ছোটবেলায় একটা খেলা আমরা সবাই খেলেছি, মাটির ওপর একটা দাগ কেটে বন্ধুকে বলেছি, না কেটে এই দাগটাকে ছোট করে দিতে পারবি?
অনেক ভেবে চিন্তে বন্ধুটি যখন মাথা চুলকে জানায় পারবে না, তখন সেই আগের দাগের পাশে তার চেয়ে অনেকটা বড়ো একটা দাগ কেটে, কোমরে হাত দিয়ে বলা, এই দ্যাখ কেমন ছোট হয়ে গেল ওই আগের দাগটা !
কোভিডের এই ফার্স্ট আর সেকেন্ড ওয়েভের ব্যাপারটাও ঠিক তাই! আগে যে সংখ্যাগুলি খুব বেশি মনে হয়েছিল, পরে দেখা গেলো, সিতারোঁ কে আগে ঔর ভি হ্যায় দুনিয়া!
এই লেখাটা লিখেছিলাম ঠিক তিন মাস আগে, মার্চের মাঝামাঝি! সেকেন্ড ওয়েভ আসার ঠিক আগে!
অনেকে পড়েছিলেন, শেয়ার করেছিলেন, গালাগালিও দিয়েছিলেন, কিন্তু মনে রাখেন নি মনে হয়!
প্রথমবারের পীকটা যদি মিরিক হয় এবারে ছাঙ্গু ছাড়িয়ে আমরা নাথুলা গিয়েছিলাম! এখন সেখান থেকে নেমে প্রায় কালিম্পঙ!
একটু ভাবুন এবার আরো নেমে তিস্তাবাজার হয়ে ডুয়ার্সে যাবেন? না অক্সিজেন ছাড়া ওই হিমশীতল কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়োয়?
সঙ্গে গলা ছেড়ে গান
-তৃতীয় তরঙ্গ রে …
তৃতীয় তরঙ্গ রে, তৃতীয় তরঙ্গ রে।
সব গগন উদ্বেলিয়া– মগন করি অতীত অনাগত
আঁধার -কজ্জ্বল মরণ -চঞ্চল একি কৃতান্ত-তরঙ্গ॥
বহিছে শিরদাঁড়ায় শীতলধারা
চমকি কম্পিছে চেতনাধারা,
আকুল চঞ্চল নাচে সংসারে, শিহরে হৃদয়বিহঙ্গ॥
তৃতীয় তরঙ্গ রে, তৃতীয় তরঙ্গ রে।
(ক্ষমা করবেন গুরুদেব !)
আসুন আর একবার পড়ে নিই সেই লেখাটা! আর চোখ বুলিয়ে নিই ছোটো বেলার খেলার মতো সংখ্যাগুলোর পাশে পাশে ব্র্যাকেটে এখনকার সংখ্যাতত্ত্বের হিসেব!
ভ্যাকসিন নিন প্রথম সুযোগেই, কিন্তু কোভিড বিধি ভুলে যাবেন না
এটা একটা অতিমারী পরিস্থিতি, যেটা অভূতপূর্ব না হলেও, ভয়ঙ্কর!
বিশ্বে এ যাবৎ প্রায় ১২ কোটি (এখন ১৭.৮ কোটি) মানুষ কোভিডের কবলে পড়েছেন! প্রাণ হারিয়েছেন সাড়ে চব্বিশ লক্ষ (এখন সাড়ে আটত্রিশেরও বেশি) মানুষ।
আমাদের দেশে এ যাবৎ আক্রান্ত এক কোটি তেরো লক্ষ মানুষ (এখন প্রায় তিন কোটি), প্রাণ গেছে প্রায় এক লক্ষ ষাট হাজার জনের (ওটা পুরোনো হিসাব, কাল অবধি দেশে মারা গেছেন ৩,৮৫,১৬৭ জন)!
গতকাল সারা দেশে ২৭৫১২ জন নতুন রোগী ধরা পড়েছেন (ওটা পুরোনো হিসাব, আসলে কাল ৬০,৭৬৫ নতুন রোগী ধরা পড়েছে, ৬ ই মে একদিনে আমরা ৪ লক্ষ ১৪ হাজারের বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছি)। মারা গেছেন ১৫৭ জন! (আসলে হাজার দেড়েক)। ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০ (২৭৩৩৬ )-র পর এই প্রথম এক দিনে এতো রোগী ধরা পড়লেন।
দ্বিতীয় ঢেউ বলার সময় এসেছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই প্রবণতা যথেষ্ট আশঙ্কার।
অনেক হাসপাতালে আবার কোভিড আইসিইউ এবং এইচডিইউগুলি ভর্তি হয়ে থাকছে, কোভিড আইসিইউ বা এইচডিইউ-তে বেড পাওয়া যাচ্ছে না, পাওয়া যাচ্ছে না ফ্রিতে ভেন্টিলেটর।
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীর দল, সময়ের সঙ্গে এক অসম লড়াই লড়ে আমাদের হাতে এনে দিয়েছেন হাফ ডজন কার্যকরী ভ্যাকসিন ! এতো তাড়াতাড়ি কোনো টীকা উদ্ভাবন থেকে প্রয়োগ মানবসভ্যতায় এই প্রথম! আর সেটাও আপৎকালীন প্রয়োগ!
তাই কী বলা হয়েছিল, কোন টীকা কতখানি কার্যকারী তথ্যগত সে সব কুটকাচালির সময় এটা নয়!
একটা জিনিস মনে রাখতে হবে কোন প্রতিষেধকই কিন্তু একশ শতাংশ কার্যকরী নয়! কোভিডের ক্ষেত্রেও তাই! এটা একটা ইভলভিং বা ক্রমস্ফুটায়মান পরিস্থিতি!
আমরা এখনো জানিও না এটা মারীর শুরু, শেষ না মাঝামাঝি!
সবিনয়ে বলি এটা অন্যমত, সহমত, বহুমত, ভিন্নমতের সময় নয়!
বিতর্ক চলুক কিন্তু নিজের, নিজের পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তারপর!
অনেকে বলছেন ভ্যাকসিন নিয়েও কেস বাড়ছে কেন?
কোন সময়ে কোন দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ হচ্ছে সেটাও বিচার্য!
মার্কিন মুলুক আর ইংল্যান্ডে টিকাকরণ শুরু হয় তাদের ভয়াবহ দ্বিতীয় বা তৃতীয় তরঙ্গ শীর্ষে! সেসব দেশে ভ্যাকসিনের পর কেস সংখ্যা নেমে এসেছে হুহু করে!
আমাদের দেশে, মধ্যপ্রাচ্যে, টীকাকরণ শুরু হয় মারীর প্রথম তরঙ্গ শেষে!
আমাদের দেশে জনসংখ্যার মাত্র দেড় শতাংশ (এখন ষোলো) প্রথম ডোজ পেয়েছেন!
সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের দেশে জনসংখ্যার মাত্র এক চতুর্থাংশ থেকে এক তৃতীয়াংশের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনো কোভিড থেকে নিরাপদ নন।
আমাদের ১০ কোটি রাজ্যবাসীর মধ্যে টীকা পেয়েছেন মাত্র ২০.৩ লক্ষ। (এখন সংখ্যাটা প্রায় দুকোটি) জন টীকা পেয়েছেন সব মিলিয়ে। অর্থাৎ এঁদের মধ্যে কেউ একটিমাত্র বা কেউ দুটি ডোজ পেয়েছেন।
আর পরীক্ষা হয়েছে ৮৭ লক্ষের কিছু বেশি মানুষের।
ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজের দু সপ্তাহ পরই শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে ।
তাই কেস সংখ্যা বাড়তে শুরু হওয়ায় গেলো গেলো রব তোলার কিছু নেই!
আর, কোভিডের ফিরে আসার মূলে কোভিড বিধি নিয়ে আমাদের গয়ংগচ্ছ মনোভাব!
রাজ্যে আসন্ন নির্বাচনে উপলক্ষে সব রাজনৈতিক দলের মিছিল মিটিং সমাবেশের প্রতিযোগিতায় কোভিড বিধি উধাও।
অংশগ্ৰহণকারী সাধারণ মানুষ, নেতা-নেত্রীরা, এমনকি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ, রক্ষীবাহিনীর অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই, থাকলেও তা থুতনিতে নামিয়ে রাখাটাই রীতি হয়ে গেছে, দূরত্ববিধি মানার কোন লক্ষণ নেই। অর্থাৎ সংক্রমণ ছড়ানোর প্রতিটি কর্মই পালিত হচ্ছে এবং সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি নানা বিষয়ে পরস্পরকে বিরোধিতা করলেও এই বিষয়ে সবদলই সহমত।
পাশাপাশি চলছে টীকাকরণ!
এখন এটাই দেখার আমরা দ্বিতীয় তরঙ্গকে কতখানি বিলম্বিত বা খর্বিত করতে পারি!
(আমরা পারিনি, আমাদের কথা কেউ শোনেন নি! আমরা ভোট করেছি, মহাকুম্ভ করেছি আর চোখ বুজে থেকেছি !)
বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের অতি অবশ্যই টীকা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
নিজে পঁয়তাল্লিশ ঊর্দ্ধ হলে, কোমর্বিডিটি থাকলে, প্রথম সারির যোদ্ধা হলে নিজে অবশ্যই টীকা নিন।
আর হ্যাঁ, নাক ঢেকে মাস্ক পড়ুন, দুগজের শারীরিক দূরত্ব মেনে চলুন, হাত জীবাণুমুক্ত রাখুন ।
এটা একমাত্র উপায়, অস্তিত্বরক্ষার!