২১শে আগস্ট, ২০১৫ শুক্রবার। শুক্রবার সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতালে আমার আউটডোর থাকত। আমি জেনেরাল ফিজিশিয়ান হলেও আমার ক্লিনিকটা প্রাইমারী কেয়ার ক্লিনিক নয়। অর্থাৎ সাধারণ সর্দি-কাশি-জ্বর-ডায়রিয়া ইত্যাদি আমাকে দেখতে হয় না। আমি দেখি দীর্ঘস্থায়ী রোগের রোগীদের। এই শুক্রবার রোগীদের একটু অন্য খবরও নেবো ভাবলাম।
বর্ষা, হাসপাতালের সামনে জলজমা, ইত্যাদি কারণে এই শুক্রবার রোগীরা ছিলেন সংখ্যায় অনেকটাই কম। মোট ৫৭ জন রোগীর মধ্যে ৩৮ জন মহিলা, ১৯ জন পুরুষ। মুসলমান ৩৯ জন, হিন্দু ১৬, আদিবাসী ২।
এই ৫৭ জনের মধ্যে মাত্র ১৭ জনের একটা করে অসুখ (অর্থাৎ কেবল উচ্চরক্তচাপ বা ডায়াবেটিস বা আর কিছু)। ২৭ জনের দুটো করে অসুখ (অর্থাৎ উচ্চরক্তচাপের সঙ্গে ডায়াবেটিস বা এমন কিছু)। ১১ জনের তিনটে করে অসুখ (যেমন উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে ডায়াবেটিস ও করোনারী ধমনীর রোগ বা এমন কিছু)। ১ জন করে রোগীর চারটে ও পাঁচটা অসুখ একসাথে।
এই দীর্ঘস্থায়ী রোগের রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখলাম ডায়াবেটিস—২৯ জনের। এঁদের মধ্যে ১জন টাইপ ১ অর্থাৎ ইনসুলিন নির্ভর। ৫ জনের ব্লাড সুগার আগে মুখে খাওয়ার ওষুধে নিয়ন্ত্রিত থাকত, এখন মুখে খাওয়ার ওষুধ কাজ করে না, ইনসুলিন নিতে হয়। ডায়াবেটিসের জটিলতা আছে ৪ জনের—ডায়াবেটিস-জনিত কিডনির রোগ ১জনের, ডায়াবেটিস-জনিত নার্ভের রোগ ২জনের, ডায়াবেটিসের কারণে পায়ের ঘা ১ জনের, এঁর পায়ের একটা আঙ্গুল বাদ গেছে। ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি ও ডায়াবেটিক ফুটের রোগী ২ জনকেও ইনসুলিন নিতে হয়।
সংখ্যার হিসেবে অন্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের রোগীরা ছিলেন, যে সংখ্যায়ঃ
উচ্চরক্তচাপ ১৬
করোনারী ধমনীর রোগ ১০
হাঁপানি ৪
রিউম্যাটিক জ্বর ৩
ক্রনিক টনসিল-প্রদাহ ৩
রিউমাটয়েড বাত ১
সেরোনেগেটিভ বাত ১
রিউম্যাটিক হার্টের রোগ ১
হাইপোথাইরয়েড ১
হাইপারথাইরয়েড ১
২১শে আগস্টে আমার দেখা ৫৭ জন রোগীর মধ্যে ১০ জন নির্দিষ্ট সময়ে আসেন নি—দেরি করেছেন ২ সপ্তাহ থেকে নিয়ে সাড়ে ৫ মাস অবধি। ১০ জনের মধ্যে ৭ জন আসতে পারেননি আর্থিক কারণে, ২ জন আসতে পারেননি সঙ্গীর অভাবে, ১ জনের দেরির কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর ২ জন ছিলেন যাঁরা নির্দিষ্ট সময়ে এসেছেন বটে, কিন্তু যে পরীক্ষা করাতে বলা ছিল তা করাতে পারেননি পয়সার অভাবে।
সবচেয়ে বেশি খরচ-সাপেক্ষ এর মধ্যে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা। মাসে মাসে ব্লাড সুগার পরীক্ষা, বছরে একবার ইসিজি, ক্রিয়াটিনিন, লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা। ওষুধের খরচও বেশি, ইনসুলিন লাগলে তো আরো বেশি। বেশ কয়েক বছর আগে অবধি কিছু সরকারী হাসপাতালে বিনা পয়সায় ইনসুলিন দেওয়া হত। এখন দেওয়া হয় না। রোগী নিজে বা তাঁর বাড়ির লোক ইঞ্জেকশন লাগাতে না পারলে তার জন্য আলাদা খরচ।
কেবল উচ্চরক্তচাপ থাকলে খরচ অপেক্ষাকৃত কম, যুক্তিসঙ্গত জেনেরিক ওষুধ ব্যবহার করলে। সঙ্গে বা আলাদা করোনারী ধমনীর রোগ থাকলে খরচ অনেক বেশি—রক্ত যাতে জমাট না বাঁধে তাই এস্পিরিন, রক্তে চর্বির মাত্রা কমাতে এটোরভাস্ট্যাটিন, বুকে ব্যথা কমাতে করোনারী ধমনী-প্রসারক। আমাদের রোগীরা এঞ্জিওপ্লাস্টি বা বাইপাস অপারেশন করাবেন এমন আর্থিক সঙ্গতিই তাঁদের নেই।
রিউম্যাটিক জ্বর থেকে যাতে রিউম্যাটিক হার্টের রোগ না হয় তাই তিন সপ্তাহ ছাড়া বেঞ্জাথিন পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন লাগাই আমরা। হার্টের রোগ হয়ে গেলে অপারেশন করানোর সঙ্গতি কোথায় আমাদের রোগীদের? ক্রনিক টনসিলাইটিসে অনেক ক্ষেত্রেই অপারেশন করে টনসিল বাদ দেওয়া উচিত জানি, কিন্তু কতোবার লাইন লাগিয়ে কতোদিনে কলকাতার সরকারী হাসপাতালে সুযোগ মিলবে? তাই বেঞ্জাথিন পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন লাগিয়ে বাড়াবাড়ি ঠেকিয়ে রাখা।
রিউমাটয়েড বাত বা সেরো-নেগেটিভ বাত হলে রোগীর সরবস্বান্ত হওয়ার উপক্রম। চিকিৎসা না করালে হাত-পা বেঁকে পঙ্গু হয়ে যাওয়া। ওষুধ বলতে মেথোট্রেক্সেট-এ যদি কাজ চলে তাহলে ভালো, সালফাস্যালাজিন খেতে হলে খরচ একলাফে অনেকটা বেড়ে যায়। লেফ্রোনামাইড তো আমাদের রোগীরা কিনতেই পারেন না। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা দেখা পরীক্ষাগুলোও খরচ-সাপেক্ষ। রক্তের ওপর প্রভাব দেখতে—Hb%, TC, DC, ESR, Platelet Count, লিভারের ওপর প্রভাব দেখতে Liver Function Test, কিডনির ওপর প্রভাব দেখতে Serum Creatinine পরীক্ষা—চিকিৎসা শুরুর প্রথম তিনমাস মাসে মাসে করে দেখতে হয়, তারপর তিনমাস ছাড়া ছাড়া। খরচ কমাতে আমরা পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়েছি—Hb%, TC, DC, ESR, Platelet Count, SGPT, Urine—albumin, তাতে খরচ নামে পাঁচ ভাগের একভাগে। তাও করাতে পারেন না আমাদের অনেক রোগী।
বারবারই মনে হয়, সেদিন আবারও মনে হল—দ্বীপ-দ্বীপান্তর থেকে যদি রোগীদের আসতে না হত, সব গ্রামে যদি হাসপাতাল হত। যদি এমন হত—অসুস্থ হলে কোন ডাক্তার দেখাবেন সেটা ঠিকই করা আছে, অথচ তার জন্য কোনো খরচ নেই। কোন সমস্যায় ডাক্তার কি পরীক্ষা করাবেন তা চিকিৎসার নির্দেশিকায় লিখিত ভাবে আছে, কোথা থেকে পরীক্ষা হবে, তাও আগে থেকে স্থির করা আছে, তাতেও কোনো খরচ নেই। ডাক্তার ওষুধ লেখেন প্রামাণ্য চিকিৎসা-বিধি মেনে, ওষুধ পাওয়া যায় বিনামূল্যে। বিশেষ প্রয়োজনেই বিশেষজ্ঞকে সুপারিশ করা যায় এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষজ্ঞও ঠিক করা আছে। হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা, প্রাথমিক থেকে সবচেয়ে ওপরের স্তর—কোনো স্তরেই কোনো খরচ নেই। নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার সমস্ত খরচ যোগায় সরকার প্রধানত প্রত্যক্ষ কর থেকে।
এমন একটা ব্যবস্থা থাকলে সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতাল, বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতাল, শ্রীরামপুর শ্রমজীবী হাসপাতাল, শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র, আমাদের হাসপাতাল—কোন কিছুরই দরকার হত না। কিন্তু দেশের নাগরিকরা যথাযথ স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতেন।
আমরা যারা উপরোক্ত সংস্থাগুলো চালাই তাদের কম খরচে চিকিৎসা করার পাশাপাশি ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’-এর লক্ষ্যে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। সেটাই বোধহয় আমাদের আসল কাজ—এমনটা আবার মনে পড়ে গেল ২১শে আগস্ট।