আজ, ৩০২১ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুলাই।
অনলাইন বাংলা সাহিত্যের ক্লাসে অনুপম স্যার আসতেই স্ক্রিনে স্ক্রিনে আনন্দধ্বনি শোনা গেল। নানা রকম ব্যতিক্রমী ভাবনায় ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করেন বলে খুবই জনপ্রিয় এই অনুপম স্যার।
হলোগ্রাফিক ইমেজের শিক্ষক বললেন- আজকের বিষয় উত্তরণের গল্প! তাই তো?
– হ্যাঁ স্যার। পুরোনো দিনের মত কোরাসে সায় দিল সাহিত্যের ছাত্র ছাত্রীরা।
– বলো দেখি, এই উত্তরণ শব্দটার মানে কী?
স্যারের মুখ থেকে কথাটা বেরোনো মাত্রই অনলাইন ডিকশনারি থেকে অর্থটা বার করে ফেলল সবাই। স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করতে লাগল ডিকশনারির ভাষ্য।
উত্তরণ হল, বি. ১ (প্রধানত নদী সাগর প্রভৃতি) পার হওয়া; ২ পৌঁছানো; ৩ উপরে ওঠা, এগিয়ে যাওয়া, নীচের দিক থেকে উপরে ওঠা; ৪ পরীক্ষায় সাফল্য।
[সং. উত্ + √ তৃ + অন]।
অনুপম ভুরু কুঁচকে চিন্তা করলেন কয়েক মুহূর্ত। হোম ওয়ার্ক করতেই হয়। আজ সকাল থেকেই অভিধানের এই অর্থটা নিয়ে তিনি সংশয়ে রয়েছেন।
ছাত্রদেরকে বলেই ফেললেন তাঁর মনের কথাটা- উত্তরণ মানে কি শুধুই এগিয়ে যাওয়া? নীচে থেকে ওপরে ওঠা? এই যে টেকনোলজির উন্নতি, জন্ম-মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় অমরত্ব লাভ, মহাকাশ জয় এই সবই খালি উত্তরণ? পিছিয়ে যাওয়া, পিছিয়ে গিয়ে আদিমতার কাছে পৌঁছোনোতেও যদি উত্তরণের আভাস থাকে?
– স্যার, পিছিয়ে যাবার মধ্যে মানে পেছন দিকে এগিয়ে যাওয়া? নীচে নামার মধ্যে ওপরে ওঠার সঙ্কেত? কেমন স্ববিরোধী শোনাচ্ছে না?
– না হে, এ’টাকে বিরোধাভাস বলতে পারো তোমরা। আজ তোমাদের সাহিত্য পড়াব না। বিশ্ব বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির ক্রোড়পত্রের একটা রিপোর্ট বরং পড়াই তোমাদের। শোনো।
স্যার সেই রিপোর্টটা পড়তে শুরু করলেন।
★
সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের তরফে মহা পরিচালক রুহু এক সাংবাদিক সম্মেলনে ” ইতিহাসের সর্বকালীন সেরা আবিষ্কারক”কে খোঁজার যে সাম্প্রতিকতম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার ব্যর্থতার কথা ঘোষণা করলেন।
ইতিহাসের সর্বকালীন সেরা আবিষ্কার হিসেবে তাঁরা আগুন আবিষ্কারকে চিহ্নিত করেছেন। এই আবিষ্কারের জন্য প্রাপ্য পুরস্কার “গ্যালাকটিক স্পেস টাইম মেডেল” দিয়ে আবিষ্কারক বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানীদের গ্রুপকে সম্মানিত করার জন্য সময়যানে করে বিখ্যাত মহিলা সময় পরিব্রাজক লুসি আর পুরুষ অভিযাত্রী সোহাকে সুদূর অতীতে পাঠানো হয়। লুসি এই অভিযানের নেত্রী ছিলেন। এবং পুরস্কারের ব্যাপারে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
সেই সময়যান ফিরে এসেছে। কিন্তু তাতে সোহা একলা ফিরেছেন। তাঁর কাছে প্রাপ্য তথ্য অনুযায়ী ব্যাপক অনুসন্ধানের পরও অভিযাত্রীরা কোনও একক মানুষ বা গোষ্ঠীকে আবিষ্কারক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন নি। কাজেই বিশেষ কোনও আবিষ্কারক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে পুরস্কারটা দেওয়া যায়নি।
বিরাট কালখণ্ড জুড়ে মানুষেরা কেউ আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভা থেকে, কেউ দাবানলের থেকে আগুন সংগ্রহ আর সংরক্ষণ করেছে। তারা আগুন দিয়ে হিংস্র শ্বাপদ তাড়িয়েছে। পশুপাখির মাংস ও শস্যকে আগুনে পুড়িয়ে বা সিদ্ধ করে স্বাদযুক্ত করার প্রকরণ শিখেছে। আগুনের ব্যবহার করে মাটি পুড়িয়ে শক্ত উপকরণ তৈরি করেছে। ধাতু নিষ্কাশন করেছে।
বস্তুত পাথরে পাথর ঘষে আগুন উৎপাদন থেকে দিয়াশলাই লাইটার ইত্যাদি বিবিধ উপকরণে বিধৃত এই অগ্নিসংক্রান্ত বিশাল ইতিহাস। আগুন আবিষ্কারের সমগ্র ইতিহাস বড়ই বিক্ষিপ্ত ও বিস্তৃত।
প্রাথমিক ব্যর্থতার পর অভিযাত্রীরা আগুনের প্রতি মানুষের মুগ্ধতার উৎস অনুসন্ধানে আরও অতীতে সময়যানকে চালিত করেন।
আদিম আফ্রিকার এক মনুষ্য গোষ্ঠীর মধ্যে সেই মুগ্ধতার প্রথম উন্মেষ পাওয়া গেলে, অভিযাত্রীরা অনুসন্ধানে ক্ষান্তি দেন। কিন্তু অভিযানের নেত্রী লুসি সিদ্ধান্ত নেন নিছক মেডেল নয়, পুরস্কার হিসেবে এদের প্রাপ্য উন্নততর জিন ।
সেই অনুযায়ী দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি আদিম পিতাদের সাথে নিজে মিলিত হয়ে উন্নততর জিন সমৃদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম তৈরির জন্য সেই সুপ্রাচীন সময়েই থেকে গিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, বর্তমানের প্রচলিত বাধ্যতামূলক রাষ্ট্রীয় কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র-গর্ভে সন্তান উৎপাদনের বদলে প্রাচীন পদ্ধতিতে নিজের গর্ভে সন্তান লাভের রোমান্টিক অবসেশনের জন্য লুসির চিকিৎসা চলছিল।
সময় পরিব্রাজক লুসি না ফেরায় রুহু বিজ্ঞান পরিষদের তরফে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেন।
দুঃখ প্রকাশের সময় মহা পরিচালকের মুখে রহস্যজনক হাসি ভেসে ওঠায় সাংবাদিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।
★
এতখানি রিপোর্ট পাঠের পর অনুপমের মুখেও ফুটে উঠল রহস্যময় হাসি।
স্যার বুঝিয়ে বললেন,- এই হল সেই বিরোধাভাস। এই যে লুসি, সময়রেখায় পিছিয়ে গিয়ে সেখানেই থেকে গেলেন, মানব প্রজাতির জিনের উন্নতির কথা ভেবে, এবং সেই উন্নতি হলও, এটাও তো এক উত্তরণের গল্পই।
ছাত্ররা জটিল গল্পটা শুনে মাথা নাড়ল।
স্যার আবারও বললেন, ধরো এই রিপোর্টটাই যদি একটা গল্প হয়, এ’টাকেই যদি একটা গল্প হিসেবে ধরি, গল্পটার কী নাম দেওয়া যায়?
– কী নাম দেব স্যার? সমস্বরে প্রশ্ন করল শিক্ষার্থীরা।
সর্দার পড়ুয়া বলল,- গল্পটার নাম রাখা হোক, প্রমিথিউসের মা।
স্যার সায় দিয়ে বললেন,- ভেরি গুড!