা জানতাম। এখানে আরও অনেক কিছু জানলাম। রোগটি অসুরক্ষিত মেলামেশা থেকে হতে পারে। এমনকি রক্ত চালানোর ফলেও হতে পারে।
মুম্বাইতে একা থাকার সময় আমি কয়েকবার কুসঙ্গে মিশে নিষিদ্ধ পল্লীতে গেছি। সেজন্য আজও অনুতাপ হয়। তাই রক্ত দেওয়ার সময় আতংকে ছিলাম। কিন্তু রিপোর্ট জানার পর আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। রক্তে এডস রোগ ধরা পড়েছে।
হাসপাতাল থেকে আমাকে ট্রপিকাল হাসপাতালে এডসের বিভাগে গিয়ে দেখাতে বলা হল। আমি তখন কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। আমার উপার্জনের উপর বয়স্ক মা, স্ত্রী, কন্যা নির্ভর করে। আমার বাবা বছর দশেক আগে মারা গেছেন। আমার কিছু হলে সংসার চলবে কি করে?
আমার ডাক্তারবাবুর কাছে গেলাম। তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন। বললেন, এডস এখন সুগার প্রেশারের মতোই একটি অসুখ, যেটা পুরোপুরি সারে না। কিন্তু ওষুধ খেয়ে গেলে দীর্ঘজীবন সুস্থ থাকা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা ওষুধ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতাল থেকে পাওয়া যাবে।
তিনি আমাকে আরও বললেন, তাড়াতাড়ি স্ত্রী ও কন্যার রক্ত পরীক্ষা করার জন্য।
স্ত্রী ও কন্যার রক্ত দেওয়ার সময় ভয়ংকর আতঙ্ক আর অপরাধ বোধে ভুগছিলাম। এদের কারো যদি এডস ধরা পড়ে তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। ভগবানের অসীম করুণা দুজনেই সুস্থ।
হাসপাতাল থেকে জানতে পারলাম, কি কি সাবধানতা অবলম্বন করলে আমার থেকে স্ত্রীর দেহে এডসের জীবাণু যাবে না। ট্রপিকাল হাসপাতালে আমার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা হ’ল। ওষুধ শুরু হল। এখন আমি বারাসত হাসপাতাল থেকে ওষুধ পাই। তিনমাস ওষুধ খাওয়ার পর আমি অনেক সুস্থ।
আমাকে মুম্বাই যেতেই হবে। এখানে কাজের বড় অভাব। একা কাজ করে তিনটে পেট চালানো সম্ভব নয়। এখানে যদি আমরা ভালো কাজ পেতাম, তাহলে আমার মতো বহু যুবক বাইরে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হতো না। মুম্বাইতে যারা কাজ করে তাদের যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ হামেশাই হয়।
যাই হোক, আমার মা কিছু জানেন না। কিন্তু স্ত্রীকে সব খুলে বলেছি। স্ত্রী আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। তিনমাস বাদে ওদের দুজনের রক্ত আবার পরীক্ষা করা হয়েছে। দুজনেই রোগমুক্ত।
এখন আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মেয়েটাকে মানুষ করে যাওয়া আর মা এবং স্ত্রীর মুখের হাসি ধরে রাখা। আমাকে আরো বেশ কিছুদিন কর্মক্ষম ভাবে বাঁচতে হবে।
রোগাক্রান্ত হওয়ার পর বিভিন্ন চিকিৎসক আর স্বাস্থ কর্মীদের কাছ থেকে আমি যে ভরসা পেয়েছি, তাতে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি।
ওঁদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ক্ষমতা আমার নেই।