মফস্বলের এই গাঢ় শীতের সন্ধেগুলো জুড়ে যে আধো কুয়াশার চাদর নেমে আসে, তাকে বিষণ্ণতা নামেই ডাকা ভালো।
সারাদিনের অনেকটা সময় জুড়ে অংশত মেঘলা আকাশ… আচমকা বয়ে আসা বাতাসে ঝরে যেতে থাকে শালের হলুদ পাতা… খুব ভোরবেলা কেউ ঝাঁট দিয়ে রাস্তার পাশে পাতার স্তূপ সাজিয়ে রাখে…
বছর ফুরিয়ে আসে।
এখনও, এসব মফস্বলে, দূর থেকে মাইকে ভেসে আসা গানের মধ্যে রয়ে যায় পুরনো বাংলা গান… সুমন কল্যাণপুরের আশ্চর্য নির্লিপ্ত আবেগ-মাখানো কণ্ঠে… মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে… (এমন বুকের মধ্যে শূন্যতার উদ্রেককারী গান – কথা-সুর-কণ্ঠ-গায়কী ও যন্ত্রানুষঙ্গের এমন অমোঘ মিশেল – আমি আর কোথাও শুনিনি, সত্যিই)
হ্যাঁ, বসন্ত আসবে। তবে, মাঝে এই শীত ঋতু। শীতের এই ক্ষণস্থায়ী দিনগুলি, সুদীর্ঘ রাতগুলি।
গাছের ঝরে যাওয়া পাতার মতো করেই, এই বিপুল প্রাণবন্ত জীবনবৃক্ষ থেকেও ঝরে যাবে কিছু প্রাণ। জীবনবৃক্ষ অবশ্য চিরহরিৎ – কেবল শীতঋতুকে পর্ণমোচনের কাল ধরলে তার চলে না – গ্রীষ্মে হোক বা বর্ষায়, এমনকি খুশীর শরতে বা মিলনোন্মুখ বসন্তেও, তাকে পাতা ঝরাতেই হয়।
তবু বোধকরি, ঝরে যাবার পক্ষে শীতের চাইতে উপযুক্ত ঋতু হয় না।
আরেক অর্থে, এমন বিষণ্ণ সন্ধেয় চলে যাবার কথা – চলে যেতেই হবে, এমন কথা – ভাবলে বড্ডো মন কেমন করে। আরও নিবিড় মায়া নিয়ে রূপরসগন্ধময় অস্তিত্বটাকে আঁকড়ে ধরার লোভ হয়। ইচ্ছে হয়…
এমনই এক সন্ধেয় বসে চিকিৎসকের নৈতিক কর্তব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক নিয়ে পড়তে বসেছি। ইউথ্যানাশিয়া। অর্থাৎ রোগীর ইচ্ছে অনুসারে তার মৃত্যুতে চিকিৎসকের সহযোগিতা – অন্তত কিছু ক্ষেত্রে উচিত, নাকি ক্ষেত্র-নির্বিশেষে সর্বদাই অনুচিত? এদেশে ব্যাপারটা বেআইনি, কাজেই অত ভাবার জায়গাই নেই। কিন্তু আইনের উর্ধ্বে যে নীতিবোধ, নৈতিক দায়িত্ব – সেই জায়গা থেকে ভাবতে বসলে?
ধরুন, সামনে থাকা রোগীটি চাইছেন, এই অসহ্য যন্ত্রণাময় পরিস্থিতি থেকে চিকিৎসক তাঁকে মুক্তি দিন। রোগী নিজে জানেন – আর চিকিৎসক তো জানেনই – তাঁর অসুখ সারার সম্ভাবনা নেই। আর বড়জোর মাসকয়েক বাঁচার সম্ভাবনা – শারীরিক কষ্ট এখনই দুর্বিষহ, তা উত্তরোত্তর আরও খারাপ হতে চলেছে – আগামী দিনগুলোর দিকে তাকালে কোনও আশা নয়, চূড়ান্ত আতঙ্ক জাগে। রোগী মুক্তি চান। এতদিন ধরে যাঁর কাছে নিরাময় চেয়েছেন – নিরাময়ের আশা যখন ফুরিয়েছে, তখন যন্ত্রণার উপশম চেয়েছেন – সে আশাও যখন শেষ, অবশেষে রোগী আজ সেই প্রিয় চিকিৎসকের হাত ধরে মুক্তি চাইছেন। ডাক্তারবাবু কী করবেন?
অথবা… রোগী সবরকম ইচ্ছেপ্রকাশের ক্ষমতা হারিয়েছেন… গাঢ় আচ্ছন্নতার মধ্যে রয়েছেন, কিংবা বাকশক্তিরহিত এবং হাত-পা নাড়ার ক্ষমতাও নেই… ডাক্তারবাবু বুঝতে পারছেন যে প্রকাশ করতে না পারলেও সামনের সেই মানুষটা অসহনীয় কষ্ট পাচ্ছেন এবং রোগীর পরম আদরের সন্তান কিংবা স্বামী/স্ত্রী চিকিৎসকের হাত ধরে অনুনয় করছেন – ডাক্তারবাবু, প্লিজ, ওঁকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিন, আপনি তো পারেন…
এথিক্স বলে, রোগীর যাতে ভালো হয়, রোগীর যাতে আরাম হয় – পেশেন্টের বেস্ট ইন্টারেস্ট বুঝে – ডাক্তার সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন।
কিন্তু মৃত্যুকে কি কখনও কারও ‘বেস্ট ইন্টারেস্ট’ হিসেবে দেখা যায়? দেখা সম্ভব?
নাকি, সম্ভব?
আগে যে পরিস্থিতিগুলো বললাম, সেখানেই সম্ভব? মানে, রোগীর বেস্ট ইন্টারেস্ট রক্ষা করা সম্ভব হবে তাঁর মৃত্যুতে সহায়তা করলে?
যাঁরা পরজন্মে বিশ্বাস করেন, তাঁদের পক্ষে হয়তো কল্পনা করাটা সহজ। ইহজন্মে আর যে কয়েকটি দিন বাকি আছে, তা উত্তরোত্তর চরম কষ্টকর হতে চলেছে – মুক্তি পেলে, পরজন্ম হয়তো সুখকর হলেও হতে পারে, অন্তত এতখানি দুর্বিষহ তো না-ও হতে পারে।
কিন্তু যদি পরজন্মে বিশ্বাস না করেন? যদি বিশ্বাস করেন, মৃত্যুতেই সব শেষ, মরণের ওপারে আর কিছু নেই – তাহলে?
জীবন থাকলেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার স্রোত অব্যাহত – মৃত্যুর অর্থ তা স্তব্ধ হয়ে যাওয়া। হ্যাঁ, অসহ্য যন্ত্রণায় কষ্ট পাওয়া মানুষটির কাছে সেই অভিজ্ঞতা আর কোনও ভাবেই সুখকর নয়… তবু… তবু… নিজের মাথায় হাতুড়ির বাড়ি মেরে চলা উন্মাদের কাজের যুক্তি যেমন… থামলেই যে কী আরাম… অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে যদি একটি লহমাও আচমকা, অকারণেই, যুক্তিহীনভাবেই, যন্ত্রণাহীন হয়ে ওঠে… সেই ক্ষণিক ‘আরাম’-এর সম্ভাবনাকেও অগ্রাহ্য করা যাবে কী করে? যন্ত্রণা, চরম যন্ত্রণা, চূড়ান্ত কষ্ট – অভিজ্ঞতা হিসেবে তা কতখানি অসহনীয় হয়ে উঠলে, সবরকম অভিজ্ঞতার নিরসন, অর্থাৎ মৃত্যু, রোগীর ‘বেস্ট ইন্টারেস্ট’ হিসেবে দেখা যেতে পারে?
প্রশ্নগুলো কঠিন। আর উত্তর একেবারেই অজানা।
শীতের সন্ধের গা বেয়ে রাত্রি নামে।
একটু একটু হিম পড়ে। আর হাল্কা বাতাসেও ঝরে পড়ে শালপাতা।
লতা মঙ্গেশকার তাঁর চিরকালীন কিশোরী কণ্ঠে গেয়ে চলেন… ও সাত ভাই চম্পা গো রাজার কুমার, কোথায় পক্ষীরাজ ঘোড়া তোমার তলোয়ার…
নিকটবর্তী রেললাইন ধরে ক্রমশ দূরে চলে যায় দূরপাল্লার ট্রেন।








