গত ক’মাস ধরেই সুপর্ণার চুল পড়ে যাচ্ছে, মুখ জুড়ে ব্রণ, শরীরে মেদ জমছে, পিরিয়ডও নিয়মিত হয় না, সমস্ত কাজেই কেমন যেন ক্লান্তি-ভাব। রক্তের কিছু পরীক্ষা এবং আলট্রাসোনোগ্রাফিতে ধরা পড়ে PCOS।
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা PCOS আজকের দিনে মেয়েদের খুব সাধারণ একটি স্বাস্থ্য সমস্যা।
১৯৩৫ সালে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী স্টেইন ও লিভানথাল এই বিষয়টিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সামনে হাজির করেন। এটিকে একটি ‘ডিজিজ’ না বলে ‘সিনড্রোম’ বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত কারণ শুধুমাত্র ওভারিই নয় বরং শরীর জুড়ে নানা সমস্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এতে। রোগটির অপর নাম স্টেইন-লিভানথাল সিনড্রোম (Stein-Leventhal Syndrome)।
মূল উপসর্গসমূহ
সাধারণত ১৩ থেকে ৩৫ বছরের মেয়েদের মধ্যে বেশি দেখা দেয় এই সমস্যা। আক্রান্তদের মধ্যে নানা উপসর্গের মধ্যে অন্যতম হল-
১. অনিয়মিত পিরিয়ড (মাসিক রজঃস্রাব একেবারেই বন্ধ বা রক্তক্ষরণ কমে যাওয়া বা কয়েকমাস বন্ধ থাকার পর হঠাৎ করে বেশি পরিমাণ/দীর্ঘকালীন রক্তক্ষরণ হতে পারে),
২. ওজন বৃদ্ধি (যদিও এক তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক থাকে),
৩. ব্রণ (অনেকের ক্ষেত্রে নাও থাকতে পারে),
৪. ৭০% ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত রোম (Hirsutism)/ ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখার মতো লোম,
৫. চুল পড়া (androgenic alopecia),
৬. ৫% ক্ষেত্রে ঘাড়ের নীচে বা বগলে ভেলভেটের মতো পুরু কালো চামড়া (Acanthosis Nigricans)।
কেন হয় এই রোগ ?
গবেষণায় দেখা গেছে ‘ইনসুলিন রেজিসট্যানস’ (Insulin resistance) এই রোগে কেন্দ্রীয় ভূমিকা নেয়। জেনেটিক ফ্যাক্টর খানিকটা দায়ী হলেও মেদ সঞ্চয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। শরীরের কোষগুলিতে ইনসুলিনের ক্রিয়া কমে যাওয়ার দরুন ওভারি থেকে আনড্রোজেন হরমোন (androgens) বেশি নিঃসৃত হয়। ফলত ডিম্বাশয় (Ovary)-এর থেকে নির্দিষ্ট সময়ে (মাসিক রক্তক্ষরণের ২ সপ্তাহ আগে) ডিম্বাণু (ovum) নিঃসরণ হয় না, তা ওভারির মধ্যেই থেকে যায় এবং ছোট ছোট সিস্ট তৈরি করে। ফলস্বরূপ রজঃস্রাব অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং সন্তান ধারণ ক্ষমতা কমে যায়।
দৈনন্দিন যন্ত্রনির্ভর জীবনে শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্যালোরি খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণই এর মূলে রয়েছে। তাছাড়া বর্তমান ফাস্ট ফুড সংস্কৃতির কথাও না উল্লেখ করলেই নয়। প্রতিযোগিতার জীবনে অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অ্যালকোহোলিসম (মদ্যপান), ধূমপান ইত্যাদিও অনেকাংশেই দায়ী।
দীর্ঘকালীন প্রভাব
দীর্ঘসময় জুড়ে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে পরবর্তীকালে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিস, হাইপারলিপিডেমিয়া (রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল), হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ), জরায়ু ক্যানসার-এর প্রকোপ বাড়ে।
বেশিরভাগ সময়ই প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই রোগ। ১৫% ক্ষেত্রে গর্ভবতী অবস্থার প্রথম তিন মাসের মধ্যে গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে।
রোগ-নির্ণয়
রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ গুলির ওপর ভিত্তি করে রক্তের পরীক্ষা এবং আলট্রাসোনোগ্রাফি করানো হয়। কমন মিথ হোল ওভারিতে সিস্ট থাকা মানেই PCOS । এটি অত্যন্ত ভুল একটি ধারণা ।
প্রজননক্ষম যে কোন মহিলার ওভারিতে সিস্ট থাকতে পারে, যা স্বাভাবিক ধরা হয়। অনেক সময় এগুলো সিস্টের মতো দেখতে লাগে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে সিস্ট নয়। তাই মনে রাখতে হবে ওভারিতে সিস্ট থাকা মানেই PCOS নয়।
কোনও একটি লক্ষণ থাকাও যেমন জরুরি নয়, তেমনই কোনও একটি রোগ লক্ষণ বা বিশেষ পরীক্ষা ফলের ওপর ভিত্তি করে ডায়াগনোসিস হয় না। অর্থাৎ অনেকগুলি বৈশিষ্ট্য একসাথে পাওয়া দরকার। কিছু নির্দিষ্ট গাইডলাইন যেমন ROTTERDAM CRITERIA-র ওপর ভিত্তি করে ডায়াগনোসিস করা হয়।
রক্তে আনড্রোজেন হরমোন মাত্রা, LH/FSH হরমোন মাত্রার অনুপাত দেখা হয়। আলট্রাসোনোগ্রাফিতে ডিম্বাশয়ে ‘মুক্তোর মালা’-র মতো বিন্যস্ত অনেক সিস্ট পাওয়া যেতে পারে (যদিও থাকতেই হবে এমন নয়)।
চিকিৎসা
অহেতুক ভয় পাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। দেখা গেছে শরীরের ওজন কমার সঙ্গে ডিম্বাণু নিঃসরণের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। জীবনযাত্রার পরিবর্তন (Lifestyle Modification)-ই হল চিকিৎসার আসল কথা। শারীরিক পরিশ্রম,অতিরিক্ত স্ট্রেস কমানো, ফাস্ট ফুড ও অতিরিক্ত শর্করা খাবার পরিহার, বেশি পরিমাণ ফল ও শাক-সব্জী গ্রহণ এবং মদ্যপান/ধূমপান থেকে বিরত থাকা চিকিৎসার মূল অঙ্গ ।
পিরিয়ড নিয়ন্ত্রণে হরমোন পিল ব্যবহার করা হয়। রক্তে শর্করা কমানোর ওষুধ যেমন মেটফরমিন-র ভূমিকা কতখানি তা এখনও সংশয়ের বিষয়। তাই সুস্থ জীবনযাত্রাই হোল প্রতিরোধের অস্ত্র।
খুব সুন্দর বিশ্লেষণ ।