ভার্টিগো বা মাথা ঘোরা এক অত্যন্ত পরিচিত উপসর্গ যা অনেক মানুষেরই হয়ে থাকে। এই বিষয়ে আলফ্রেড হিচকক এক সুপারহিট সিনেমা বানিয়েছিলেন গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে। যা ছিল এক অনবদ্য এবং জনপ্রিয় সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার।
মাথা ঘোরা কোনো ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যা থেকে হতে পারে। তবে, অনেকেই একে হালকাভাবে নেন, যা ঠিক নয়। এই উপসর্গ সামান্য আপাত-গুরুত্বহীন কারণে হতে পারে। আবার এর পিছনে জটিল, গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাণঘাতী কারণও থাকতে পারে।
মাথা ঘোরা, একটি সাধারণ কিন্তু অস্বাভাবিক উপসর্গ,অনুভূতি বা বিভ্রম যাতে একজনের চারপাশের সবকিছু ঘুরছে বলে মনে হতে থাকে। এই উপসর্গটি ক্ষণস্থায়ী হতে পারে বা দীর্ঘস্থায়ী, হালকা এবং সামান্য হতে পারে বা গুরুতর। এই উপসর্গ রোগীর দৈনন্দিন জীবনকে উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
যদিও মাথা ঘোরা প্রায়শঃই গুরুতর হয় না, তবু এটা মনে রাখা উচিত যে মাথা ঘোরা নিজে কোনো রোগ নয়, রোগের উপসর্গ মাত্র।
অনেকেই ‘মাথা ঘোরা’ কে ‘হঠাৎ মাথা হাল্কা হয়ে যাওয়ার অনুভুতি’ থেকে আলাদা করতে পারে না। মাথা হঠাৎ হাল্কা হয়ে যাওয়ার অনুভূতি সিনকোপ-এর আগে হতে পারে। এমনকি এটি ব্রেন ষ্ট্রোক -এর সূচনা হতে পারে। এক্ষেত্রে কিন্তু চারপাশের সবকিছু ঘুরছে বলে মনে হয় না। শুধু মাথাটা ভারহীন বলে বলে মনে হয়। রোগী অনেক সময় চোখে অন্ধকার দেখতে পারে। কখনো অতিরিক্ত মানসিক চাপ, উদ্বেগ, হতাশা ও দুঃশ্চিন্তা থেকেও ডিজিনেস বা মাথা হাল্কা হয়ে যাওয়ার মত অনুভূতি হতে পারে।
বিভিন্ন কারণে মাথা ঘুরতে পারে। সবচেয়ে সাধারণ কিছু কারণের মধ্যে রয়েছে বিনাইন প্যারোক্সিসমাল পজিশনাল ভার্টিগো (BPPV) । এটি একটি কানের ভিতরের (অন্তঃকর্ণের) সমস্যা। এক্ষেত্রে মাথা ঘোরা, মাথা হাল্কা হয়ে যাওয়ার অনুভূতি, এমনকি গা বমি বমি করার অনুভূতি বা বমিও হতে পারে। একজন মানুষের সারা জীবনে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ২ শতাংশের সামান্য বেশী। সাধারনতঃ ৫০-৫৫ বছর বয়সের পরে এই রোগ হতে পারে। এতে কানের ভিতরের ভেষ্টিবুলার সিস্টেম, যা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে করে, তাতে সমস্যা হয়। সঠিক কি হয়, এই বিষয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন রকমের মতামত আছে। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হল, একটু বয়স হলে ভেষ্টিবুলার সিষ্টেমের সেমিসার্কুলার ক্যানেলে অবস্থিত তরলের মধ্যে মিহি গুঁড়ো গুঁড়ো পাথরের মত বস্তু তৈরি হয় (অনেকটা গলব্লাডারের পাথরের মত)। মাথার বিশেষ কোনো কৌণিক অবস্থানে সেই গুঁড়োগুলো যদি সেমিসার্কুলার ক্যানেলের তরল পদার্থের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তবে শরীরে ভারসাম্যের অভাব ঘটে এবং মাথা ঘোরে।
ভার্টিগো-র আর একটি কান (অন্তঃকর্ণ) ঘটিত কারণ হল মিনিয়ারস্ ডিজিজ’। এটা কিছুটা বিরল রোগ যা তুলনামূলক কম বয়সে হয়। এতে মাথা ঘোরার সাথে সাথে বধিরতা, কান ঝাঁ ঝাঁ করা, কান ভারী হয়ে যাওয়া হতে পারে। এর চিকিৎসা আছে। তবে অনেক সময়ই মিনিয়ারস্ ডিজিজ’ সম্পূর্ণ সারে না।
সাধারণ মানুষ তো বটেই, অনেক সাধারণ চিকিৎসাকর্মীরও এইসব জটিল বিষয় বিস্তারিত জানা থাকে না। সাধারণ ল্যাবরেটরি পরীক্ষাগুলোতে এই বিষয়টা ধরাও পড়ে না। মধ্যবয়স্ক রোগীদের এই রোগের সাথে ঘাড়ে
স্পন্ডিলাইটিসও থাকতে পারে। তাতে ঘাড়ে ব্যথা হয়। এক্সরে করলেই ঘাড়ের স্পন্ডিলাইটিস ধরা পড়ে। একই রোগীর একই সাথে বিনাইন প্যারোক্সিসমাল পজিশনাল ভার্টিগো (BPPV) এবং ঘাড়ে স্পন্ডিলাইটিস থাকতে পারে। স্বভাবতঃই মানুষের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ঘাড়ে স্পন্ডিলাইটিস থেকে রোগীর মাথা ঘোরে। ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল এবং কাকতালীয়।
ভেষ্টিবুলার কারণে মাথা ঘোরা হঠাৎ হঠাৎ হয়- শোয়া থেকে হঠাৎ বসা বা বসা থেকে হঠাৎ শোয়ার সময় শুরু হতে পারে। এই মাথা ঘোরা খুব সামান্য সময় থাকে। ওই সময়ে মাথার বিশেষ কৌণিক অবস্থানের সাথে চোখের দৃষ্টির অস্বাভাবিক দিকবদল (nystagmus) হতে পারে। সঙ্গে কানে কখনও কখনও (সব ক্ষেত্রে নয়) ঝিঁঝি আওয়াজ, কানে একটু কম শোনা, কানে ব্যথা, বমি বমি ভাব থাকতে পারে।
এছাড়া কারো যদি মস্তিষ্কে স্ট্রোক হয় বা হয়ে থাকে, মস্তিষ্কে টিউমার থাকে, মস্তিষ্কে ইনফেকশন থাকে, হৃদযন্ত্রে ব্লক থাকে, চোখে সমস্যা থাকে, স্নায়বিক ব্যাধি, উদ্বেগ এবং রক্তাল্পতা থাকে, কানে যদি কোনো রোগ থাকে, কানে জল ঢুকে যায়, কানে পুঁজ হয়, অন্তঃকর্ণ বা মধ্যকর্ণে প্রদাহ হয় তাহলেও মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব বা বমি হয়ে থাকে। মাইগ্রেন এবং কিছু কিছু ওষুধের প্রভাবেও মাথা ঘুরতে পারে।
যদি মাথা ঘোরা ক্রমাগত বারবার হতে থাকে অথবা সঙ্গে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, গুরুতর মাথাব্যথা, হঠাৎ শ্রবণশক্তি হ্রাস, কান থেকে পুঁজ বেরোনো ইত্যাদি হয় তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক প্রথমে গুরুতর কারণ গুলো খুঁজবেন। সেসব কিছু না পাওয়া গেলে মাথাঘোরার উপসর্গ কমাবেন এবং ভেষ্টিবুলার সমস্যা, বিনাইন প্যারোক্সিসমাল পজিশনাল ভার্টিগো (BPPV),স্নায়বিক ব্যাধি, উদ্বেগ ইত্যাদি আছে কি না খুঁজে দেখবেন এবং তার চিকিৎসা করবেন। আজকাল অনেক হাসপাতালেই আলাদা ভার্টিগো ক্লিনিক থাকে। সেখানেও যোগাযোগ করতে পারেন।