একে করোনায় রক্ষে নেই, সাথে ছত্রাক দোসর – এই নিয়ে এখন চারিদিকে উত্তেজনা| সামাজিক মাধ্যম আর সংবাদমাধ্যমে ব্যাপারটা নিয়ে হৈচৈ শুরু হওয়ায় সবাই হয়ে পড়ছি আরো আতঙ্কিত| এরকম প্রজাতির ছত্রাক কিন্তু আমাদের চারদিকেই বরাবর রয়েছে, তবে তারা তখনি আমাদের শরীরে ঢুকে ক্ষতি করতে পারে যদি আমাদের নিজেদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা কমে যায়| এখন প্রশ্ন হলো করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হলেই কি ওনাদের আমাদের শরীরে বাসা বাধার প্রবণতা বাড়ে? উত্তর হলো না| বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে থেকে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতন ওষুধ খেলে আর বিশ্রাম নিলে করোনা থেকে মুক্তি মিলছে – নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্বর, কাশি, হালকা শ্বাসকষ্ট, দুর্বলতা, খাবার অনীহা বা স্বাদ গন্ধ না থাকাও আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাচ্ছে| সেক্ষেত্রে এরকম ছত্রাকের আক্রমণের ঝুঁকি প্রায় নেই বললেই চলে| কিন্তু ঝুঁকি কখন বাড়বে? দুশ্চিন্তার বিষয় হলো আমাদের মধ্যে অনেকেরই বিভিন্ন রকম ক্রনিক রোগ রয়েছে| বর্তমানে আমাদের দেশে ডায়াবেটিস মেলিটাস বা মধুমেহ রোগ প্রায় মহামারীর পর্যায়ে চলে গেছে এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই ডাক্তার এর পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চলেন না, যার ফলে রক্তের শর্করার পরিমাণ হয়তো একেবারেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই| অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এই ছত্রাক সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ| এ ছাড়া কেউ কোনো অটোইমিউন রোগ এর জন্য বা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পরে বহুদিন ধরে স্টেরোয়েড বা অন্য কোনো দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানোর ওষুধ মানে ইম্মুনোসাপ্রেসান্ট খাচ্ছেন, বা কেউ এমন কোনো রোগাক্রান্ত যা শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতাই কমিয়ে দিচ্ছে, যেমন এইচ ই ভি ভাইরাস সংক্রমণ, লিউকেমিয়া ইত্যাদি অথবা কেউ ক্যান্সার রোগাক্রান্ত, বা কেমোথেরাপি চলছে নিদান হিসেবে, তাঁরাও রয়েছেন বিপদসীমায়| এঁরা যদি করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতার হঠাৎ বৃদ্ধি ঘটে তৈরি হওয়া সাইটোকাইন স্টর্ম, যেটা প্রধানত করোনা আক্রান্তদের খারাপ পরিস্থিতির জন্য দায়ী, তা প্রতিরোধের জন্য বেশি মাত্রায় স্টেরোয়েড জাতীয় ওষুধ বা মনোক্লোনাল আন্টিবডি দেওয়া হয়, অথবা অনেকদিন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট এ ভর্তি থাকতে হয় বা ভেন্টিলেটর সাপোর্ট এ থাকতে হয়, তাহলে আমাদের চারদিকে থাকা এই সুযোগসন্ধানী বা অপরচুনিস্টিক ছত্রাকদের তাঁদের দেহে বাসা বেঁধে বসে পড়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়| এছাড়াও কিছু কারণে এই ঝুঁকি বাড়ে যেমন অনেকদিন ধরে প্রচুর এন্টিবায়োটিক আর এন্টিফাঙ্গাল ওষুধ চলা, অনেকদিন ধরে অক্সিজেন নেওয়া, অপুষ্টি বা শরীরে লৌহের পরিমান বেশি থাকা (যেমন সিকল সেল রোগে বা ক্রনিক কিডনির রোগে) ইত্যাদি| আবার অক্সিজেন নেওয়ার সময় হিউমিডিফায়ার এর জল জীবাণুমুক্ত না হলেও এই সমস্যা হতে পারে|
তো এই ছত্রাক কিন্তু কালো নয়, তাই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কথাটাও ঠিক নয়| পরীক্ষাগারে এদের দেখতে বরং সাদা রঙের, আর এদের মাইসেলিয়ামগুলো মাঝে মাঝে কালো বিন্দুর মতো মনে হয়| রোগটার নাম মিউকরমাইকোসিস| ১৮৮৫ সালে আর্নল্ড পাল্টাউফ প্রথম এই রোগের বর্ণনা দেন| যাইগোমাইসেটিস গ্রুপ এর মধ্যে থাকা রাইজোপাস, মিউকর ইত্যাদি প্রজাতিরা প্রধানত এই রোগের জন্য দায়ী| এরা রক্তনালীর মধ্যে ঢুকে কোষকলা ধ্বংস করে এবং নাক, চোখ, মস্তিস্ক অথবা ফুসফুস কে আক্রান্ত করে| তাছাড়াও খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়তে পারে লিভার, প্লীহা, ত্বক, হৃদযন্ত্র বা কিডনিতে| ফলে বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে| রোগের লক্ষণ হিসেবে জ্বর, মাথা ব্যাথা, চোখের চারপাশ আর মুখ ফুলে যাওয়া, সাইনুসাইটিস, চোখে কম দেখতে পাওয়া, নাকে আর মুখে ক্ষত, মুখে-দাঁতে ব্যাথা ইত্যাদি হতে পারে| এবং ঠিক সময়ে রোগটাকে চিন্বিত করে সঠিক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা না করলে তা প্রাণঘাতীও হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা, কারণ এই রোগ খুব দ্রুত খারাপ দিকে যায় এবং বর্তমানে খুব কম সংখ্যক এবং দামি কিছু ওষুধ দিয়েই, যাদের নিজেদেরও বেশ কিছু পার্শপ্রতিক্রিয়া আছে, একমাত্র এইসব সুযোগসন্ধানী ছত্রাকের চিকিৎসা করা যায়|
তাই অযথা ভয় পাওয়া নয়| এই রোগ যথেষ্ট বিরল এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রেই কেবল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে| শুধু আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে| প্রত্যেকে ডায়াবেটিস বা অন্য ক্রনিক রোগের জন্য যে ওষুধ খেয়ে যাচ্ছেন বা নির্দিষ্ট রুটিনে জীবনযাপন করছেন, তা বন্ধ করা তো যাবেই না, বরং অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে যদি তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না থাকে| সেইমতো নিয়মিত ভাবে ওষুধ ব্যবহার করতে হবে, সাথে খেতে হবে পুষ্টিকর খাবার| অতিরিক্ত তেল মশলা দেওয়া খাবার এড়িয়ে চলতে হবে| আর করোনা রোগাক্রান্ত হলে ডাক্তারের পরামর্শ মতন চলতে হবে, সাথে নিজের প্রতি যত্ন নিতে হবে| শুধু শারীরিক নয়, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যও যাতে ঠিক থাকে সেদিকে সবসময় লক্ষ্য রাখতে হবে| সঙ্গে মাস্ক, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, নিয়মিত স্যানিটাইজার ব্যবহার করা আর শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে চলার মাধ্যমে আমাদের সবাইকে সতর্কতা অবলম্বন চালিয়ে যেতে হবে| তবেই শুধু করোনা নয়, সাথে আসা অন্য যে কোনো রোগের বিরুদ্ধেও আমরা জয়ী হবো|