প্রতিটি নবজাতক প্রত্যেক পরিবারের কাছে অত্যান্ত মূল্যবান। হাসপাতালে বা নার্সিংহোম, যেখানেই শিশুর জন্ম হোক না কেন, সাধারণ অবস্থায় ৪/৫ দিনের মধ্যে সেখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তার পরে শিশুর পরিচর্যার প্রধান দায়িত্ব তার মায়ের বা বাড়ির লোকের। এই লেখায় আমরা আলোচনে করব, বাড়িতে এনে শিশুকে প্রথমে কি করবেন, কি কি দেখবেন।
প্রথমেই ঘরের মধ্যে যথেষ্ট আলোয় পরিষ্কার নরম বিছানায় শিশুকে শুইয়ে খালি গায়ে দেখে নিতে হবে তার কোন অসুবিধা আছে কি না। এক এক করে পরীক্ষা করতে হবে শিশুর ত্বক, তার মাথা, চোখ ইত্যাদি। এই প্রতিবেদনে বলব, আপনি শিশুর ত্বকে কি কি দেখবেন।
১। ত্বকের রঙঃ
স্বাভাবিক ত্বকের রঙ সাদাটে, হলদেটে বা গোলাপী হতে পারে। এটি নির্ভর করে তাদের পরিবারের লোকের বা জাতিসত্ত্বার উপর। যেমন একজন ইউরোপের লোকের গায়ের রঙ যেমন হবে, একজন ভারতীয়ের গায়ের রঙ সে রকম হবে না। আর শিশুর ত্বকের রঙ শিশু কি করছে তার উপরেও অনেকটা নির্ভর করে। চুপ থাকলে এক রকম হতে পারে, কাঁদলে অন্যরকম হতে পারে। তবে যে বিষয়টি বেশী দেখা দরকার তা হল চামড়ার রঙ হলুদ কি না, বা হলদে হয়ে যাচ্ছে কি না।
বেশীরভাগ শিশুর কম-বেশী জন্ডিস হয়। জন্মের দুই-তিন দিন পরে এই জন্ডিস দেখা দেয়, থাকে স্বাধারণতঃ ১০-১২ দিন পরে শিশু ভাল হয়ে যায়। কোনও কিছু করার দরকার হয় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে – মায়ের রক্তের গ্রুপ আলাদা হলে, বা শিশুর অন্য কোনও অসুখের জন্যে জন্ডিস মারাত্মক হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে রক্ত বদলানোর দরকারও হতে পারে। কাজেই খেয়াল রাখতে হবে, শিশুর জন্ডিস দিন দিন বাড়ছে কি না।
যদি শিশুর গায়ের সং ফর্সা হয়, তবে সহজেই হলদে রঙ চোখে পড়ে, কিন্তু ফর্সা নয়া হয়, তবে জন্ডিস সহজে চোখে পড়ে না। সেক্ষেত্রে উপায় হল, শিশুর ত্বকে হাল্কা করে চাপ দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে। এক দুই সেকেন্ডের জন্যে ত্বক থেকে রক্ত সরে যায় এবং তখন হলদে রঙ পরিস্কার দেখা যায়। জন্ডিস কম হলে শরীরের উপরের অংশে দেখা যায়, যদি বেশী হয়, তবে পায়ে বা গোড়ালির কাছেও হলদে রঙ দেখা যায়। বেশি হলদে হলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
২। ত্বকের র্যাস (Rash) বা মাসিপিসি
বেশীরভাগ (৫২-৭০%) শিশুর গায়ে জন্মের পরে মুখে, গালে, কপালে, শরীরের উপরের অংশে র্যাস বা ফুস্কুড়ি দেখা যায়। জন্মের কয়েকঘন্টা পরে থেকে ১/২ দিনের মধ্যেই এটা দেখা যায়। এক ধরণের ফুস্কুড়ির মত, দেখতে সাদাটে, তার চারধারে লাল হয়ে যায়। অনেক সময় দেখতে ভয়ঙ্কর লাগে। বাংলায় এগুলোকে মাসি-পিসি বলে। এর জন্যে বিশেষ কোন চিকিৎসার দরকার হয় না। বেশি হলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
৩। হাত-পা নীলচে হয়ে যাওয়া (Acrocyanosis)
ইংরাজীতে বলে এক্রোসায়ানোসিস ( Acrocyanosis): জন্মের প্রথম কয়েক ঘন্টার মধ্যে বেশী দেখা যায়। এর কারণ হাত-পায়ে রক্ত চলাচল কমে যাওয়া। তার নানা রকম কারণ থাকতে পারে। শিশুকে ঢেকে রাখতে হবে, যেন তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে না যায়। তবে মুখ বা ঠোঁট যদি নীল হয়ে যায়, তবে অন্য কোনও রোগের কথা চিন্তা করতে হবে। তার হার্টের সমস্যাও থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে যতশীঘ্র সম্ভব চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
৪। মোজাইকের মত দাগযুক্ত ত্বকঃ Mottling
ইংরাজীতে বলে –Mottling. সারা গায়ে মনে হয় যেন লালচে দাগের মত ছোপ ছোপ। দাগগুলো এঁকে বেঁকে চলে গেছে। তার মাঝে মাঝে সাদাটে ভাব। অনেকটা মোজাইকের টাইলসের মত। এর প্রধান কারণ রক্ত চলাচলের সমস্যা। কোনও কারণে যদি হাত পায়ে বা ত্বকে রক্ত চলাচল কমে যায় তবে এমন হতে পারে। আগে দেখতে হবে শিশুর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে কি না। তাহলে হাত-পা ঢেকে তাকে ঠান্ডা থাকে বাঁচাতে হবে।
সমস্যা যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তবে অন্য রোগের কথা চিন্তা করতে হবে, এবং অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
৫। মিলিয়া (Milia):
প্রায় ৪০-৫০% শিশুর মুখে ছোট ছোট সাদা দানার মত ফুস্কুড়ি ওঠে। একসাথে এক যায়গায় একাধিক উঠতে পারে। তবে মাসিপিসির মত তার চারধারে লাল থাকে না। এর আর এক নাম ‘Epstein’s pearls’. মানে এপস্টেইনের মুক্ত। বৈজ্ঞানিক এপস্টেইনের নাম অনুসারে এই নাম। এটি এক ধরনের সিস্ট বা থলি। লোমকুপের গোড়ায় হয়, ভিতরে থাকে কেরাটিন নামক যৌগ, যা চর্মকোষে থাকে। বড়দেরও হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে জন্মের সময়ও এটি দেখা যেতে পারে। তবে কয়েক সপ্তাহ পরেই সেরে যায়, কোনও চিকিৎসার দরকার হয় না।
৬। ত্বকের লাল ছোপ (Salmon Patch):
খুব কম শিশুই একেবারে নিখুত ত্বক নিয়ে জন্মায়। কিছু কিছু ত্বকের অস্বাভাবিক দাগ বা রঙ জন্ম থেকেই দেখা যায়। ‘সালমন প্যাচ’ তেমনি এক ধরণের ত্বকের লাল ছোপ, যা জন্ম থেকেই থাকতে পারে অথবা জন্মের পর পরই দেখা দেয়। এক তৃতীয়াংশ শিশুর ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়, যার মধ্যে ৭০ শতাংশের হয় জন্মের পরে। সাধারণতঃ চোখের পাতায় বা কপালে, মুখের কোনও অংশে, মাথার পিছনে বা ঘাড়ের কাছে ত্বকের কিছু অংশ গোলাপী বা লাল হয়ে যায়।
এর কারণ শিশুর রক্তেজালক বা ক্যাপিলারি শিশুর নরম ত্বকের উপর দিয়ে দেখা যায়। কেন সব শিশুর হয় না বা সারা গায়ে দেখা যায় না তার নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় নি। যখন শিশু কাঁদে বা তার তাপমাত্রা বাড়ে বা জ্বর হয়, এই ছোপ আরও বেশি স্পস্ট হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় অঙ্গুল দিয়ে হাল্কা চাপ দিলে রক্ত সরে গিয়ে সাদা হয়ে যায়, আবার রক্ত এসে আগের রঙে ফিরে আসে।
সালমন প্যাচ ২ প্রকার হতে পারে। যখন মুখের সামনের দিকে বা কপালে হয়, তখন তাকে বলে ‘Angel kiss’। পরীদের চুমু? আর যখন ঘাড়ের পিছনে হয়, তখন তাকে বলে ‘Stroke bite”. তুলনামূলকভাবে Angel kiss দুই বছরের মধ্যে সেরে যায়, কিন্তু Salmon Patch সারতে সময় লাগে। কোন কোন ক্ষেত্রে সারা জীবনও থেকে যেতে পারে।
তবে এটি ছোঁয়াচে কোন রোগ নয় এবং কোন চিকিৎসার দরকার হয় না।
৭। মাথার খুস্কি (Cradle Cap):
ঠিক জন্মের সময় এটি দেখা যায় না। কয়েকদিন পরে দেখা যায় শিশুর মাথার ত্বকে প্রথমে খুস্কির মত হয়ে ধীরে ধীরে মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। তারপর শুকিয়ে গিয়ে সেখান থেকে চামড়া উঠতে থাকে এবং চুলের সাথেও জড়িয়ে যায়, ফলে চুলও উঠে যায়। দেখে মনে হয় ঘা হয়েছে। শিশুর অস্বস্তি হয়, মাথা চুলকাতে থাকে।
বেশি হলে অবশ্যই চিকিৎসার দরকার আছে, কিন্তু প্রথমেই অল্প থাকতে পরিস্কার করে দিলে আর বাড়াবাড়ি হয় না। বাড়াবাড়ি হওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
যে বিষয়গুলি নবজাতকের ত্বকে বেশি দেখা যেয় তাই নিয়ে আলোচনা করা হল। এ ছাড়াও অন্য কিছু দেখা গেলে বা অন্য কোন অসুবিধা হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।